করোনাকালের কিছু কথা
- মীযানুল করীম
- ১০ অক্টোবর ২০২০, ১৮:১৪
বাংলাদেশে ‘কাল’ বলতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই তিনটি কালের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে প্রচলিত কাল হলো ঋতু। বছরে ছয়টি ঋতু এ দেশে। তবে বর্তমানে এর সাথে যোগ হয়েছে ‘করোনাকাল’। বিশ্বে মূলত চলতি ২০২০ সালের সূচনাই ‘করোনাকাল’ হিসেবে। আর আমাদের এ দেশে এ কালের সূচনাসময় গত মার্চ মাসের কার্যত দ্বিতীয় সপ্তাহ। সে হিসাবে সাত মাস কেটে গেছে ইতোমধ্যেই। তবুও করোনার বিরতি দূরের কথা; ভয়, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা এতটুকু কমেনি। কারণ, ‘লকডাউন’ কিংবা ‘লকআপ’ থাক বা না থাক, দেশের মানুষ দেখছে- করোনাভাইরাস ঘটিত ‘নোভেলা কোভিড-১৯’ মহামারী কখন কার প্রাণ কেড়ে নেয়, তার নেই কোনো নিশ্চয়তা। ৩১ মে পর্যন্ত সরকারের ঘোষিত সাধারণ ছুটি ছিল। তবে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু এর পরই বেশি হতে দেখা যাচ্ছে। আশা ছিল, এ ছুটি তুলে নেয়ার পর মহা বা অতিমারী কমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। বাস্তবে এর তাণ্ডব বেড়েছে। যদিও সরকার তার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ‘জীবন’-এর চেয়ে ‘জীবিকা’কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ‘সবকিছু স্বাভাবিক’ দেখাতে চেয়েছে। এটা করা হচ্ছে মোদির ভারত, ট্রাম্পের আমেরিকা, জনসনের ব্রিটেন, বোলসোনারোর ব্রাজিল ছাড়াও স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, ইরান, প্রভৃতি দেশেও। কারণ, মনে করা হয়- মহামারী এত শিগগিরই বন্ধ করা সম্ভব নয়। অন্য দিকে, দেশ চালাতে হবে এবং জাতীয় অর্থনীতিকে হবে বাঁচাতে।
অবশ্য ইদানীং করোনা মহামারীর second wave বা দ্বিতীয় তরঙ্গ নিয়ে বাংলাদেশসমেত বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো বিষম উদ্বিগ্ন। এটা হয়তো স্বাভাবিক, তবে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তা আগে থেকে বলা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে চালু হয়ে গেছে ‘Twoindemic’ কথাটা যা বুঝাচ্ছে, ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ’কে।
কমিউনিস্ট বিপ্লবের জন্য অতীতে সহিংসতাকে অপরিহার্য মনে করা হতো। এ ক্ষেত্রে কারো থিওরি ছিল ‘Hit, Hit and Hit,’ আর কারো কারো মতে সঠিক ছিল ‘Hit and Hit,’ পদ্ধতি। এখন মনে হচ্ছে, করোনা মহামারী বারবার আঘাতের মধ্য দিয়ে পয়লা পদ্ধতির অনুসারী। এই অতিমারী তার বিধ্বংসী অভিযান ক’দফা চালাবে, তা জানেন কেবল পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি- হায়াত, মউত, রিজিক ও দৌলতের মালিক একমাত্র তিনিই।
যা হোক, উত্তর গোলার্ধে বাংলাদেশের মতো যেসব রাষ্ট্রে এমনকি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রও শীত ঘনিয়ে আসছে, সব দেশেই করোনার ‘দ্বিতীয় আঘাত’ নিয়ে দুশ্চিন্তায় সরকারসহ সচেতন মানুষের গায়ের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। তবে ভেতরে এমন চরম দশা হলেও বিভিন্ন দেশের বাহ্যিক হাবভাবে মনে হতে পারে, তেমন সিরিয়াস কিছু ঘটবে না। বিশেষ করে ভারত এবং পাশ্চাত্যের টিভি-সিনেমার সিরিয়াল দেখে এমন বর্র্ণিল বিভ্রান্তি ঘটতে পারে।
মাস্ক পরা সর্বত্র বাধ্যতামূলক। করোনাকালে এটা নতুন কথা নয়। মাস্ক পরুন বা না পরুন, সবাই জানেন- এটাই এই মহামারীর সময়ে অপরিহার্য বা অবশ্যকরণীয়। তবে বাংলাদেশের মানুষ যেন ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’। তাই তো এদেশে মাস্ক পরুয়ারা দিন দিন মাইনরিটি (হয়তো সামনের দিনগুলোতে ব্রাত্যজন) হয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশে গরিব মানুষরা বলছেন, ‘করোনা-ফরোনার মতো ব্যারাম হয় ধনীদের যারা কেবল আরাম খোঁজে।’ কিন্তু বিপদ তো বলে কয়ে আসে না এবং সাবধানের মার নেই। এখানে যিনি ১০ টাকায় একটা সিগারেট কিনতে দরাজদিল, তিনিই পাঁচ টাকা দিয়েও একটা মাস্ক কেনাকে বেদরকারি ভাবেন। দিনের কামাই যার ১০০ টাকাও না, তিনিও এই ‘ব্যাধি’তে ভুগছেন। আর সচ্ছল মানুষের অনেকেই দামি পোশাক পরলেও কমদামি মাস্ক কিনতেও কিপটেমির শেষ নেই। ধূমপায়ীদের করোনাঝুঁকি অনেক গুণ বেশি। চিকিৎসকদের মতো এটা অধূমপায়ীদের চেয়ে ১৪ থেকে ১৮ গুণ বেশি। তবুও বীর বাঙালির ‘কুছ পরোয়া নেহি’। তারা মাস্কের হয়তো ধারই ধারেন না। কিংবা মাস্ক মুখ থেকে নামিয়ে কিংবা কানে পেঁচিয়ে অথবা গলায় ঝুলিয়ে দামি সিগারেটের দামি ধোঁয়া উদগীরণে ব্যস্ত থাকেন। ঢাকায় চলছে মেট্রোরেলের মেগা-প্রজেক্ট। স্থানে স্থানে বড় করে লেখা : Safety first (সুরক্ষা বা নিরাপত্তাই সর্বপ্রথম)। যারা মাস্ক না পরে ‘আমি কী হনুরে’ মহাভাব নিয়ে এবং ‘ড্যাম কেয়ার’ ভঙ্গিতে চলছেন, তাদের কাছে বোধ হয়, নিরাপত্তাই সর্বশেষ (Safety Last). এ জন্যই এখন এ দেশে ২০ শতাংশের বেশি মানুষ মাস্ক পরেন না। অথচ এটাই করণীয় হিসেবে সর্বপ্রথম।
যখন বাংলাদেশে করোনা মহামারীতে মৃতের সংখ্যা হাজার দুয়েক, তখনো অনেকে ভেবেছেন-এতে মোট প্রাণহানি দেশে বড়জোর পাঁচ হাজারে পৌঁছতে পারে। তার বেশি নয়। কারণ সরকার বলছে জোর দিয়ে, মহামারীতে মৃত্যুর হার কমছে। বাস্তবে উল্টো। ইতোমধ্যেই মৃতের সংখ্যা তিন, চার ও পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। উঠতে উঠতে তা কত উপরে ওঠে, কেবল আল্লাহ আলিমুল গায়েবই জানেন।
এবার একদিন আমাদের সরকারের বড় গলার বড় দাবি নাকচ করে বিশ্বের সেরা একটি বৈজ্ঞানিক জার্নাল জানায়, এ সরকারের দাবির চারগুণ মানুষ বাংলাদেশে প্রাণ হারাচ্ছে কোভিড মহামারীতে। তাছাড়া, একদিন ঢাকার সরকার দাবি করেছে, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা বা কোভিডে আক্রান্ত হয়ে এ দেশে সবচেয়ে কম মানুষ মারা গেছে।’ আল্লাহর কী ইচ্ছা! তারপর দিন থেকেই আবার মৃতের সংখ্যাটা বাড়তে থাকে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে করোনা জীবাণুর ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ’ নিয়ে উদ্বেগ এবং আসন্ন শীতকালীন প্রস্তুতি নিয়ে স্বয়ং সরকারের বক্তব্য আসলে জনমনে ভীতি ও দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। তবুও মানুষ মাস্কের ব্যাপারে বেখবর। ফলে মাস্ক না পরা মানুষ দিন দিন বাড়ছে। খোদ ঢাকাতেই যদি এ ব্যাপারে কোনো অভিযান, মোবাইল কোর্ট বা শাস্তি না থাকে, বাইরের অবস্থা বুঝতে কষ্ট হয় না। এখন জনগণের Grand Majority মাস্ক পরে না। অনেকের কাছেই তা নেই। অপর দিকে, Tiny Minority ভয়ে ভয়ে মাস্ক পরছে (পাছে লোকে কিছু বলে)। কিন্তু মাস্ক পরিধান করা ঐচ্ছিক নয়; বাধ্যতামূলক। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই সর্বপ্রথম করণীয়। যারা নিয়ম নির্দেশ মেনে মাস্ক পরেন, তারা জড়োসড়ো। অন্যরা বুক ফুলিয়ে, গলায় ঝুলিয়ে চলেন। অনেকে অগত্যা মধুসূদনের ন্যায় কানে পেঁচিয়ে কিংবা থুতনি ঢেকে রাখেন না পরার মতো। অনেকের কাছে মাস্কের কার্যকারিতার চেয়ে মনোহারিত্ব বড় বলে সুযোগ নেন ধান্ধাবাজ ব্যবসায়ীরা।
এখন Talk of the World হচ্ছে নিঃসন্দেহে করোনাভাইরাস তথা এর সৃষ্ট মহামারী। স্বাস্থ্যনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি ছাড়িয়ে করোনা ঢুকে পড়েছে প্রতাপশালী রাজনীতিতেও। তাইতো মিডিয়ার চরম উদ্বেগজনক গরম খবর ‘করোনা কূটনীতি’ আর ‘ভ্যাকসিন রাজনীতি’র। একই কারণে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অস্থিরতা তার নির্বাচনের আগেই করোনার টিকা আবিষ্কার নিয়ে। বাংলাদেশ নিয়ে চীন-ভারত দ্বৈরথের নবহেতুও এটাই। করোনার সুবাদে কে বেশি ‘অভিভাবকত্ব’ করবেন, এই দৃষ্টিকটু প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে দিল্লির সাথে বেইজিংয়ের। অন্য দিকে, ওয়াশিংটনের সঙ্গেও বেইজিংয়ের।
এই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মাঝে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’-এর উগ্র ধ্বনিও কর্ণগোচর হয়েছে। যারা ধর্ম, ভাষা, বর্ণ, শ্রেণীর নাম ভাঁড়িয়ে জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক মতলববাজিতে লিপ্ত, তারাই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’-এর নামে নিজেদের রাষ্ট্রীয় বা সরকারি আধিপত্য ও কর্তৃত্ব কায়েম করতে চান। তাদের রাজনীতিতে মানুষ নয়, ক্ষমতাই মুখ্য এবং তাদের কাছে করোনার তুলনায় কূটনীতির দাম বেশি। তাই, ট্রাম্পের টিটকারির শিকার হলেও, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান নির্বাহী ডা: টেডরোস আধানোম গ্রেবিয়াসুস বলেছেন, ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’কে প্রতিরোধ করতে হবে।
পুনশ্চ: ক. অনেকের কাছে মাস্ক সুরক্ষার জন্য জরুরি নয়। এটা নাকি নিছক ফ্যাশনের উপকরণ। তাই একজন কেতাদুরস্ত ক্রেতা গেলেন মাস্ক কিনতে। দোকানিকে বললেন, সুন্দর মাস্ক আছে? দোকানি : অবশ্যই। বলুন, কোন কালারের দেবো? ক্রেতা : চা রঙের। দোকানি : দুধ মেশানো নাকি দুধ ছাড়া চা? ক্রেতা : দুধ মেশানো; দোকানি : সেই চা কি চিনি দেয়া, না চিনি ছাড়া?
খ. ট্রাম্পের করোনা হয়েছে। এখন দুনিয়াজুড়ে বড় খবর। এই ট্রাম্প ‘সামান্য জ্বর’ বলে করোনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যঙ্গ করলেন মাস্ক পরা নিয়ে। নির্বাচনী প্রপাগান্ডায় ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় না রাখায় তার সমালোচনার জবাবে নির্বাচনী প্রতিপক্ষ জো বাইডেনকে জবাব দিয়েছেন, ‘আপনিও এটা করতেন’। কিন্তু এর পরই খবর এলো করোনা হোয়াইট হাউজকে কাবু করে ফেলার। অর্থাৎ ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট’ ট্রাম্পের চেয়েও করোনা সুপ্রিম। এর মানে, টেস্ট রেজাল্ট ‘পজিটিভ’। এদিকে, প্রতিপক্ষ বাইডেনের পক্ষে জনমত বেড়েছে এ খবরে। তবে ট্রাম্পের অন্ধভক্তরা ভাবছেন, ডেমোক্র্যাটিক বাইডেন টেস্টে নেগেটিভ মানে, ইলেকশন রেজাল্টেও নেগেটিভ!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা