২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ফিরে দেখা : স্বশিক্ষিত ইসলামী অর্থনীতিবিদ

ফিরে দেখা : স্বশিক্ষিত ইসলামী অর্থনীতিবিদ - ছবি : নয়া দিগন্ত

মানুষের আয়ুষ্কাল খুবই ক্ষুদ্র। একজন মানুষ সর্বোচ্চ কত বছরইবা বাঁচে। তবে জীবনের ব্যাপ্তির চেয়ে ব্যক্তির কর্ম তাকে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। চলতি বছরেই আমার কর্মজীবনের ষাট বছর পূর্ণ হলো। যে জীবন শুরু করেছিলাম ১৯৬০ সালে, নিজ জেলা (তখন মহকুমা) সিরাজগঞ্জে, সে সময়ের একমাত্র কলেজে, শিক্ষক হিসেবে। এরপর ক্ষুদ্র এই জীবনে শুধু জন্মভূমির বাইরেই পাঁচ দেশে আটটি চাকরি করেছি। আরো অনেক দেশ থেকে কাজের প্রস্তাব পেয়েও যাইনি নানা বিবেচনায়। ফলে আমেরিকার চূড়ান্ত কসমোপলিটন সমাজ থেকে শুরু করে পাপুয়া নিউগিনির আদিম সমাজ পর্যন্ত, যেখানে এখনো তীর-ধনুক নিয়ে লড়াই হয়, কর্মজীবনের ৩৩টি বছর পার করেছি। বিদেশের চাকরি হিসেবে সর্বশেষ আইডিবির মুখ্য অর্থনীতিবিদের পদ থেকে আগাম অবসর নিয়ে দেশে চলে আসি। কিন্তু সেই অবসরে আর যাওয়া হয়নি। দেশে ফিরে একটি ইসলামী অর্থনীতিভিত্তিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করি, যে স্বপ্ন আমি কর্মজীবনের শুরু থেকেই লালন করে এসেছি। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে বেশ কয়েক বছর সেখানেও সক্রিয় দায়িত্ব পালন করেছি। এরপর, হাউজ অব মান্নান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, সৈয়দা রিজিয়া মেমোরিয়াল হসপিটাল, নার্সিং কলেজ, দ্য গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি অব ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড টেকনোলজি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবতার সেবায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে কিছু উদ্যোগ নিই। এর কতেক বাস্তবায়িত হয়েছে কিছু বাস্তবায়নাধীন। ক্যাশ ওয়াক্ফভিত্তিক ‘ওয়ার্ল্ড সোস্যাল ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠারও স্বপ্ন দেখি আমি। তাই কর্মজীবন বলতে সাধারণভাবে যা বুঝি ঠিক সেরকম কিছু না হলেও নিজের অনেক অসমাপ্ত কাজ গুছিয়ে নেয়ার অদম্য ইচ্ছায় এখনো আমার জীবনে কোনো অবসর সময় আসেনি। তেমন অবসর অবশ্য কামনাও করি না। মানবকল্যাণে, মানুষকে ভালোবেসে আমরণ কাজ করে যাওয়াই জীবনের এই পরন্ত বেলায় আমার ধ্যান-জ্ঞান।

কর্মজীবন শুরু করেছিলাম শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু ছয় দশক পর নিজেকে আজ আবিষ্কার করেছি একজন ছাত্র হিসেবে। জীবনে অনেক কিছুই শেখা হয়নি। অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম। অথচ এত দিনে অর্থনীতির বিস্তীর্ণ সমুদ্রসৈকত থেকে কিছু নুড়ি কুড়াতে পেরেছি কি না সেটিও সন্দেহ হয়। কথিত অবসর জীবনেও আমি ছাত্র। ষাট বছর কর্মজীবন খুব কম মানুষের ভাগ্যেই হয়। এ জীবনের বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে কেটেছে। ফলে বিভিন্ন দেশ, জাতি, সম্প্রদায়, সমাজ, মানুষ সম্পর্কে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। অসংখ্য খ্যাতনামা ব্যক্তির সাথে পরিচয়, সেখান থেকে আন্তরিকতা ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। তাদের সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে আলোকবর্তিকা, জ্ঞানের সাগর। তাদের অনেকে প্রয়াত হয়েছেন।

১৯৬৩ সালে আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারি চাকরিতে (ইপিসিএস) যোগদান করি। এই চাকরিতে থাকা অবস্থাতেই সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসে (সিএসএস) পরীক্ষা দিই এবং পাস করার পর আমাকে চলে যেতে হয় পশ্চিম পাকিস্তানে, যোগ দেই অর্থ মন্ত্রণালয়ে, অ্যাসিসট্যান্ট ফাইন্যান্স অ্যাডভাইজর হিসেবে। সেখান থেকে পাকিস্তান প্লানিং কমিশনের ‘অ্যাসিসট্যান্ট চিফ’ পদে নিয়োগ পাই। তবে মজার ব্যাপার হলো দেশে দরখাস্ত ও পরীক্ষা সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এরপর জীবনে যতগুলো চাকরি করেছি কোথাও দরখাস্ত দিয়ে আমাকে আর চাকরি নিতে হয়নি। আমার সৌভাগ্য বলতে হবে, চাকরিই আমাকে খুঁজে নিয়েছে। আমেরিকায় পিএইচডি করতে গিয়ে রাষ্ট্রহীন অবস্থায় পড়ি। ঠিক ওই সময়টিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে যায়। সরকার আমাকে দেশে তলব করলে আমি ফিরে আসতে অস্বীকার করি। ওই রাষ্ট্রহীন অবস্থায় আমার পিএইচডির তত্ত্বাবধায়কদের সুপারিশে পাপুয়া নিউগিনির ইউনিভার্সিটি অব টেকনলজিতে আমার চাকরি হয়। এরই মাঝে ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে আমেরিকার বাংলাদেশ মিশন থেকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে পাসপোর্ট হাতে পাই। পাপুয়া নিউগিনিতে যখন অধ্যাপনা করছি সেখান থেকে আমাকে খুঁজে বের করে তখনো প্রতিষ্ঠার পথে থাকা ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি)। সেখানে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মিসরের আহমেদ আল নাজ্জার ও তুরস্কের সাবাহতিন জাইমের মতো বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিদের আগ্রহে আমি কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই। আইডিবিতে সাক্ষাৎকারকালে আমি একটি রিসার্চ সেন্টার করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। তারা আমার পরামর্শ নিয়েছিল। ফলে সেই সেন্টার হওয়ার পর সেখান থেকে ডাক আসে যোগদান করার জন্য। কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় বছর এবং আইডিবিতে ১৩ বছর কাটানোর পর দেশে ফিরে আসি এখানে ইসলামিক অর্থনীতি নিয়ে কিছু কাজ করব এই আশায়।

ষাট বছর আগের কথা। যত দূর মনে পড়ে, আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এমএ পরীক্ষা দিয়েছি। তখনো রেজাল্ট হয়নি, আমি রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছি। একদিন রাজবাড়ী কলেজ থেকে যোগদানের জন্য নিয়োগপত্র আসে। এর পরই দেখি সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকেও যোগদানের ডাক পাই। রেজাল্ট হওয়ার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বলা হলো চাইলে আমি অ্যাসিসট্যান্ট লেকচারার হিসেবে যোগ দিতে পারি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া নিয়ে আমার কিছু অভিমান ছিল, সে জন্য সেখানে আর যাইনি। রাজবাড়ীতেও গেলাম না। সিরাজগঞ্জের ছেলে হিসেবে সিরাজগঞ্জ কলেজে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু সেটি ইসলামিক অর্থনীতি ছিল না। যদিও আধুনিককালের ইসলামিক অর্থনীতির ধ্যানধারণা তারও আগ থেকে বিস্তার লাভ করছিল। কিন্তু তখনো ইসলামিক অর্থনীতির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ যেমন ব্যাংক বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বিশ্বের কোথাও ছিল না।

ইসলামী অর্থনীতির ব্যাপারে আমার আগ্রহ সৃষ্টির পেছনে কিছু কাকতালীয় ঘটনা ছিল। আমাদের বাড়িতে তখন দু’টি পত্রিকা রাখা হতো: পাকিস্তান টাইমস বা মর্নিং নিউজ ও দৈনিক আজাদ। এগুলোর একটিও এখন বাংলাদেশে নেই। উপমহাদেশে মুসলিম গণজাগরণ ও মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রামে দৈনিক আজাদের বিশাল ভূমিকা ছিল। আব্বা মুসলিম লীগ করতেন, পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাই আজাদ পত্রিকার ভক্ত ছিলেন। আর আমি ইংরেজি পত্রিকাগুলো পড়তাম। একদিন বিকেলে পত্রিকা পড়ছি। সেটি সম্ভবত পাকিস্তান অবজারভার ছিল। তাতে জাকাতের ওপর একটি আর্টিক্যাল ছাপা হয়েছে। সেখানে জাকাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং জাকাতের অর্থ ব্যয়ের আটটি খাত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে কুরআন পড়া, হাদিস পড়া ইত্যাদির চর্চা ছিল। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কুরআনের তফসির পড়া বা ইসলামের বিষয়ভিত্তিক পড়াশুনা হয়নি। জাকাতের অর্থ ব্যয়ের দু’টি দিক আমাকে আকৃষ্ট করে : দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য এই অর্থ ব্যয় ও যিনি জাকাত সংগ্রহ করবেন তাকে পারিশ্রমিক হিসেবে এই অর্থ থেকে দেয়া যাবে। সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছি, সেখানে পাবলিক ফাইন্যান্স পড়েছি। আমার চিন্তাজগতে উঁকি দিলো- এ তো পাবলিক ফাইন্যান্সের কথা বলছে। তখন বাড়ি এসে আমি ছোট একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম এ বিষয়ে। সেটি কোথায় প্রকাশ হয়েছিল তা আমার মনে নেই। কিন্তু ওই ঘটনায় ইসলামিক অর্থনীতির ব্যাপারে আমার কিছুটা আগ্রহ তৈরি হয়। এমএ ক্লাসে আমরা কেনেসিয়ান ইকোনমিক্স পড়েছি। ১৯৩০-এর দশকে মহামন্দা দেখা দিলো, সারা দুনিয়ায় বেকারত্ব চরমে। তখন লর্ড কেইনস নতুন তত্ত্ব হাজির করে বললেন, মন্দা কাটাতে হলে কর্মসংস্থান করতে হবে। তার জন্য সরকারকে টাকা ছাপানোর পরামর্শ দিলেন এবং খরচ করতে বললেন। রাস্তাঘাট, অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করে কর্মসংস্থান করতে বললেন। অনেকে বলল, এতে মুদ্রাস্ফীতি হবে। তিনি বললেন, কিন্তু কর্মসংস্থানও হবে। একে বলা হয় কেনেসিয়ান বিপ্লব। ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির কথা ছিল ‘আয় বুঝে ব্যয় করো’। অর্থনীতিকে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত এটাই ছিল অর্থনীতির মূল তত্ত্ব। কেইনস বললেন, ভারসাম্যের কথা ভুলে যাও।

কেইনসের এই ‘শূন্য ধারণা’ আমার চিন্তাজগতে আঘাত করে। এই শুরু হলো ইসলামিক অর্থনীতি নিয়ে আমার ভাবনা। ইসলাম সুদকে হারাম করেছে, ব্যবসাকে হালাল করেছে। আমি দেখি ইসলামী অর্থনীতির সাথে কেইনসের এই ধারণা মিলে যায়। অর্থনীতিকে সঠিক পথে চালিত করতে হলে সুদের হার যে শূন্য করতে হবে সেটি আজকের করোনাকালেও সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তাই আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার শূন্য করে দিয়েছে। আমাদের সরকার সুদের হার কমিয়েছে। এর কারণ হলো উদ্যোক্তারা যেন বিনিয়োগ করে। শূন্য সুদের প্রস্তাবে যখন প্রশ্ন উঠল তাহলে কেউ কেন বিনিয়োগ করবে। তখন দেয়া হলো অংশীদারিত্বের ধারণা। বলা হলো লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করার কথা। আমি বিস্ময়ের সাথে দেখি, কেইনস তো ইসলামিক অর্থনীতির কথাই বলেছেন। এরপর আমি গোগ্রাসে ইসলামী বইপত্র পড়া শুরু করি। বাড়িতেও সেই পরিবেশ ছিল। ইসলামিক অর্থনীতির ওপর আমার কোনো ডিগ্রি নেই। এর পরও এই বিষয়ের ওপর আমি লিখেছি। কিছু বুঝেছি। কিছু মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এখান থেকে একটি বিষয় শিখেছি, কেউ যদি স্বেচ্ছায় জানার জন্য পড়াশোনা করে তাহলে তার জ্ঞান অর্জন হতে পারে। শুধু পাসের জন্য পড়াশোনা করলে জ্ঞানার্জন হয় না।

আমি সিরাজগঞ্জ কলেজে যোগ দিই ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে। তখন কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সারা দেশে শিক্ষাবিদদের বিভিন্ন থিমের ওপর লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। ২৭ বা ২৮টি বিষয় দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল সুদমুক্ত ব্যাংকিং। আমি এই বিষয়টি বেছে নিই। আমি এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখি এবং সেটি একটি সেমিনারে উপস্থাপন করি। আমার লেখাটির ব্যাপারে তখন বেশ ইতিবাচক সাড়া পাই। সরকারের পক্ষ থেকে প্রশংসাপত্র পাই। আগেই বলেছি, কলেজে অধ্যাপনা অবস্থাতেই ইপিসিএস পরীক্ষায় পাস করে সরকারি চাকরিতে যোগ দিই। পরে সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাই। কিন্তু আমার পড়াশোনা করার অভ্যাসটি বজায় ছিল। সবাই কাজ শেষে বাড়ি চলে যেত। আমি তখন থেকে যেতাম লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করার জন্য। আমি সিরাজগঞ্জর সেমিনারে পাঠ করার জন্য যে সুদমুক্ত ব্যাংকিংয়ের ওপর নিবন্ধটি লিখেছিলাম সেটি কিছুটা সংশোধন করে পাকিস্তান টাইমসে পাঠিয়েছিলাম। তখন পাকিস্তান টাইমসের প্রখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন জেডএ সুলেরি (জিয়াউদ্দিন আহমেদ সুলেরি)।

তিনি এমন মাপের সাংবাদিক ছিলেন যে, তার কলম দিয়ে যে লেখা বের হতো সেটি হতো রাষ্ট্রের নীতি। তিনি উপসম্পাদকীয় বিভাগটি দেখতেন। সরকারের বিভিন্ন দফতর এই পত্রিকার কাটিং রাখাত। আইয়ুব খানের কাছে পত্রিকাটির কাটিং যেত। ফলে অনেকেই এই বিভাগে লিখতে আগ্রহী ছিল। যা হোক কয়েক দিন পরে দেখি পত্রিকার ওই বিভাগে পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে আমার নিবন্ধটি ছাপা হয়েছে। তাতে আমি যেসব গ্রাফ দিয়েছিলাম সেগুলোও আছে সেখানে। পত্রিকা খুলে নিজের নাম দেখে আনন্দে আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম। সেদিন আমি যে আনন্দ পেয়েছিলাম এই এত বছর পরও তা আমি অনুভব করি। কয়েক দিন পরে দেখি একটি খামে আমার নামে চার শ’ বিশ রুপির একটি চেক এসেছে। তখনকার দিনে এটা অনেক টাকা। সাথে একটি চিঠিও ছিল। তাতে আমাকে এ ধরনের আরো লেখা দিতে বলা হয়। সেই চিঠিটি সংরক্ষণ করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু কর্মজীবনে এত জায়গায় ঘুরতে হয়েছে যে, সেটি কোথায় কখন হারিয়ে গেছে জানি না। সেই শুরু হলো ইসলামী অর্থনীতি নিয়ে আমার অধ্যয়ন। এরপর আমি ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করি।

পড়শোনা করার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে আমার ধারণা গড়ে উঠতে থাকে। তখনই আমার মনে হতে থাকে যে, ইসলামিক আর্থ-সামাজিক মূল্যবোধকে আধুনিক ভাষায় লেখা যেতে পারে এবং ইসলামিক অর্থব্যবস্থাকে বিজ্ঞানভিত্তিক রূপ দিয়ে উপস্থাপন করা যায়। ইসলামাবাদে ছিলাম ১৯৬৫-৭০ সাল পর্যন্ত। তখন ইসলামী অর্থনীতির বিভিন্ন দিকের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে শুধু পাকিস্তান টাইমস নয়, আরো অনেক পত্রিকা ও জার্নালে লিখেছি। ওই সব লেখা সঙ্কলন করে ১৯৭০ সালে আশরাফ পাবলিকেশন্স থেকে ইসলামিক অর্থনীতির ওপর আমার প্রথম বই ‘ইসলামিক ইকোনমিক্স : থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস’ প্রকাশিত হয়। যেটা ছিল বিশ্বে ইসলামিক অর্থনীতির ওপর প্রথম পাঠ্যবই। ওই সময় পর্যন্ত বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে পড়ানো হতো বলে জানতে পারিনি। আশরাফ পাবলিকেশন্স বইটি পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড-এ উপস্থাপন করে। তখন জুরি বোর্ড একে অর্থনীতিতে ‘বেস্ট বুক অব দ্য ইয়ার’ মনোনীতি ও পুরস্কৃত করে।

যখন এ ঘটনা ঘটে তখন আমি পিএইচডি করার জন্য আমেরিকায়। আমি বইটিতে ইসলামিক অর্থনীতির ব্যাপারে বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, যার অনেকটা সত্য হয়। আমি বলেছিলাম, পাকিস্তানে ইসলামিক ব্যাংকিং চালু হতে আরো অন্তত ২০ বছর লাগবে। ইসলামিক বিশ্বব্যাংক হতে লাগবে ১০ বছর। অবিশ্বাস্য হলেও ১৯৮৫ সালে পাকিস্তান প্রথম ইসলামিক ব্যাংকিং অর্ডন্যান্স পাস করে। আমি লেখায় ইসলামিক ওয়ার্ল্ড ব্যাংক করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম ১৯৬৮ সালে। আরো বলেছিলাম, এর সদর দফতর সৌদি আরবে হওয়া উচিত। ঠিকই ১৯৭৫ সালে জেদ্দায় সদর দফতর স্থাপনের মধ্য দিয়ে ইলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) যাত্রা শুরু হয়। ওআইসি প্রতিষ্ঠার আগেই আমি বলেছিলাম যে, নব্য স্বাধীন মুসলিম দেশগুলোসহ মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কথা বলার জন্য একটি প্লাটফর্ম হওয়া দরকার। সেটির সদর দফতর সৌদি আরবে থাকতে হবে বলেও যুক্তি দিয়েছিলাম। পরে ঠিক তাই হয়েছিল।

সম্ভবত রাইটার্স গিল্টের পুরস্কারপ্রাপ্তির পর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় আমার বইটি অনুবাদ শুরু হয়। আরবি, তুর্কি, জার্মান, হাওজা, বাহাসা মালয়েশিয়া, বাহাসা ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয়। মিশিগানে থাকাকালে আমি জানতে পারি যে, আমার বইটি রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাঞ্চেলর অনুবাদ করেছেন। এই বইয়ের সুবাদেই আইডিবি আমাকে খুঁজে বের করেছিল তাদের সাথে কাজ করার জন্য। অনেকটা বইটির কারণেই কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে আমার যোগদান করা হয়।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আমার পিএইচডির বিষয় ছিল ‘ইকোনমিকস অব ননফরমাল এডুকেশন অন দ্য জবস ট্রেড’। এটা অর্থনীতির বিষয় হলেও এর সাথে ইসলামিক অর্থনীতির কোনো যোগ ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইসলামিক অর্থনীতিই হয়ে পড়ে আমার ধ্যান-জ্ঞান। আর মানবতার জন্য অশেষ কল্যাণকর ইসলামিক অর্থনীতির চেতনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া আমার স্বপ্নে পরিণত হয়।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement