পেঁয়াজের ঝাঁজে ইলিশের রাজনীতি
- গোলাম মাওলা রনি
- ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৮:৫৮
আরবিতে একটি শব্দ রয়েছে হামিম। এটি একটি গুণবাচক শব্দ। হামিমের যে গুণাবলি রয়েছে তা অন্য কারো নেই। অন্য দিকে, হামিমের গুণাবলিসম্পন্ন মানুষও কেবল আরব দেশেই রয়েছে। পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের জলবায়ু আবহাওয়া এবং মাতৃগর্ভ হামিম পয়দা করতে পারে না বিধায় হামিমের প্রতিশব্দ পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় নেই। ঊষর মরুভূমির দুর্গম প্রান্তে মানুষ যখন মরুঝড়ের কবলে পড়ে অথবা মরুভূমি পাড়ি দিতে গিয়ে মানুষ যখন পথ হারিয়ে ফেলে এবং ক্ষুধা তৃষ্ণায় মারা যায় অথবা যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে শত্রুপক্ষের কবলে পড়ে ঠিক সেই সময়টিতে একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের সাথে কতটা উত্তম ব্যবহার করতে পারেন তার ওপরই নির্ভর করে হামিম শব্দের যথার্থতা। হামিম হলো মানুষের এমন বন্ধু যে কিনা বন্ধুর বিপদে পাশে দাঁড়ায় তাকে অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত বন্ধুকে ছেড়ে পালায় না এবং মৃত্যু যখন অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন হামিমই প্রথম মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য এগিয়ে যায়।
বাংলাদেশে যেমন হামিমের মতো বন্ধু নেই তদ্রূপ বাংলা ভাষাতেই এই শব্দটির সমর্থক প্রতিশব্দ নেই। আমাদের ভাষায় বন্ধু বলতে যা বুঝায় সেটিকে শত শত ভাগে বিভক্ত করে আমাদের স্বভাব চরিত্র আবেগ আকাক্সক্ষা অথবা বীরত্ব বা কাপুরুষতার সাথে মিল রেখে সংজ্ঞায়িত করা যায়। আমাদের বন্ধুত্ব হয় স্থান-কাল ও পাত্র ভেদে। আমরা দিনের বেলায় যাদের সাথে বন্ধুত্ব করি তাদের রাতের বেলায় চিনি না। আবার রাতের বেলায় যাদের বন্ধু বানাই তাদের সূর্যের আলোতে না চেনার ভান করি। আমরা পার্ক, ফুটপাথ, মাছবাজার, কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে অন্যান্য বেচাকেনার স্থলে যেরূপ বন্ধু বানাই সেরূপটি বানাই না দেবালয়ে অথবা মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডায়। আমরা খাবার টেবিল, জুয়ার কোর্ট, মদের আড্ডা অথবা অন্য কোনো বিনোদনে যেরূপ বন্ধু খুঁজি সেরূপ বন্ধুকে আবার বাসগৃহে প্রবেশ করাতে চাই না।
বন্ধুত্ব নির্বাচনে আমাদের মন-মানসিকতা বন্ধুত্বের জন্য আদিখ্যেতা বিপদের সময় বন্ধুকে ছেড়ে যাওয়া এবং সুযোগ পেলে নাকানি চুবানি খাওয়ানো ইত্যাদির সাথে হামিমের তুলনা করা চলে না। অন্য দিকে, আমাদের এই চরিত্র কেবল গাঙ্গেয় ব-দ্বীপেই সীমাবদ্ধ নেই বরং সমগ্র ভারতবর্ষেই বন্ধুত্ব প্রায় সমার্থক। অধিকন্তু আমাদের বৃহত্তর ভারতবর্ষের বন্ধুত্ব ক্ষমতা, টাকা এবং মেজাজ মর্জির ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। এই অঞ্চলে বন্ধুত্বের জন্য কোনো ইউনিফাইড কোড অব কন্ডাক্ট নেই। বরং বছরের ছয়টি ঋতুর সাথে তাল মিলিয়ে ভারতবাসীর বন্ধুত্ব নড়াচড়া বা ওঠানামা করে। হাজার হাজার বছরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় চিন্তাচেতনা- এতদসংক্রান্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ, দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ, মারামারি পাশাপাশি খানাপিনা, ভোগবিলাস, বিয়েশাদি, উৎসব পার্বণ ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা হাজারো প্রকৃতির বন্ধুত্ব সৃষ্টি করতে পারলেও আরব দেশের মতো হামিম সৃষ্টি করতে পারিনি।
আজকের নিবন্ধ লিখতে গিয়ে হামিম শব্দটির কথা মনে এলো মূলত ভারত বাংলাদেশের তথাকথিত বন্ধুত্ব এবং সাম্প্রতিককালের পেঁয়াজ কেলেঙ্কারি এবং ইলিশ মার্কা রাজনীতির বন্ধুত্বের নমুনা এবং প্রতিক্রিয়া দেখার পর। ভারতকে নিয়ে এ দেশের কিছু মানুষের ভাঁওতাবাজি এবং বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের চানক্য নীতির রসায়নে কী ধরনের বন্ধুত্বের রসায়ন সৃষ্টি হতে পারে তা আমরা ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে গেলেই হাড়ে হাড়ে টের পাই। ভারতের বন্ধুত্বের উষ্ণ স্পর্শ আমরা হৃদয়ঙ্গম করি প্রায় প্রতি বছর আমাদের প্রধানতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহার সময়কালে। আমাদের বর্ষাকালে বন্যার সময়ে ভারত যেভাবে উদারহস্তে আমাদের দেশের মধ্য দিয়ে বহমান নদীগুলোর উজানে তাদের সীমানায় যে বাঁধ নির্মাণ করেছে সেই বাঁধগুলোর গেট খুলে দিয়ে আমাদের অধিকতর পানিতে জলকেলি করার সুযোগ করে দেয় তা স্মরণ করলে আমরা আনন্দে কান্দন না করে থাকতে পারি না।
আমরা ভারতকে বন্ধু মনে করে তাদের সাথে নিশিরাতের অভিযানে অংশ নিয়ে হিমালয়ের চূড়ায় উঠতেও দ্বিধা করি না। কিন্তু ভারতের দয়ায় হিমালয়ের মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ার কাছাকাছি হতেই বন্ধু আমাদের কাছে যে কর দাবি করে বা বন্ধু দক্ষিণা চেয়ে বসে তা শুনে আমাদের অনেকেরই পিলে চমকে যায়। তারা আমাদের ভয়তি মুখকে আরো ফ্যাকাসে বানিয়ে হৃদয়ের গহিনে বন্ধুত্বের মরণ যন্ত্রণা অনুধাবন করিয়ে ছাড়ে যখন আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের নিশিরাতের বন্ধু তার কাক্সিক্ষত ভোগ না পেলে হিমালয়ের চূড়া থেকে ফেলে দেবে। বন্ধুর ওপর বিশ্বাস করার জন্য যে প্রেক্ষাপট পরিবেশ ও পরিচিতি থাকা দরকার তা না থাকার কারণে আমাদের দেশে যেমন অসম বন্ধুত্ব হয় তেমনি ভারত ও আমাদের কখনো বন্ধু কখনো অনুগ্রহভাজন আবার কখনো কখনো তাদের সেবাদাস বলে মনে করে।
ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বটা যদি অনুধাবন করতে হয় তবে আমাদের দেশের অসম বন্ধুত্বের দু-চারটি নমুনা বর্ণনা করা যেতে পারে। ধরুন গ্রামের সৈয়দ শাহ তার প্রতিবেশী কলিমউদ্দিনকে মাঝে মধ্যে আদর আপ্যায়ন করেন। যে দিন সৈয়দ সাহেবের বৈঠকখানায় তার সমপর্যায়ের কোনো অতিথি থাকে না গল্প করার জন্য সে দিন সময় কাটানোটা সৈয়দ সাহেবের জন্য কষ্টকর হয়ে ওঠে। তিনি তখন আর্দালি পাঠিয়ে কলিমউদ্দিনকে ডেকে আনেন। দু-চারটি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন। মন ভালো থাকলে দু-এক খিল পান খাওয়ার অনুমতি দেন এবং কলিমউদ্দিনের কোনো জায়গা জমি বিক্রি করার দরকার কিনা তা কৌশলে জেনে নেন। কলিমউদ্দিন সৈয়দ সাহেবের এই বদান্যতার অপকৌশল বুঝতে পারেন না। তিনি পুরো গ্রামে গর্ব করে বলে বেড়ান যে, সৈয়দ সাহেবের সাথে তার বন্ধুত্ব রয়েছে।
সৈয়দ সাহেব এবং কলিমউদ্দিনের বন্ধুত্বের মতো না হলেও ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব যে সমতার ভিত্তিতে নেই এই কথা আমরা কমবেশী সবাই বুঝি। কিন্তু বোঝে না কেবল ওই সব লোক যারা নিজেদের ভারত বন্ধু বলে দাবি করেন এবং বন্ধুর মনোরঞ্জনের জন্য সর্বদা সবকিছু করার জন্য ১০ পায়ে খাড়া থাকেন।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের একাংশের মধ্যে ইদানীংকালে ভারতের বন্ধুত্বের বাস্তবতা সম্পর্কে যেমন-অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে তদ্রূপ দলের বিরাট একটি অংশ গোপনে এবং প্রকাশ্যে ভারত তোষণের নীতিতে কেবল অটলই নয়, বরং বন্ধুর স্বার্থ রক্ষার জন্য নিজেদের সম্মানহানিতেও তারা বিব্রত বোধ করেন না। সাম্প্রতিককালের এক হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানির বিপরীতে ভারত কর্তৃক কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ করে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের আদেশকে যারা অপমান মনে করেন না, তাদের ব্যাপারে কোনো কিছু বলতেও কেমন যেন রুচিতে বাধছে!
ভারত-বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সম্পর্কের রেশ ধরে পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষকরা গত প্রায় এক বছর ধরেই বলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন যে, ভারতের মোদি সরকার এখন আর আওয়ামী লীগকে আগের মতো বিশ্বাস করছে না। ২০১৮ সালের মহাবিতর্কিত এবং ন্যক্কারজনক জাতীয় নির্বাচনের ঘটনাবলির পর বাংলাদেশের প্রতি ভারতের তাচ্ছিল্য অতীতের সব রেকর্ড ব্রেক করে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যারা ২০১৯ সালে ভারত ভ্রমণে গিয়েছিলেন তারা প্রায় সবাই সেখানে গিয়ে অভূতপূর্ব বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েন। আমাদের দেশের তাঁবেদার গণমাধ্যম এবং তাদের দোসররা সেসব বিব্রতকর খবর রীতিমতো ব্লাক আউট করে দেয়। অন্য দিকে, সরকারের দমননীতির ভয়ে দেশের সচেতন নাগরিকরা ওসব বিষয়াদি নিয়ে কথা বলা থেকে নিজেদের বিরত রাখে।
২০২০ সালে এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অনেকটা চীনমুখী হয়ে পড়ে, যা কিনা ভারতকে ক্রোধান্বিত করে তোলে। ভারত বাংলাদেশকে কতটা ক্ষতি বা কতটা উপকার করতে পারে তা বর্তমানের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে অন্য কেউ ভালো বলতে পারবে না। ফলে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে স্পষ্টতই দুটো গ্রুপ হয়ে যায়। একদল মনে করতে থাকে- চীনের সাথে কৌশলগত বন্ধুত্ব করা গেলে ভারত বাংলাদেশের টিকিটি স্পর্শ করতে পারবে না। তাদের মতে, বন্ধু হিসেবে চীন বিশ্বাসযোগ্য। তাদের প্রতি আস্থা রাখা যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরও করা চলে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে চীন যেসব দেশের সাথে বন্ধুত্ব করে আসছে তাদের কাউকেই এই দেশটি ঠকায়নি। কিংবা বন্ধুত্বের আড়ালে প্রভাব দেখাতে চেষ্টা করেনি। চীন কিভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখে তার বাস্তব উদাহরণ হলো উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান এবং ইরান।
বাংলাদেশের চীনপন্থীদের মতে, ভারত একটি সাম্রাজ্যবাদী দাম্ভিক রাষ্ট্র। তারা প্রতিবেশীদের হক নষ্ট করে। কথায় কথায় যুদ্ধ করে। দুর্বল রাষ্ট্রের সাথে প্রভুগিরি দেখায় এবং সুযোগ পেলে দখল করে নেয়। তারা তাদের নিজ রাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমান জাতি গোষ্ঠীসহ অন্যান্য হাজারো নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর ওপর যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালায় এবং রাষ্ট্রীয় মদদ দিয়ে উগ্রবাদী হিন্দুদের দ্বারা যেসব ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটনায় তা সমসাময়িক দুনিয়ার অন্য কোনো প্রান্তে দেখা যায় না। সুতরাং বাংলাদেশ যদি ভারতকে বেশি পাত্তা দেয় এবং ভারতের মদদে আমাদের গণতন্ত্র, নির্বাচন ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাহস শক্তি ও নীতি-নৈতিকতার কবর রচনা হয়ে যায় তবে সিকিমের ভাগ্য বরণ করা আমাদের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।
চীনাপন্থীদের উল্লেখিত যুক্তিতর্কের বিপরীতে আওয়ামী লীগের একাংশ মনে করে ভারত ছাড়া তাদের গতি নেই। ভারতের মদদের কারণেই তারা গত প্রায় এক যুগ ধরে তেলে-ঝোলে বিত্ত বিলাসে এবং ক্ষমতার স্বাদে এক অনন্য সময় অতিবাহিত করে চলেছেন। ভারত তাদের একাত্তরে স্বাধীন এনে দিয়েছে- পঁচাত্তরের নির্মম ঘটনার পর আশ্রয় দিয়েছে। এমনকি আশি ও নব্বইয়ের দশকে যখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল তখন ওই দলের নেতাকর্মীদের জন্য ভারত তাদের সীমান্ত এমনভাবে রেখেছিল যার প্রয়োজন পড়লেই যেন দলীয় নেতাকর্মীরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত আশ্রয় নিতে পারে। সুতরাং ভারতের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা যাবে না।
উল্লেখিত অবস্থার প্রেক্ষিতে, ভারতপন্থী লোকজনের চেষ্টা তদবিরেই হয়তো বাংলাদেশ থেকে পনের শ’ টন ইলিশ মাছ রফতানির সিদ্ধান্ত হয় এবং তা অবিলম্বে কার্যকর হয়। কিন্তু ভারতপন্থীরা যে আশা ভরসা নিয়ে ইলিশ পাঠিয়েছিল কার্যত তা হিতেবিপরীত ফল বয়ে আনে। ভারতপন্থীদের ন্যাকামো দেখে দিল্লি ধারণা করতে থাকে যে, বাংলাদেশ হয়তো ভয় পেয়ে গেছে- নচেৎ এই অসময়ে হঠাৎ করে ইলিশ পাঠাবে কেন। তারা ইলিশ উপহারের জবাবে চানক্যের কৌশল অবলম্বন করে। যার ফলে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করের দেয়। ফলে পেঁয়াজের ঝাঁজের কবলে পড়ে ইলিশ রাজনীতি মারাত্মকভাবে মার খায় এবং ভারতপন্থীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সুযোগে চীনাপন্থীরা এগিয়ে আসে ও চানক্য নীতির মোকাবেলায় মাস্টার সানঝুর নীতি প্রয়োগ করা আরম্ভ করে, যার পরবর্তী নাটকীয় দৃশ্য দেখার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা