২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জেনেটিক কাঁচি, কৃষ্ণগহ্বর, হেপাটাইটিস সি

জেনেটিক কাঁচি, কৃষ্ণগহ্বর, হেপাটাইটিস সি - ছবি সংগৃহীত

বিজ্ঞানে চমকপ্রদ কয়েকটি গবেষণা কাজের জন্য এবার নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। আটজন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী চিকিৎসা, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখায় এ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন তিনজন নারী বিজ্ঞানী।

মানবদেহে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস শনাক্তের জন্য গবেষণা করে এবার চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন মার্কিন বিজ্ঞানী হার্ভি জে অল্টার, চার্লস এম রাইস এবং ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত মাইকেল হফটন। তাদের গবেষণার কারণেই জটিল রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এখন হেপাটাইটিস সি ভাইরাসটি শনাক্ত করা সম্ভব। এর ফলে অনেক দেশে রোগটি নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হয়েছে। নোবেল পুরস্কারের জন্য বিজ্ঞানীদের নাম ঘোষণা করে বিচারকরা বলেন, মানবদেহের রক্তে জন্ম নেয়া হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবেই তাদের এ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। বিজ্ঞানী হার্ভি জে অল্টার (৮৫) যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথে (এনআইএইচ) কর্মরত। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক বিজ্ঞানী চার্লস এম রাইস (৬৮) নিউইয়র্কের রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। আর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল হফটন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টায় কাজ করছেন।

পদার্থবিজ্ঞানে এবার নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে বহুল আলোচিত কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ এবং গ্যালাক্সি নিয়ে গবেষণার জন্য। কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে নিরলস গবেষণায়রত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ প্রমাণ করেন, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আসলেই ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বই কৃষ্ণগহ্বর গঠনে ভূমিকা রেখে চলেছে। ৮৯ বছর বয়সী এই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার যুক্তির ওপর ভর করে আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ে বা আকাশ গঙ্গার প্রাণকেন্দ্রে দৈত্যাকার কৃষ্ণগহ্বর খুঁজে পান জার্মান বিজ্ঞানী রাইনহার্ড গেনজেল ও মার্কিন বিজ্ঞানী আন্দ্রেয়া গেজ। ৬৮ বছর বয়সী গেনজেল জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ফিজিকসের পরিচালক। আর ৫৫ বছর বয়সী আন্দ্রেয়া গেজ যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক। এ দুই বিজ্ঞানী আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অদৃশ্য এবং ভারী এক ধরনের বস্তু (সুপারম্যাটিভ কমপ্যাক্ট অবজেক্ট বা দৈত্যাকার কৃষ্ণগহ্বর) আবিষ্কার করেন। ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়া শুরুর পর পদার্থ বিদ্যায় এ পুরস্কার পাওয়া চতুর্থ নারী হলেন আন্দ্রেয়া গেজ। তার আগে ১৯০৩ সালে মারি কুরি, ১৯৬৩ সালে মারিয়া জিওপার্ট-মায়ের এবং ২০১৮ সালে ডোনা স্ট্রিকলেশু পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পান। পুরস্কারে খুশি হয়ে আন্দ্রেয়া গেজ বলেন, আমার প্রত্যাশা, আমি অন্য নারীদের অনুপ্রাণিত করতে পারব।’
ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন নারী বিজ্ঞানী এবার রসায়নে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন জিন প্রযুক্তি নিয়ে তাদের অসাধারণ গবেষণার জন্য। তারা জিন প্রযুক্তির এমন একটা উপায় আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে প্রাণীর ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড) পরিবর্তন করা যাবে। উদ্ভিদ ও অণুজীবের ডিএনএ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও একই রকম সাফল্য মিলবে।

ফ্রান্সের ৫১ বছর বয়সী অণুজীব বিজ্ঞানী ইমানুয়েল শারপঁসিয়ে বর্তমানে জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইউনিট ফর দ্য সায়েন্স অব প্যাথোজেনসে কাজ করছেন। আর ৫৬ বছর বয়সী যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী জেনিফার এ ডাউডনা ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জিন পরিবর্তনের সবচেয়ে কার্যকর কৌশল আবিষ্কারের কারণে। ২০১২ সালে তারা ডিএনএর নির্দিষ্ট অংশ কাটতে সক্ষম জেনেটিক সিজার বা জেনেটিক কাঁচি উদ্ভাবন করেন। এটা জিন প্রযুক্তির অন্যতম সেরা প্রযুক্তি হিসেবে বিবেচিত। এই কৌশলের পোশাকি নাম হচ্ছে সিআরআইএসপিআর/সিএএস-নাইন। একে ক্রিসপার ক্যাসনাইনও বলা হয়ে থাকে।
নারী বিজ্ঞানীদ্বয়ের এই আবিষ্কারকে জিন প্রযুক্তির অন্যতম সেরা উপায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন নোবেল কমিটির বিচারকেরা। তারা বলেছেন, এই আবিষ্কার উদ্ভিদের বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রেও নয়া সুযোগ নিয়ে এসেছে। এ কথায় বলা যায়, এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গবেষকেরা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে যেকোনো প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবের বংশগতির ধারক ডিএনএ পরিবর্তন করতে পারেন। জীববিজ্ঞানে এই প্রযুক্তির প্রভাব ‘বৈপ্লবিক’। এর মাধ্যমে ক্যান্সার চিকিৎসাসহ বংশগত কারণে কারো দেহে সৃষ্ট রোগের সম্পূর্ণ নিরাময়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ জিনগত রোগ সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রে গবেষকরা যে স্বপ্নের জাল বুনছেন, তা সত্যে পরিণত করবে সিআরআইএসপিআর/সিএএস-নাইন বা ‘জেনেটিক সিজার্স’। জীববিজ্ঞানকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষকরা পশু, গাছপালা, মাইক্রোঅর্গানিজম বা উদ্ভিজ্জগতের ডিএনএতে বদল ঘটাতে পারবেন। ক্যান্সার এবং যেসব রোগ উত্তরাধিকার সূত্রে আসে তাও নিরাময় করা সম্ভব হবে। কোষের মধ্যে জিন পরিবর্তনের যে কাজটা এই দুই নারী বিজ্ঞানী করেছেন তা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ তো বটেই, এক সময় অসম্ভব মনে করা হতো। বর্তমানে তা সম্ভব হয়েছে। এতে মানবতা নানাভাবে উপকৃত হবে।

উল্লেখ্য, এর আগে রসায়নে পাঁচজন নারী নোবেল জিতেছেন। তাদের নিয়ে এ সংখ্যা বর্তমানে সাতে দাঁড়াল। আর পুরুষ বাদে শুধু দু’জন নারীকে এ পুরস্কার দেয়া এবারই প্রথম।

হেপাটাইটিস সি ভাইরাস

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার সবার দৃষ্টি কেড়েছে। হেপাটাইটিস সি ভাইরাস শনাক্ত এবং নিরাময় কৌশল আবিষ্কারের জন্য এ বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিজ্ঞানী হার্ভি জে অল্টার, মাইকেল হফটন ও চার্লস এম রাইসকে এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসটি আবিষ্কার করেন প্রায় ৩০ বছর আগে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, হেপাটাইটিস সি স্বাস্থ্যগত একটি অন্যতম বড় বৈশ্বিক সমস্যা। বর্তমানে বিশ্বে সাত কোটি ১০ লাখ মানুষ হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। প্রতি বছর এ রোগে আক্রান্ত হয় ৭০ লাখ মানুষ। হেপাটাইটিস সি’র কারণে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারে প্রতি বছর চার লাখ মানুষ মারা যায়।

হেপাটাইটিস হলো ভাইরাসজনিত লিভার বা যকৃতের রোগ। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পাঁচ ধরনের হেপাটাইটিস রয়েছে। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি ও ই। হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ স্বল্পমেয়াদি লিভার রোগ। এটি বিশ্রাম নিলে এক পর্যায়ে সেরে যায়। তবে প্রাণঘাতী হচ্ছে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসের সংক্রমণ। সারাবিশ্বে লিভার ক্যান্সারের ৮০ শতাংশেই দায়ী হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’। হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ বেশি ছড়ায় খাদ্য ও পানিবাহিত হয়ে অর্থাৎ হাইজিন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে। দীর্ঘমেয়াদি লিভার রোগের অন্যতম কারণ হেপাটাইটিস সি। এটা লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ।

হেপাটাইটিস ‘এ’ ও হেপাটাইটিস ‘বি’ শনাক্ত হওয়ার পরও বিজ্ঞানীরা হেপাটাইটিস সি ভাইরাস নিয়ে দীর্ঘদিন অন্ধকারে ছিলেন। অবশেষে নোবেলজয়ী ওই তিন বিজ্ঞানীর অক্লান্ত চেষ্টায় শনাক্ত হয় হেপাটাইটিস সি। তাদের গবেষণার ফলে রক্তবাহিত এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতিও উদ্ভাবিত হয়েছে। দ্রুতগতিতে আবিষ্কৃত হয় এই ওষুধ। নোবেল কমিটি জানায়, চল্লিশের দশকেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, দুই ধরনের সংক্রামক ভাইরাস হেপাটাইটিসের জন্য দায়ী। প্রথমটির নাম ‘হেপাটাইটিস এ’। দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে এটি ছড়ায়।

অপর ধরনটির নাম ‘হেপাটাইটিস বি’। রক্ত ও শারীরিক অন্যান্য তরল পদার্থের মাধ্যমে এটি ছড়ায়। এর সংক্রমণে সিরোসিস ও যকৃতের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। তবে সত্তরের দশকে হার্ভি জে অল্টার ও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথে তার সহকর্মীরা লক্ষ করলেন, হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা উদ্ভাবিত হওয়ার পরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রক্তবাহিত হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু হেপাটাইটিস ‘এ’ কিংবা ‘বি’-এর পরীক্ষায় এসব রোগীর জটিলতা পুরোপুরি চিহ্নিত হচ্ছে না। আক্রান্ত রোগীদের বেশির ভাগ অন্যের কাছ থেকে রক্তের কোনো না কোনো উপাদান গ্রহণ করেছিলেন (ব্লাড ট্রান্সফিউশন)। অল্টার ও তার সহকর্মীদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়, ওই রোগীরা আসলে নতুন ধরনের হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। অল্টার এ রোগের নাম দেন ‘নন এ, নন-বি হেপাটাইটিস’। এর এক দশক পর মাইকেল হফটন ও তার সহকর্মীরা নতুন ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স করেন। সবশেষে, চার্লস এম রাইস ১৯৮৯ সালের দিকে প্রমাণ করেন, নতুন ভাইরাসটি সম্পূর্ণ আলাদা। এর নাম দেয়া হয় হেপাটাইটিস সি। এই ভাইরাসের সংক্রমণেও সিরোসিস ও যকৃতের ক্যান্সার হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস নির্মূলে কর্মসূচি নিয়েছে। তবে ওষুধ আবিষ্কৃত হলেও ভাইরাসটির এখনো কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে প্রায় এক কোটি মানুষ আক্রান্ত। ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশনের হিসেবে, হেপাটাইটিসে প্রতি বছর ২২ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা: মোহাম্মদ আলীর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে শুধু হেপাটাইটিস সিতে অন্তত এক শতাংশ মানুষ অর্থাৎ প্রায় ১৬ লাখ মানুষ আক্রান্ত। এ রোগের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এর লক্ষণ উপসর্গ খুব কম, তাই আক্রান্ত হলেও সহজে ধরা পড়ে না। রোগী কিছু বুঝতে পারে না। ফলে এক সময় লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সার তৈরি হয়। রোগটির ওষুধ খুব ব্যয়বহুল। যেহেতু এর টিকা এখনো নেই, তাই ব্যক্তিগত সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম।

ব্ল্যাকহোলের জয়জয়কার!
ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে হইচই গত এক শতাব্দী ধরে। কৃষ্ণগহ্বরের আকৃতি ও অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানীরা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় নিমগ্ন ছিলেন। সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের ভিত্তিতে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন যে ধারণা রেখে গিয়েছিলেন, সেটিই আজ সত্যে পরিণত হচ্ছে। কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে। সেটা নিয়ে এখন আর সংশয় নেই, তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। গাণিতিক মডেলে এর অস্তিত্ব প্রমাণিত।
১৯১৫ সালের নভেম্বরে সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে আইনস্টাইনের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলে তা নিয়ে গোটা বিশ্বে আলোড়ন ওঠে। আইনস্টাইন দেখান, গোটা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ে ‘খেলছে’ গ্র্যাভিটি বা অভিকর্ষ বল। এই অভিকর্ষ বলই পৃথিবীর সাথে আমাদের বেঁধে রাখে। সূর্যকে কোন কোন কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করবে সৌরমণ্ডলের গ্রহগুলো, তা ঠিক করে দেয় এই বলই। ঠিক করে দেয় এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে কোন কক্ষপথ ধরে প্রদক্ষিণ করবে সূর্য। এই বলের জন্যই আন্তঃনক্ষত্র মেঘ থেকে তারাদের জন্ম। আবার এই বলের জন্যই সেই তারাদের ‘মৃত্যু’ হয়।

আইনস্টাইন দেখালেন, কোনো ভারী মহাজাগতিক বস্তুর অভিকর্ষ বলই মহাকাশের স্থান ও সময়কে নাড়িয়ে দেয়। আর খুব ভারী কোনো মহাজাগতিক বস্তুর অসম্ভব জোরালো টানে তার আশপাশে থাকা প্রায় সব কিছুই তার মধ্যে ঢুকে পড়ে। তার ‘নাগপাশ’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না আলোও। এরাই ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। আলো বেরিয়ে আসতে পারে না বলেই এদের এমন নামকরণ। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না আইনস্টাইন। ব্ল্যাকহোল নিয়ে তিনি সংশয়ও প্রকাশ করেছিলেন। পরে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসে, ব্ল্যাকহোলের চার পাশে থাকে একটা এলাকা, যার নাম ‘ইভেন্ট হরাইজন’। কিন্তু এদের অস্তিত্ব অসম্ভব, এটা বিশ্বাসই করে উঠতে পারছিলেন না আইনস্টাইন।

অবশেষে আইনস্টাইনের মৃত্যুর ১০ বছর পর ১৯৬৫ সালে বিজ্ঞানী অল্টার পেনরোজ গাণিতিকভাবে দেখিয়ে দিলেন ব্ল্যাকহোল সত্যি সত্যিই আছে। আর গাণিতিকভাবে তিনি দেখান, ব্ল্যাকহোলের অন্দরে রয়েছে এমন একটি সীমানা, যেখানে পৌঁছে প্রকৃতির সব নিয়মই ভেঙে পড়ে। আইনস্টাইনের দীর্ঘ কয়েক দশকের সংশয় মোচন করেছিলেন যিনি, সেই বিজ্ঞানী রজার পেনরোজকে এ বছর পদার্থে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হলো। তার সাথে আরো দুই বিজ্ঞানী রাইনহার্ড গেঞ্জেল ও আন্দ্রেয়া গেজ প্রমাণ করলেন, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মতো এই সৌরজগতে কোটি কোটি গ্যালাক্সির প্রতিটিরই কেন্দ্রে রয়েছে একটি করে সুপারসেসিভ ব্ল্যাকহোল বা দৈত্যাকার কৃষ্ণগহ্বর।

কোনো নক্ষত্রের ভেতরের সমস্ত বস্তুকণা একটি মাত্র বিন্দুতে পুঞ্জীভূত হয়। সেই বিন্দুকে সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু বলে। সিঙ্গুলারিটির চার পাশে যতদূর পর্যন্ত এর মহাকর্ষীয় বলের প্রভাব থাকে, সেই অঞ্চলটি হলো কৃষ্ণগহবর। এই কৃষ্ণগহবর নিয়ে বিস্তর কাজ করে গেছেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। তিনি বলে গেছেন, কৃষ্ণগহবর পুরোপুরি কালো নাও হতে পারে। এতে সব হারিয়ে যায় না। কৃষ্ণগহবর থেকেও বিকিরণ হতে পারে। তার এই মতবাদ ‘হকিং বিকিরণ’ নামে পরিচিত।

২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল বিজ্ঞানীদের টেলিস্কোপে ধরা দেয় কৃষ্ণগহবরের প্রথম ছবি। বিশেষভাবে নির্মিত ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের (ইএইচটি) ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা এ ছবি প্রকাশ করেন। কৃষ্ণগহবরটির আকার প্রায় ৪০ বিলিয়ন কিলোমিটার। সহজ করে বললে, এটা পৃথিবীর প্রায় ৩০ লাখ গুণ বড়। আকারে এটা এতটাই বিশাল যে, বিজ্ঞানীরা একে ‘দৈত্যাকৃতির’ বলে উল্লেখ করেন। কৃষ্ণগহবরটি পৃথিবী থেকে ৫০০ মিলিয়ন ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। পৃথিবীজুড়ে স্থাপন করা আটটি টেলিস্কোপের মাধ্যমে এই কৃষ্ণগহবরের ছবি ধারণ করেন বিজ্ঞানীরা। বিবিসিকে বিজ্ঞানী হেইনো ফালকে বলেন, এম ৮৭ নামের একটি ছায়াপথে (গ্যালাক্সি) এই বিশাল কৃষ্ণগহবরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর আকৃতি সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, আকৃতিতে কৃষ্ণগহবরটি আমাদের সমগ্র সৌরজগতের চেয়েও বড়। এর ভর সূর্যের ভরের চেয়ে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন গুণ বেশি। এটি স্রেফ দৈত্যাকৃতির কৃষ্ণগহবর। ব্ল্যাকহোল নিয়ে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামও কাজ করেছেন। তিনি এর নাম দেন ‘কৃষ্ণবিবর’। এর রহস্য নিয়ে গবেষণা চলছেই।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব


আরো সংবাদ



premium cement