ইসলামী অর্থনীতি : প্রয়োগ ও বাস্তবতা
- শাহ্ আব্দুল হান্নান
- ১৫ অক্টোবর ২০২০, ২০:৩২
অর্থনীতির ঐতিহাসিক প্রয়োগের দিকটি যদি আমরা লক্ষ করি, তাহলে আমরা দেখতে পাবো, ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর হয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল এ জন্য যে, ইসলামের জাকাত এবং ওয়াক্ফর যে ব্যবস্থা তার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা সহজ। বলা প্রয়োজন, প্রকৃতপক্ষে অর্থনীতি প্রধানত সরকারি ছিল না। এটা এক দল ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দ্বারা সংগঠিত ছিল। ইসলামী অর্থনীতি যেহেতু অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশে বিশ্বাস করে, মানুষের যে উদ্ভাবনী শক্তি তার ওপর বিশ্বাস করে, মানুষের যে যোগ্যতা তার ওপর বিশ্বাস করে এবং যেহেতু ইসলাম মানুষকে প্রয়োজনীয় কিছু বিধি-নিষেধের আওতায় স্বাধীনতা দেয়, ফলে সে অর্থনীতি সাধারণত বিকাশমান হয়। অগ্রগতিমুখী হয়। সে কারণেই অর্থনীতি তখন উন্নতি করেছিল। আর অর্থনীতি উন্নত করার কারণে দারিদ্র্য কম ছিল।
একইভাবে তখন ইসলামী অর্থনীতির জন্যে কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসার ঘটে। তখন দারিদ্র্য খুব কমই দেখা দেয় এবং যা-ও দেখা দিয়েছিল তা প্রাকৃতিক কারণে। দেখা গেল কোথাও হয়ত বৃষ্টিপাত হয়নি। আর এসব কারণে যেখানে সমস্যা দেখা দিয়েছে। সাধারণত সরকার তার রাজস্ব অর্থাৎ বায়তুল মালের অর্থ দিয়ে সেই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে এবং করেছে। আর এ ধরনের পরিস্থিতির কথা যদি আমরা বাদ দিই তাহলে সাধারণভাবে যে পরিস্থিতি ছিল তাতে জাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্যের সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। তখন খুব কম লোকই গরিব ছিল। কিন্তু যারা ধনী তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে প্রচুর অর্থবিত্ত ছিল। তাদের জাকাত হতো। মুসলিম ইতিহাসে এমন অনেক সময় গেছে যখন জাকাত দেয়ার মতো তারা লোক পেত না।
এরপর ওয়াক্ফর কথা যদি বলি তাহলে বলব, ইসলামে দানকে, ইনফাক ফি সবিলিল্লাহ, আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে সবাই চাইতেন কিছু সম্পদ দরিদ্রদের মধ্যে ওয়াক্ফ করে দিত। এই ওয়াক্ফর আয় থেকে শুধু ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চলত বা আমরা যাকে সরাইখানা বলি (অর্থাৎ তখনকার পথিক বা আগন্তুকদের জন্য যে মেহমানখানা) তা চলত- যা সরকার চালাত। তখন প্রায় সবখানেই সরাইখানা করা হতো। এসব ওয়াক্ফর আয় দিয়ে ছাত্রদের বেতন দেয়া হতো। দরিদ্রদের সাহায্য করা হতো। তাদের বৃত্তি দেয়া হতো। এমনিভাবে সার্বিক অভাব মুসলিম বিশ্ব থেকে দূর করা সম্ভব হয়েছিল। তখন মুসলিম বিশ্বের কোনো ব্যক্তি অভাবী ছিলেন বা দরিদ্র ছিলেন বা না খেয়ে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে- এ রকম ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। কিংবা বলা যায়, ঘটেনি, বিশেষ করে উমাইয়াদের আমল থেকে শুরু করে কলোনিয়াল ব্যবস্থার উত্থানের আগ পর্যন্ত।
ইসলামে জাকাত এমন একটি ব্যবস্থা যা কঠিন দারিদ্র্য দূর করতে সক্ষম। এর মূল কারণ হলো, বর্তমানে আমাদের কিংবা বিভিন্ন দেশে যে এনজিওগুলো কাজ করে তারা যে স্বল্প ঋণ দেয় (যদি টাকার হিসাবে বলি, পাঁচ হাজার বা ১০ হাজার এ রকম) তা তারা এক বছর, ছয় মাস, তিন মাস, এমনি করে বিভিন্ন সময়ের মধ্যে ফেরত নেয়। এব স্বল্প আয় থেকে ঋণ ফেরত দেয়া এবং তার ওপর আবার বাড়তি সুদ ফেরত দেয়া, যেটা এনজিওরা চায় তা প্রকৃতপক্ষে সম্ভব হয় না। এ জন্য এনজিওরা দারিদ্র্যবিমোচন করতে বিশেষ করে কঠিন দারিদ্র্য দূর করতে পারে না।
কিন্তু ইসলামের যে জাকাত ব্যবস্থা সেটা হলো প্রকৃতপক্ষে ট্রান্সফার, এটা একবারে দিয়ে দেয়া হয়; এটা আর ফেরত নেয়া হয় না। এ প্রসঙ্গে আমাদের স্কলাররা বলেছেন, জাকাত এমন পরিমাণ দিতে হবে যাতে জাকাতগ্রহীতা স্বাবলম্বী হয়ে যায়। বেশির ভাগ ফিকাহবিদ এ কথাই বলেছেন যে, এমনভাবে দিতে হবে যাতে তাকে আর কারো কাছে যেতে না হয়। অর্থাৎ স্বাবলম্বী করে দাও, কিংবা অন্তত এই পরিমাণ দাও যাতে এক বছর আর তার কাছে ফিরে আসতে না হয়। এই যে দৃষ্টিভঙ্গি তার বাস্তব প্রয়োগের কারণেই তখন কঠিন দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব হয়েছিল। এখনো যদি মুসলিমবিশ্ব দারিদ্র্য দূর করতে চায় তাহলে জাকাতকে এবং জাকাতের সাথে সাথে এ ধরনের ট্রান্সফারের মাধ্যমেই এই কাজটি করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে এনজিওদের প্রতি আমার পরামর্শ হবে, ওরা যেভাবে করছে সেভাবে হবে না। তাদের মধ্যে ট্রান্সফারের একটা উপাদান থাকতে হবে। ইসলামের দাবি এটা যে, তারা সুদভিত্তিক কোনোকিছু না করুক। তারা সেটাকে মুসলিম দেশগুলোতে বিশেষ করে ইসলামের ভিত্তিতে করুক। এটা তারা সার্ভিস চার্জের ভিত্তিতে করতে পারে। তাতে তাদের লাভ হবে না; কিন্তু তাদের খরচ উঠে আসবে। এখানে সার্ভিস চার্জ হলো, যে পরিমাণ দিয়েছি তার ওপর এত পরিমাণ নেয়া যাতে তার প্রশাসনিক খরচ আদায় হয়ে যায়। কিন্তু তার চেয়ে এক পয়সাও বেশি নিলে তা সুদ বলে গণ্য হবে। এটাই হলো ওআইসির ফিকাহ একাডেমির ফতোয়া বা ঘোষণা বা রুলিং।
এনজিওগুলোর উচিত হবে, সার্ভিস চার্জের ভিত্তিতে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাপনায় যাওয়ার সাথে সাথে এ ধরনের ঋণের সাথে ট্রান্সফারকে একত্র করা। কথা উঠতে পারে, যদি দান বা অনুদান দেই তাহলে সেটি তারা খেয়ে ফেলতে পারে। তারা সেটি ফেরত দেবেও না বরং খেয়ে ফেলবে, তাতে কাজ হবে না। এই সমস্যাগুলো রয়েছে। আর এটা যে হতেও পারে তা অস্বীকার করা যায় না। আমাদের মধ্যে স্বভাব খারাপের জন্য এ রকম পরিস্থিতি হতে পারে। কিন্তু তথাপি আমাদের ভালো সুপারভিশনের মাধ্যমে এই পদ্ধতি সার্থক করার চেষ্টা করতে হবে, অন্য পদ্ধতিতে হবে না।
জাকাতের ব্যাপারে আইন কী হবে তার একটা স্ট্রাকচার আমরা ইতোমধ্যে পাকিস্তানে পেয়ে গেছি। সে দিক থেকে জাকাতের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। যদিও সরকারি পর্যায়ে আদায়ের ব্যাপারটি এখানে তেমন ভালো করে গড়ে ওঠেনি। আদায় এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে সেটিকেই এখন গড়ে তুলতে হবে। এটা সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমেও হতে পারে। রাষ্ট্র যদি বলে দেয় আমরা এই অংশটুকু পর্যন্ত আদায় করব, বাকিটা জনগণ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে আদায় করবে। সেটিও সম্ভব, একেবারে অসম্ভব কিছু নয়। যদিও তার অনেক আইনগত বা শরিয়ত সংক্রান্ত দিক রয়েছে। সেগুলো পরীক্ষা করে আমাদের দেখতে হবে। যদিও এটা বড় কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। (জাকাত সম্পর্কে দ্রষ্টব্য : ইসলামে জাকাতের বিধান : ড. ইউসুফ আল কারযাভি)। আগে একসময় ছিল জাকাত মানুষ একদম দিত না। এখন যারা ব্যবসায়ী, যারা শিল্পপতি তারা জাকাতের জ্ঞান উপলব্ধি বা প্রকৃতি সম্পর্কে বুঝে গেছেন। ফলে ভালো লক্ষণ হলো যারা এটা জানেন তাদের বেশির ভাগই এখন জাকাত দেন। তারা যতটুকু বোঝেন ততটুকুই দেন। এ ক্ষেত্রে তাদের উপলব্ধি আরো ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন। আলেমদের দায়িত্বও অনেক। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, আলেমরা অনেক পুরনো বই পড়েছেন কিন্তু তাদের আধুনিক বইও পড়া প্রয়োজন।
আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভির বইটি পড়লে দেখা যায়, জাকাত কত বড় মাধ্যম এবং এর মাধ্যমে বিশে^র কত সমস্যার সমাধান করা যায়; অর্থনীতির কত সমস্যার সমাধান করা যায়।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা