২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

যৌতুক নিরসনে সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন

যৌতুক নিরসনে সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন - ছবি : নয়া দিগন্ত

যৌতুক কী সে সম্পর্কে একটি তাত্ত্বিক আলোচনা প্রথমে করা দরকার। ড. হাম্মুদাহ আবদাল আতি তার বিখ্যাত ইসলামের পারিবারিক সংগঠন বইয়ের একটি অধ্যায়ে এ আলোচনা করেছেন। সেটি তিনি সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের আলোকে করেছেন।

তিনি সেখানে বলেছেন যে, ইতিহাসে এটি ছিল কনের মূল্য। এটি বরপক্ষ দিত কন্যাপক্ষকে; কন্যাকে নয়। কেননা কন্যাপক্ষ তাদের একজন সদস্যকে হারাচ্ছে। তাদের একজন সদস্য অন্য পরিবারে, গোত্রে বা সমাজে চলে যাচ্ছে- এটি তাদের নিট ক্ষতি। সুতরাং এর একটি ক্ষতিপূরণ তাদের দিতে হবে। সে ক্ষতিপূরণের জন্য বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে কিছু দিত। এটি ছিল একধরনের ক্ষতিপূরণ এবং একধরনের মূল্য। এটি ছিল কন্যার মূল্য এবং কন্যাপক্ষকে একধরনের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা।

দেখার বিষয় হচ্ছে, ইসলামের যে মোহর সেটি যৌতুক কি না। যে সংজ্ঞা দেখানো হলো, তার আলোকেও বিবেচনা করে দেখা হবে। এটি আসলে যৌতুক নয়। এর প্রথম কারণ হলো, এটি কন্যাপক্ষকে দেয়া হচ্ছে না। কন্যা হারানোর জন্য পাত্রপক্ষ কন্যাপক্ষকে এটি দিচ্ছে না। এটিই হচ্ছে এর তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য। এর মালিক কন্যার পরিবারের পরিবর্তে কন্যা নিজে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিতে একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা ড. হাম্মুদাহ আবদাল আতি সে বইতে উল্লেখ করেছেন। তাতে তিনি আরো দেখাচ্ছেন, অতীতে ইসলামের ইতিহাসে বা ইসলামী সাহিত্যে এরকম মতামত আছে যে, এটিও একধরনের মূল্য। সেটি হচ্ছে, কন্যাকে যে সম্ভোগ করা হচ্ছে তার মূল্য। এ কথা কেউ কেউ বলেছেন। তবে ড. আতি এ মতকে কুরআনের এবং ইসলামের শিক্ষার আলোকে বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটি কখনোই কন্যা সম্ভোগের মূল্য হতে পারে না। কেননা এ সম্ভোগ একতরফা নয়। যদি এটা একতরফা হতো তাহলে একজন আরেকজনকে তার মূল্য দিচ্ছে- এ কথাটি বলা যেত। সুতরাং ইসলামের ইতিহাসে এরকম যে একটি মত আছে সেটিকে তিনি ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছেন। তিনি বলেছেন, যদি এটি কোনোই মূল্য না হয় তাহলে এটি কী? তিনি এটিকে ‘বিয়ের উপহার’ বলে উল্লেখ করেছেন। এতে একটি ছেলে যে মেয়েকে বিয়ে করছে, তাকে দিচ্ছে। তিনি এ প্রসঙ্গে সূরা নিসার ৪ নং আয়াত উল্লেখ করেছেন।

‘ওয়াআতুন নিসায়া সাদাকাতে হিন্না’; অর্থাৎ তোমরা স্বেচ্ছাকৃতভাবে তোমাদের স্ত্রীদের উপহার দাও। এ দেয়াকে কুরআনে সাদাকা শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। এটিই কুরআনের মূল পরিভাষা। অন্য যেসব শব্দ কুরআনে ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যেও গিফটের বা উপহারের অর্থ রয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে আমরা যৌতুকের প্রকৃতি সম্পর্কে দেখতে পেলাম। হাম্মুদাহ আবদাল আতি এ কথাগুলো স্পষ্ট করে বলে মূল্যবান একটি কাজ করেছেন।

বাংলাদেশে যৌতুক সামাজিক ব্যাধির রূপ ধারণ করেছে। এ সম্পর্কে কোনো বিতর্ক আছে বলে আমাদের জানা নেই। যৌতুকের নামে যা নেয়া হচ্ছে তা একটি সামাজিক ব্যাধি। এটি ইসলামসম্মত নয়। এ বিষয়ে কোনো মতবিরোধ নেই। যৌতুক সংক্রান্ত যত আইন আমাদের দেশে করা হয়েছে তা যথার্থ। এটা ভালো হয়েছে। এসব আইনের মধ্যে তেমন কোনো ত্রুটি আছে বলে আমার জানা নেই। যেসব আইনের উন্নয়ন সম্ভব সেটি একটি স্টাডির বিষয়। গবেষণার বিষয় যে, এ আইনের আর কী উন্নয়ন করা সম্ভব? কিন্তু এ আইনের কারণে বা আইন নেই বলে যৌতুক দূর হচ্ছে না, এ কথা বলা সঠিক হবে না। সরকারি তরফ থেকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, যৌতুক যদি দূর করতে হয় তার জন্য আমাদের কী করা প্রয়োজন? নিশ্চয় বলব, বর্তমান আইনকে কার্যকর করা দরকার। অন্যান্য যেসব ব্যবস্থা সরকার নেয় বা নিচ্ছে তা-ও নিতে হবে। পাশাপাশি, জনগণকে আরো বেশি সচেতন করে তোলার প্রয়াসে যৌতুকবিরোধী কার্যকর প্রচার অব্যাহত রাখতে হবে। এ কাজটি আমাদের করতেই হবে। যৌতুকের অভিশাপ থেকে জাতিকে বাঁচানোর জন্য আমাদের একটি বড় ধরনের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে শিগগিরই।

কয়েক বছর আগে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে যোগদান করি। ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তারা অনেকে নানা ধরনের প্রস্তাব দিলেন। আমি একটি প্রস্তাব রেখেছিলাম। সেটি হচ্ছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় যদি যৌতুকবিরোধী একটি সপ্তাহ আগামী কয়েক বছর ধরে পালন করে, তাহলে সমস্যা কমে যাবে। যত দিন পর্যন্ত সমস্যাটি বড় আকারে আছে তত দিন পর্যন্ত আমরা শুধু একটি দিবস পালন না করে যদি প্রতি বছর একটি সপ্তাহব্যাপী যৌতুকবিরোধী কর্মসূচি পালন করি তাহলে ভালো হবে। এটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় করতে পারে। সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানে ওয়াজ মাহফিল, সেমিনার, উন্মুক্ত আলোচনা সভা এবং ইমাম, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের জড়িত করা যেতে পারে।

আমরা মনে করি আইন যথেষ্ট। কিন্তু দরকার হচ্ছে আইনের সঠিক প্রয়োগ। সেটিকে সামাজিক আন্দোলন ধরে নিতে হবে। এ ব্যাপারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বড় বড় এনজিও এবং ইসলামী সংগঠনগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের বিশিষ্ট আলেম-ওলামা যৌতুকের বিরুদ্ধে জুমায় কিংবা ওয়াজ মাহফিলে আলোচনা করতে পারেন। দেশের সংবাদপত্রগুলো যৌতুকবিরোধী দিবস উপলক্ষে এ বিষয়ে লেখা প্রকাশের উদ্যোগ নিতে পারে। যৌতুক বাংলাদেশের বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। আমি মনে করি, এটিকে সহনীয় পর্যায়ে আনার জন্য সবার সম্মিলিত জোরালো সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।


আরো সংবাদ



premium cement
নাটোরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে যুবকের আত্মহত্যা জনগণের ভোটে নির্বাচিতদের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করব : ধর্ম উপদেষ্টা ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্টে ভাঙল ৭২ বছরের রেকর্ড তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগে ৯ জন নিষিদ্ধ সিদ্ধিরগঞ্জে শেখ হাসিনাসহ ৬১ জনের নামে হত্যাচেষ্টা মামলা সাকিবের ২ উইকেট শিকারের ম্যাচে হারল বাংলা টাইগার্স ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও জামায়াত নেতারা মাথা নত করেননি : রফিকুল ইসলাম অ্যাটর্নি জেনারেল পদে এক নারীকে বেছে নিলেন ট্রাম্প গণহত্যার দায়ে আ.লীগের বিচার করতে হবে : অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন কাজে আসেনি কর্ণফুলী টানেল : উপদেষ্টা জুরাইনে রিকশাচালকদের অবরোধ, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ

সকল