করোনা : ব্যর্থতায় ও সাফল্যের গান
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ১৮ আগস্ট ২০২০, ১৯:০২
কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ে দেশে একের পর এক নানা কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ ও মন্ত্রণালয়। ভাইরাস প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য প্রায় তিন মাস সময় পেয়েছিল তারা। ওই পুরো সময়ই তারা কাটিয়েছে পুরোপুরি হাত গুটিয়ে। আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী এরকম ‘হামবড়া’ ভাব নিয়ে নিষ্ক্রিয় বসে থাকার পর যখন সংক্রমণ শুরু হলো তখন তারা নড়েচড়ে বসলেন। কিন্তু ওই নড়াচড়া পর্যন্তই।
সমস্যা মোকাবেলায় প্রাথমিক যে কাজ পরিকল্পনা গ্রহণ ও কর্মকৌশল প্রণয়ন সেটি গত আট মাসেও তারা করতে পারেননি। বিস্ময়কর হলেও এটি সত্য। তারা বরং মহামারী নিয়েও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেছেন। ফেসমাস্ক ও পিপিই সংগ্রহে দুর্নীতি করেছেন, অনিয়ম করেছেন এবং জনস্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে ভুয়া হাসপাতালকে করোনা টেস্টের জন্য অনুমোদন দিয়েছেন। এ সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধ ও ভুয়া টেস্ট দেখিয়ে, ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে জনগণের পকেট কেটে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অবৈধ হাসপাতাল মালিক ও কতিপয় ডাক্তার। এই ভুয়া হাসপাতাল ও পরীক্ষা কেন্দ্রের সাথে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে বিশ্বমিডিয়ায়। দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংস করে তারা নিজেদের আখের গুছিয়েছেন- এ কথা বললে বাড়িয়ে বলা হবে বলে মনে হয় না।
এতসব কেলেঙ্কারির পরও দলের মন্ত্রী এবং দলবাজ মিডিয়ার কণ্ঠ এতটুকু নরম হয়নি। পৌনে তিন লাখ সংক্রমিত রোগী এবং সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু ছাড়াও দেশের সুনাম ক্ষুণœ করার জন্য যাদের নিষ্ক্রিয়তা, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং আখের গোছানোর ধান্ধা দায়ী, তারা এখন বলছেন, আমাদের নির্দেশনা অনুযায়ী ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করেছেন বলেই দেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা কমছে। ‘দালাল মিডিয়া’ও ক’দিন পরপর সুর মিলিয়ে সরকারের কথিত সাফল্যের আজগুবি কাহিনী প্রচার করে চলেছে। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, ‘করোনাভাইরাস দূর করতে ভ্যাকসিনের দরকার হবে না। আপনাআপনিই ভাইরাসটি দেশ থেকে চলে যাবে।’ তিনি কোভিডে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা ‘কমেছে’ বলে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বিশ্বের দেশে দেশে সরকারগুলো সবার আগে করোনার ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য সম্ভাব্য ভ্যাকসিন আবিষ্কারক দেশের সঙ্গে চুক্তি করছে। তারা বিপুল পরিমাণে ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য আগাম অর্ডার পর্যন্ত দিয়ে রাখছে। ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রা-জেনেকা অক্সফোর্ডের সম্ভাব্য কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্রিটেনের বাইরে আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকোও উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলো লাতিন আমেরিকার বেশির ভাগ দেশে সরবরাহ করা হবে। ভ্যাকসিনের ১০ কোটি ডোজ পাওয়ার জন্য অ্যাস্ট্রা-জেনেকার সাথে চুক্তি করেছে ব্রাজিল। মেক্সিকোও এরই মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ইউরোপিয়ান কমিশনও প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন নেবে। রাশিয়ার ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল টেস্ট হতে না হতেই প্রেসিডেন্ট পুতিন সেটির অনুমোদন দেয়ায় এটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে সংশয় থাকলেও সেটি কার্যকর হতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন। এ ছাড়া করোনা প্রতিরোধে চীনের ভ্যাকসিনও রয়েছে সাফল্যের প্রান্তে। তাদের ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত টেস্টের কাজ পুরোদমে চলছে। সম্প্রতি সৌদি আরবে এর তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চালাচ্ছে চীন। রাশিয়ার পর চীনও তাদের ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু তারও আগে ভিয়েতনাম চুক্তি করেছে চীনের ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী করছে? বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য বিভাগ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। মন্ত্রী উল্টো বলছেন, ‘ভ্যাকসিনের দরকারই হবে না। আপনাআপনি চলে যাবে।’ তবে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশের সাফল্য কতটুকু? আশপাশের দেশগুলোর পরিসংখ্যানের সাথে তুলনা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বেশ দেরিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হলেও তথ্য-উপাত্ত বলছে, কম সময়ে বাংলাদেশেই এর সংক্রমণ ছড়িয়েছে সবচেয়ে বেশি। দেশে ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কম বলার সুযোগ নেই। কারণ, জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশে আক্রান্তের হার ভারতের প্রায় দ্বিগুণ এবং পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য দেশের চেয়ে পরীক্ষাও অনেক কম করেছে বাংলাদেশ। তার পরও সংক্রমণ শনাক্তের হার অন্য দেশগুলোর চেয়ে বেশি। সংক্রমণ কমাতে শুরু থেকেই পরীক্ষা, আইসোলেশন, কন্টাক্ট ট্রেসিং (আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা) এবং লকডাউনের কার্যক্রম বাংলাদেশে ছিল খুব দুর্বল। স্বাস্থ্য বিভাগ, মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর কাজে শৃঙ্খলা ও সমন্বয় নেই। মাঝে পরীক্ষা সামান্য বাড়ানো হলেও এখন সেটা আবার কমে যাচ্ছে। আইসোলেশন, কন্টাক্ট ট্রেসিং একেবারেই হচ্ছে না।
‘ওয়ার্ল্ডোমিটারস’ নামের একটি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশের চেয়ে আক্রান্তের হার বেশি কেবল মালদ্বীপে। ভারতে আক্রান্তের হার প্রতি ১০ লাখে ৭৫৪। পাকিস্তানে এক হাজার ১৮৫। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে আক্রান্তের হার এক হাজারের নিচে।
এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের ‘সাফল্যের চিত্র’। আটটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে নিচের দিকে থেকেও মন্ত্রী ও ‘অনুগত মিডিয়া’ যে সাফল্যের গান শোনাচ্ছেন, তারও ভেতরের ছবিটা দেখে নেয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেদিন বললেন, করোনার ভ্যাকসিন আসুক বা না আসুক কোভিড-১৯ বাংলাদেশ থেকে এমনিতেই চলে যাবে, ঠিক তার আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় সংক্রমণের হার ছিল ২০ দশমিক ৫১ শতাংশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী যা খুবই বিপজ্জনক মাত্রা। ওই সময়ে ১২ হাজার ৮৯১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন দুই হাজার ৬৪৪ জন। মারা যান ৩৪ জন। এর আগের ২৪ ঘণ্টায়ও মারা যান ৪৪ জন। তার আগের ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল ৪০-এর উপরে। আর টেস্ট কমিয়ে দিয়ে শনাক্তের হার কম দেখানোর অভিযোগ তো আছেই। কিন্তু করোনায় সংক্রমণের হার এখনো ২০ শতাংশের উপরেই রয়ে গেছে।
মন্ত্রী কোন তথ্য-উপাত্ত বা গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে বক্তব্য রেখেছেন, তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে মন্ত্রীর বক্তব্যের যথার্থতা ও বাস্তবতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
মন্ত্রীর ওই বক্তব্যের বিষয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকের পক্ষ থেকে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা: এ বি এম আবদুল্লাহ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা: মোজাহেরুল হকের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়। অধ্যাপক ডা: এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এমনিতে কিভাবে করোনা চলে যাবে, তা বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় না এমনিতেই যাবে। ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানা, সচেতন থাকা, এগুলো তো করতেই হবে। একমাত্র ভ্যাকসিন যদি আসে, সবাইকে দিতে পারলে হয়তো সুরক্ষা হবে। আমাদের জন্য ভ্যাকসিন অবশ্যই দরকার।
অন্য দিকে অধ্যাপক ডা: মোজাহেরুল হক বলেন, মন্ত্রীর বক্তব্য রাজনৈতিক। বিজ্ঞানের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞান বলছে, বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে এবং মৃত্যুও হচ্ছে। ডব্লিউএইচও’র মতে, যেসব দেশে করোনা সংক্রমণের হার বেশি, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সুতরাং আমাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সঠিক কৌশল ও পরিকল্পনা দরকার, যেটা বাংলাদেশে প্রথম থেকেই ছিল না এবং এখনো নেই।
বিশেষজ্ঞদের এ মন্তব্যের পর আর কিছু বলার থাকে বলে আমরা মনে করি না। শুধু বলতে পারি, মন্ত্রীর বক্তব্য দেশ ও জনগণের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ তার বক্তব্যের পর সরকারিভাবে করোনার টেস্ট উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কমে গেছে। গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, করোনা পরীক্ষার কেন্দ্রে নমুনা দিতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন সন্দেহভাজন আক্রান্তরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মোট করোনা পরীক্ষার সংখ্যাও বাড়ছে না। সংক্রমণ যখন বাড়ছে, তখন নানা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এ পরীক্ষার সংখ্যা কমানো হচ্ছে। লকডাউন পুরোপুরি উঠে গেছে। মানুষ মাস্ক না পরেই অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মেলামেশা করছে এবং গণপরিবহনে যাতায়াত করছে।
সারা দেশে মানুষ করোনার ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়েছে। অনেক সন্দেহভাজন ব্যক্তি টেস্ট করানোর ব্যাপারেও আগ্রহী হচ্ছে না। কিন্তু এর একটি বিপজ্জনক পরিণতি ঘটার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিশ্বের অনেক দেশে নতুন করে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে। ইউরোপের মতো উন্নত বিশ্বের ইতালি, ফ্রান্স ছাড়াও নিউজিল্যান্ডে দ্বিতীয় দফায় করোনা সংক্রমণের খবর এসেছে। তারা আবারো লকডাউন ইত্যাদি ব্যবস্থা নিচ্ছে। বাংলাদেশে প্রথম দফার আক্রমণই রোধ করতে পারা যায়নি। সেখানে দ্বিতীয় অভিঘাতের প্রশ্ন নেই। কিন্তু চলমান পরিস্থিতির যে আরো অবনতি ঘটবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। চরম ব্যর্থতার মধ্যেও সাফল্যের গান শোনানো মন্ত্রী কি সে অবনতির দায়িত্ব নেবেন?
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা