২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

করোনা : কূটনীতি, মাস্ক, ধূমপান ও তাপসী

করোনা : কূটনীতি, মাস্ক, ধূমপান ও তাপসী - ছবি : নয়া দিগন্ত

দিন যত যাচ্ছে, ততই করোনা পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। গত মার্চের ২৫ তারিখ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বাংলাদেশে লকডাউন ছিল কার্যত। সরকার বলেছে, এটি ‘সাধারণ ছুটি’। এ সময়ে করোনা আমাদের দেশে বেশি মানুষকে কেড়ে নেয়নি। তবে ১ জুন সূচিত, ‘অসাধারণ ছুটি’তে এক এক করে অনেক ‘অসাধারণ’ ব্যক্তিত্ব করোনার কশাঘাতে কাবু হয়ে চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের কেউ ছিলেন বয়সের ভারে পীড়িত; কেউবা কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তবে সত্য হলো, করোনার কবলে না পড়লে হয়তো তারা এমন মর্মান্তিকভাবে মহাপ্রস্থানের পথে পাড়ি দিতেন না। তাদের মৃত্যু জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশকে কেবল বঞ্চিত করেনি, জনগণের মনে করোনাভীতি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

ব্যক্তিগতভাবে আমিও চিরতরে এবার হারিয়েছি অনেক আত্মীয়পরিজন, ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও চেনাজানা মানুষকে। এমনকি, নিজের আপন বড় বোন কোভিডের শিকার হয়ে একটি জেলা শহর থেকে এসে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হলেও দেখতে যাওয়ার উপায় ছিল না। ভেন্টিলেশনে এক পক্ষকাল কাটিয়ে তিনি অবশেষে ঈদের পরদিন ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাকে নোয়াখালীর এক গাঁয়ে শ্বশুরবাড়ির গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আমাদের পরিবারের এই অপূরণীয় ক্ষতি কাটানোর সাধ্য কারো নেই। সবই পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত উৎকর্ষ সত্ত্বেও মানুষ কতই না অসহায়। করোনাকাল আমাদের মহাশিক্ষা দিচ্ছে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে। সত্যিই, ‘নিউ নরমাল’-এর রিয়ালিটি কতই না হার্ড (দুঃসহ) ও হেভি (দুর্বহ)।

করোনা নিয়ে কূটনীতি
করোনা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের জন্য দেশে দেশে চলছে ব্যাপক গবেষণা। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে দিয়েছে, ‘কেবল এ ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করলেই হবে না। সেই সাথে, এটা হতে হবে নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব, কার্যকর, সুলভ এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে এ ভ্যাকসিন থাকা চাই।’ রাশিয়া করোনার ডাবল ভ্যাকসিন তৈরি করার দাবি করলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এখনো তার স্বীকৃতি দেয়নি। করোনার ভ্যাকসিন কত দিনে গরিব দেশগুলোর গরিব রোগীদের হাতে আসবে, তার নিশ্চয়তা নেই। অথচ এই ভ্যাকসিন নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতি শুরু হয়ে গেছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে পুঁজিবাদী আমেরিকা আর সমাজবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়ার পূর্বসূরি) সব ব্যাপারে পরস্পর পাল্লা দিত। এখন দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা বা যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েতের প্রধান উত্তরসূরি রাশিয়া করোনার ওষুধ উদ্ভাবন নিয়ে একে অন্যের ওপর টেক্কা মারতে মরিয়া। অতীতে মস্কো মহাশূন্যে মানুষ পাঠিয়েছিল প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকার আগে। তেমনি এবার আমেরিকার আগে করোনা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের দাবি করছে মস্কো। অবশ্য এখন আর রাশিয়া সমাজবাদী নেই।

আমেরিকা ও রাশিয়ার রশি টানাটানির পাশাপাশি করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে চীন বনাম ভারত শুরু হয়েছে ‘করোনা কূটনীতি’। বাংলাদেশে চীন এ ওষুধের ট্রায়াল দেবে শুনে তার প্রতিপক্ষ ভারতের ঘুম উধাও। তড়িঘড়ি পড়িমরি করে ঢাকায় ছুটে এলেন ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। কিছু দিন আগে তিনি স্বদেশের হাইকমিশনার ছিলেন বাংলাদেশে। হর্ষ বাবু উদ্বিগ্ন ও বিমর্ষ চেহারায় ঢাকায় ১২ ঘণ্টা কাটিয়ে প্রমাণ দিলেন, দিল্লি আর নয় ‘দূর অস্ত’।

বাংলাদেশ করোনার দাওয়াই পাওয়ার বেলায় ভারতের কাছে ‘বিশেষ গুরুত্ব’ পাবে বলে হর্ষবর্ধন আশ্বস্ত করে গেলেও এতে আমাদের হর্ষ বা আনন্দ বোধ করার তেমন কারণ নেই। কারণ, বাংলাদেশে দিন দিন করোনা পরিস্থিতির অবনতির ফলে প্রায় প্রতি দিনই আমরা অনেকের সাথে কোনো না কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হারাচ্ছি। অবশ্য, স্বাস্থ্য বিভাগের ওপর দেশবাসীর আস্থার অভাবে তারা করোনার পরীক্ষা কম করার ফলে কম শনাক্ত হওয়ায়, কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে বলছেন, এখন ‘দেশে করোনার তাণ্ডব আগের চেয়ে কম।’ বাস্তবে এ তাণ্ডব কত দিন চলে, ঠিক নেই। অন্য দিকে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কৌটিল্যরা করোনা নিয়ে কূটনীতিতে মাতোয়ারা। এখানেও তাদের রাজনীতি করার বদাভ্যাস গেল না।

আমরা ‘করোনা কূটনীতি’ কিংবা ‘ভ্যাকসিন রাজনীতি’ নয়, এ মহামারীর সত্যিকার ওষুধ চাই এবং তা যত শিগগির সম্ভব। এর উদ্ভাবক দেশগুলো যদি আমাদের প্রকৃত বন্ধু হয়ে থাকে, তা হলে ফ্রি দিক পর্যাপ্ত করোনা ভ্যাকসিন। বিপদেই হয়ে থাকে আসল বন্ধুর পরীক্ষা।

মাস্ক নিয়ে মশকরা!
করোনা মহামারী থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে মুখে মুখোশ বা মাস্ক পরার বিষয়ে। মাস্ক পরিধান ছাড়া ঘরের বাইরে না যেতে বলা হয়েছে। অফিসে, দোকানে, যানবাহনে, রাস্তাঘাটেসহ প্রকাশ্য সব স্থানে এটা পরে থাকা বাধ্যতামূলক। তবে যে আমেরিকাতে করোনার হানা সবচেয়ে ভয়াবহ, অর্থাৎ এর সংক্রমণ ও মৃত্যু সর্বাধিক, সেখানকার স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মাস্কের বিরোধিতা করেছেন। পরে নিজে মাস্ক পরা শুরু করলেও তার কথা ছিল- ‘মাস্ক অবশ্যই পরিধান করা উচিত। তবে তা অন্যদের জন্য বাধ্যতামূলক আর আমার নিজের বেলায় ঐচ্ছিক।’ বরাবর উল্টাপাল্টা ও উদ্ভট কথা বলার জন্য পরিচিত, এই রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী মাস্ক নিয়ে যে এমন অন্যায় মশকরা করবেন, তা কেউ ভাবেননি।

ট্রাম্পের দেশের একজন ‘শেরিফ’ তার চেয়েও এক কাঠি উপরে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাসজনিত কোভিড মহামারীতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্যগুলোর একটির নাম ফ্লোরিডা। কিন্তু সেখানে মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক নয়। তদুপরি সেখানে ম্যারিওন কাউন্টির শেরিফ বিলি উডস তার অফিসের কর্মকর্তাদের মাস্ক না পরতে নির্দেশ দিয়েছেন, সোজা কথায়, সে দফতরে মাস্ক নিষিদ্ধ। শেরিফ ১১ আগস্ট এক বার্তায় বলে দিয়েছেন, ‘আমার কর্মচারী এবং আমার দফতরের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সময় আপনাদের মাস্ক পরতে হবে না। আমার এই নির্দেশ বহাল থাকবে।’

মাস্ক নিয়ে মশকরা এই গরিব বাংলাদেশেও কম হচ্ছে না। মাস্ক মুখে না দিয়ে কানে ঝুলিয়ে রাখা, মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে রেখে আরামে ধূমপান করা (এতে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ১৪ গুণ হলেও), মাস্ক পরে গাড়িতে উঠে মাস্ক খুলে ফেলা, ইত্যাদি সে অবাঞ্ছিত ‘মশকরা’র কিঞ্চিৎ নমুনা।

ধূমপান = ‘ধূম+পান’?
পত্রপত্রিকার টাটকা খবর, করোনার তাণ্ডব আবার স্পেনের কোনো কোনো অংশে ভীতি ছড়াচ্ছে। এর মধ্যে বিখ্যাত পর্যটন স্পট ক্যানারি আইল্যান্ডও আছে। আটলান্টিকের এই দ্বীপসহ সে দেশের কোথাও কোথাও কড়া অর্ডার জারি হয়েছে, ‘No smoking’ (ধূমপান নিষিদ্ধ)। কারণ, ধূমপানকারীদের কোভিড মহামারীতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। বলা হয়েছে, ‘পারস্পরিক দূরত্ব দু’মিটার ( ৬ ফুটেরও বেশি) রাখা না গেলে সিগ্রেট টানা যাবে না।’ এটা শুনে বাংলাদেশের মানুষ অবাক হয়ে বলতে পারেন, ‘আমাদের এখানে মাস্ক নামিয়ে প্রকাশ্যে ধূমপান চলছে; কই, কর্তৃপক্ষ তো কোনো কড়াকড়ি করছে না। সিগ্রেটের লেজে সুখটানের মজা পেলে স্পেনে এমন আদেশ দেয়া হতো না।’

সত্যিই সেলুকাস! অদ্ভুত এ বাংলাদেশ। ‘শত রঙ্গ ভরা এই ভঙ্গ বঙ্গদেশ’। এ দেশের একটা চুটকি হলো- এক বাসযাত্রী ধূমপানরত ড্রাইভারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন বাসের ভেতরে একটা লেখার দিকে। তা হলো, ‘ধূমপান নিষেধ’। চালক মহোদয় কম চালাক নন। তিনি আরেকটি লেখার দিকে যাত্রীটির দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তা হলো, ‘চলন্ত অবস্থায় চালকের সাথে কথা বলা নিষেধ। করিলে নামাইয়া দেয়া হইবে।’ এতে সচেতন যাত্রীপ্রবর ক্ষুব্ধ হয়ে দু’কথা শুনিয়ে দিলেন। তখন ড্রাইভার গাড়ির কন্ডাক্টরকে ইঙ্গিত দিলেন ‘বেয়াড়া’ ব্যক্তিটিকে নামিয়ে দিতে। গাড়ির এক জায়গায় লেখা আছে, ‘চালক, হেলপার বা কন্ডাক্টরের সাথে অশোভন আচরণ করিবেন না।’ আরেক জায়গায় বড় করে লেখা, ‘ধূমপান করিবেন না।’ ধূম ও পানের মাঝে বিরাট ফাঁক।

‘হরে কৃষ্ণ’ ও ‘হরে রোড’
‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ কথাটার সাথে আমাদের দেশের মানুষ পরিচিত। এটা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি ধর্মীয় ধ্বনি। তবে ‘হরে রোড’ বলে কিছু আছে বলে জানা যায় না। তবুও সম্প্রতি ঢাকার ওয়ারী এলাকার লকডাউন উপলক্ষে সরকারের ঘোষণায় দেখা গেল, যে কয়েকটি রোডের দু’পাশের এলাকায় মহামারী ঠেকাতে এই লকডাউন হচ্ছে, তার মধ্যে আছে ‘হরে রোড’ও। অন্যান্য সড়কের মধ্যে ছিল র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিট ও জয়কালী মন্দির রোডসহ কয়েকটি রাস্তা। মি. র‌্যাঙ্কিন ছিলেন ঊনবিংশ শতকের ঢাকায় একজন বিশিষ্ট ইংরেজ আমলা এবং ওয়ারী ছিল তখন অত্যন্ত অভিজাত আবাসিক এলাকা। সেই ‘র‌্যাঙ্কিন’কে অনেকে এখন বলেন/লিখেন ‘র‌্যাংকিং’। কারণ এ শব্দটা বর্তমানে বহুল প্রচলিত। তবে ওয়ারীর লকডাউন নিয়ে যতটা না করোনা প্রসঙ্গ আলোচিত, ‘হরে রোড’ প্রসঙ্গ নিয়ে এর চেয়ে আলোচনা কম হয়নি বলা চলে।

সরকারের উপসচিব পর্যায়ের জনৈক আমলার স্বাক্ষরে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল। তাকে এই অদ্ভুত নাম ‘হরে রোড’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি কোনো জবাব দিতে না পেরে পাশ কাটিয়ে যান। আসলে আলোচ্য রাস্তার নাম ‘হেয়ার স্ট্রিট’। এটা শুদ্ধরূপে জানার জন্য মহাপণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। তবে যেহেতু আমাদের ‘শিক্ষিতজনদেরও ইতিহাসজ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায় (এবং নেই জানার আগ্রহ), তাই ইংরেজ আমলের Hare সাহেব ‘হেয়ার’ না হয়ে, অনেকের কাছে হয়ে গেলেন ‘হরে’। তারা নিশ্চয়ই ঢাকার মন্ত্রিপাড়ার ‘হেয়ার রোড’ চেনেন। কিন্তু ‘ওয়ারীর ‘হেয়ার স্ট্রিট’ চিনে নেয়ার গরজ বোধ করেন না।

‘তাপসী’ হলেও রেহাই নেই
গত কয়েক মাস বিভিন্ন দেশে লকডাউন ছিল করোনার কারণে। নরম-গরম কিসিমের লকডাউন এখনো কোনো কোনো দেশে চলছে। লকডাউনের সময়ে অনেকে বিদেশে গিয়ে আটকা পড়েছেন কিন্তু নিজের বাড়িঘরে না থাকলে কী হবে, গ্রাহকদের কারো কারো নামে বিদ্যুৎবিল এসেছে স্বাভাবিক সময়ের কয়েক গুণ বেশি। এ অবস্থা কেবল আমাদের বাংলাদেশে নয়, পাশের ভারতেও।

জানা গেছে, ঢাকায় কোনো কোনো বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করেই এবং পরিকল্পনামাফিক বিলের বোঝা চাপিয়েছেন নিরীহ গ্রাহকদের কাঁধে। উদ্দেশ্য, আয় বেশি দেখিয়ে সরকারের আরো প্রিয়ভাজন হওয়া এবং নিজের স্টাফের বেতন-বোনাস-ভাতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। এ নিয়ে জুন মাসেই হইচই শুরু হলে কর্তৃপক্ষ উপায় না দেখে এটা ‘সমন্বয় করা হবে’ বলে আশ্বাস দেন। তবে ভুক্তভোগীরা তাতে কতটা বিশ্বাস রাখতে পারছেন, তা আলাদা ব্যাপার। তখন কিন্তু এই বিল বাড়ানোর তেলেসমাতির তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়নি। এখন সব ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, লকডাউনে আয় বন্ধ; অথচ বিলের বোঝার অবিশ্বাস্য বৃদ্ধি। এটাকেই বলা হয় ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ।’

প্রতিবেশী ভারতেও অনেকটা একই দশা। যেমন, বলিউডের নামকরা নায়িকা পান্নু তাপসী অভিযোগ করলেন, ‘লকডাউনে নিজের বাসায় পর্যন্ত ছিলাম না অথচ সে সময়ের বিদ্যুৎ বিল এসেছে।’ আর তার বিরাট পরিমাণ দেখে চক্ষু চড়কগাছ! এখন কর্তৃপক্ষের কর্তাবাবুরা নানান ধানাই পানাই শুরু করেছেন।
প্রমাণিত হলো, দোষটা কেবল নিচের মিটার রিডারদের নয়; উপরের কর্মকর্তাদেরও। বাংলাদেশ হোক, আর ভারত হোক, উপমহাদেশজুড়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যামো প্রায় অভিন্ন। আর অবস্থা যা দেখা গেছে, পান্নু তাপসী তো বটেই, এ যুগে তাপসী রাবেয়া হলেও বোধ হয় ভুতুড়ে বিল তাকে ছাড়ত না।

নিরাপত্তা না ফ্যাশন?
মাস্ক পরা হলো নিরাপদ থাকার জন্য করোনা সতর্কতার পয়লা শর্ত। বাংলাদেশের অনেকেই মাস্ক পরেন না। অথচ নাকমুখ খোলা রেখেই তা গলায় ঝুলিয়ে রাখেন সাবধানবাণীর তোয়াক্কা না করে। ইদানীং নতুন জেনারেশন ঝুঁকছে আকর্ষণীয় মাস্কের দিকে। আর মওকা বুঝে কিছু ব্যবসায়ী মাস্ক নিয়ে মুনাফা করার ধান্ধায় আছেন। এ জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ফ্যাশনেবল বা কেতাদুরন্ত মাস্ক বিপণন করতে শুরু করেছে। এগুলো কতাটা কাজের, আর কতটা নিছক ফ্যাশন; সে বিতর্ক কিন্তু শেষ হচ্ছে না।

করোনা অতিমারী যে ‘নিউ নরমাল’ তৈরি করছে তাতে রিয়ালিটিও হয়ে যাচ্ছে নিউ বা নতুন। তাই অনেকের বিশ্বাস, বহু দিন চলতে হবে মাস্ক পরে, হ্যান্ডশেক না করে এবং অনেক কিছু না ধরে। এমনকি, যারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখেন না এবং এটা ‘অসামাজিক’ কাজ মনে করেন এবং যারা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মৃত্যুঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত, তারাও মনে করেন- ‘মনমতো একটা মাস্ক কিনে সাথে রাখতে হয়। বলা তো যায় না, কখন কাজে লেগে যায়।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই সেয়ানা হোন, শেষ পর্যন্ত এই মাস্ক ও তার পেয়ারা (প্রিয়) হয়ে গেছে। অতএব, মাস্কের প্রতি মারমুখো থাকা যাবে না চিরদিন।

বাংলাদেশে এক জরিপে জানা গেছে, দেশের ৬৩ শতাংশের মতো মানুষ মাস্ক পরলেও খোদ রাজধানীতে এই হার তার চেয়ে ৯ শতাংশ কম। কথায় বলে, একটা দেশের আন্তর্জাতিক পরিচিতি নির্ভর করে সে দেশের রাজধানীর ওপর। তা হলে, বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক অতিমারীর সময়ে কেমন পরিচিতি অর্জন করেছে? এবার একদিন ঢাকার একটি জনাকীর্ণ স্থানে যানজটে আটকা পড়ে নিজেই জরিপ চালিয়ে দেখলাম, বেশির ভাগ লোকই মাস্ক পরছেন না। কেউ কেউ কানে ঝুলিয়ে রখেন। কারোবা অজুহাত, ‘মাস্ক পরলে দম আটকে আসে।’

মাস্ককে ইদানীং মহামারী থেকে সুরক্ষার সামগ্রী নয়, আর ১০টা ফ্যাশন আইটেমের মতো মনে করে নবীন প্রজন্মের অনেকেই। তাদের পছন্দ রঙচঙা ও আকর্ষণীয় কাপড়ে বানানো মাস্ক। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান চাহিদা মেটাতে ডেনিম দিয়ে জিন্স প্যান্টের পাশাপাশি মাস্ক তৈরি ও বিক্রি করছে। বাজারে এর মধ্যেই নানা ডিজাইনের মাস্ক এসেছে। তবে এগুলো দিয়ে কতটা আসল উদ্দেশ্য পূরণ করা যাচ্ছে, তা নিশ্চিত নয়। এর একটা বড় অংশই নিছক প্যাশন বা ফ্যাশনের পণ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল (সিডিসি) পরিচালক ডা. রবার্ট রেডফিল্ড বলেছেন, ‘কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা হচ্ছে, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ কিংবা এর গতি মন্থর করার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রগুলোর একটি। বিশেষ করে লোকজনের মধ্যে থাকলে এটা করতে হবে।’ বলা নিষ্প্রয়োজন, ‘কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা’র একটা ধরনই ‘মাস্ক’ নামে অভিহিত।

জানা যায়, ১২ বছর বয়স হলেই মাস্ক পরা প্রয়োজন। আর ৬-১১ বছরের শিশুরা যদি ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখতে না পারে, তাহলে তাদেরও পরা উচিত মাস্ক।
চিত্রবিচিত্র ও বর্ণিল মাস্ক বাজারজাত করার একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, ‘আমাদের গ্রাহকরা ম্যাচিং বেশি পছন্দ করে। আমরা জীবাণু, শ্বাসতন্ত্রের ড্রপলেট (ক্ষুদ্র কণা) ও ধূলিবালু থেকে সুরক্ষার জন্য চারস্তরের মাস্ক সরবরাহ করছি। এর দ্বারা যাতে নিরাপদে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালানো যায়, এজন্য বিষমুক্ত কালি দিয়ে এবং অটোম্যাটিক মেশিনে মাস্কটি ছাপানো হচ্ছে।’ এই মাস্কের শেষ স্তরে একটি পকেট থাকে অতিরিক্ত নিরাপত্তার স্বার্থে।

অতএব, বুঝাই যায় করোনা যতই বিশ্বে ভীতি আর উদ্বেগ সঞ্চার করুক, এটা অনেকের জন্য মুনাফা করার মোক্ষম মওসুম।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement