২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কি কোভিডের ওষুধ?

- ছবি : নয়া দিগন্ত

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগে থেকেই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কোভিড চিকিৎসায় ব্যবহারের পক্ষপাতী নয়। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিলসহ কিছু রাষ্ট্র করোনা মহামারীর চিকিৎসার জন্য ম্যালেরিয়ার ওষুধটি প্রয়োগ করতে যেন জেদ ধরেছে। গত ২৫ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড চিকিৎসায় এর ব্যবহার আপাতত বন্ধ রাখতে বলেছে। তবে ভারত হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার ‘সিদ্ধান্ত বদলাবে না’ বলে জানা গেছে। ভারত এ ওষুধ কোভিড চিকিৎসায় নিজে ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলাদেশকে এর ২০ লাখ ট্যাবলেট দেয়ার কথা এপ্রিলের প্রথমার্ধেই জানিয়েছিল। ভারতের সংবাদমাধ্যমের মতে, এটা করোনা চিকিৎসায় ‘কিছুটা’ কার্যকর বলে প্রতীয়মান।

এপ্রিলের ১৩ তারিখে ঢাকার কোনো কোনো পত্রিকা জানায়, বাংলাদেশসহ ১৩টি রাষ্ট্রকে ভারত এ ওষুধ দিতে যাচ্ছে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, স্পেন, জার্মানি, বাহরাইন, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান প্রভৃতি। এদিকে ভারতের কাছে যুক্তরাষ্ট্র ৪৮ লাখ এইচসিকিউ অর্থাৎ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেট চেয়েছিল। এ জন্য নাকি খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। এর পরই ভারত তড়িঘড়ি করে ৩৫ লাখ ট্যাবলেট আমেরিকাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমেরিকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এর অনুমতি প্রত্যাহার করেছে।

এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে জানা যায়, এইচসিকিউ ওষুধের কিংবা এর উপাদানের রফতানির ওপর থেকে বাংলাদেশ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে এবং কোনো কোনো দেশ বাংলাদেশের কাছে তা চেয়েছে। বাংলাদেশের প্রবীণ ও প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এ কিউ এম বদরুদোজা চৌধুরী একটি পত্রিকাকে বলেছেন, ‘করোনা সংক্রমণ চিকিৎসার কোনো প্রমাণিত ওষুধ এখনো পাওয়া যায়নি।’ তদুপরি, অচিকিৎসক মার্কিন প্রেসিডেন্টের পরামর্শমাফিক এ ওষুধ সেবন করে কোনো কোনো কোভিড রোগীর প্রাণহানির দুঃসংবাদও শোনা গেছে। তাই জনমনে এইচসিকিউ নিয়ে উদ্বেগ ও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।

প্রশ্ন দাঁড়ায়, যে ওষুধ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দৃষ্টিতে আপত্তিকর এবং যা কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য স্বীকৃত ও অনুমোদিত নয়, যা ট্রায়ালের পর্যায়ে রয়েছে, তা ব্যবহার করে কারো ক্ষতি হয়ে গেলে এর দায় নেবেন কে বা কারা? এ ব্যাপারে কোনো রাষ্ট্রের সরকারের বিশেষ উৎসাহ থাকা যুক্তিসঙ্গত বলা চলে কি?

গত ১৮ এপ্রিল দৈনিক পত্রিকার খবর, বাংলাদেশ সরকারকে ফ্রি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ওষুধ দিয়েছে একটি দেশীয় ওষুধ কোম্পানি। সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মাধ্যমে এবং অনুদান হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে দুই লাখ এক হাজার ৬০০ পিস ট্যাবলেট হস্তান্তর করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ‘কোভিড-১৯’-এর মতো এতবড় সঙ্কট মোকাবেলা যেকোনো দেশের সরকারের একার পক্ষে কঠিন। এ উপলব্ধি থেকেই ওষুধটি দেয়া হয়েছে।’ ঢাকার সিএমএইচকেও এক লাখ হাইড্রক্সিকো¬রোকুইন অনুদান দিয়েছে একই প্রতিষ্ঠান। ২০ এপ্রিল পত্রিকার খবর, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পত্র দিয়েছে মালয়েশিয়া। এর মাধ্যমে হাইড্রোক্লোরোকুইন চাওয়া হয়েছে। সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পত্রটি লিখেছেন। জানা গেছে, পরে বাংলাদেশ সে মোতাবেক ওষুধটি পাঠিয়েছে মালয়েশিয়াকে।

৯ মে ওয়াশিংটন থেকে এএফপি পরিবেশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের দৃশ্যত কোনো উপকার বা অপকার নেই।’ এতে জানানো হয়, ‘নিউ ইয়র্কের হাসপাতালগুলোতে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছেÑ ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন যদি মারাত্মকভাবে অসুস্থ, করোনাভাইরাস রোগীদের ওপর প্রয়োগ করা হয়, তাতে লাভ ক্ষতি কোনোটাই হয় না। যারা এ ওষুধ সেবন করেন আর যারা করেন না, উভয় ক্ষেত্রে করোনা রোগীর অবস্থা থাকে একই।’ ৭ মে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল মেডিসিনে এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়। এর গবেষকরা বলেন, ‘ব্যাপকভিত্তিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কার্যকর বলে প্রমাণিত হওয়া পর্যন্ত ওষুধটির প্রয়োগ করোনার ক্ষেত্রে সমর্থন করা যায় না।’ অথচ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় সময়ে প্রচার করেছেন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন হচ্ছে কোভিড-১৯ চিকিৎসার একটি ওষুধ।

উপরোক্ত গবেষণাকর্ম বা জরিপটি সম্পন্ন হয়েছে ৮১১ জন রোগীর মাধ্যমে। প্রথম দিনে তাদের দেয়া হয় ৬০০ মিলিগ্রাম হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। এরপর ৪০০ মিলিগ্রাম করে এ ওষুধ চার দিন ধরে দেয়া হয়েছে। অন্য ৫৬৫ জন রোগীকে ওষুধটি দেয়া হয়নি। তারপর রোগীদের উভয় গ্রুপের অবস্থার তুলনা করা হয়। খোদ মার্কিন খাদ্য এবং ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ (এফডিএ) ট্রায়াল ছাড়া এর ব্যবহারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। কানাডা ও ইউরোপেও একই সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে।

ক্লোরোকুইন ওষুধটি সম্পর্কে জানা গেছে, এটি মূলত ম্যালেরিয়ার দাওয়াই হিসেবে স্বীকৃত। অন্য নাম ক্লোরোকুইন ফসফেট। ‘আরালেন’সহ একাধিক ব্র্যান্ড নেম আছে ওষুধটির। জটিল ম্যালেরিয়া মহামারীর জ্বর ও ব্যথা কমানো ছাড়াও অ্যামিবাঘটিত ব্যাধির চিকিৎসার্থেও এই ওষুধের ব্যবহার প্রচলিত। এ ছাড়া আন্ত্রিক ব্যাধি এবং বাতজনিত আর্থ্রাইটিস রোগের প্রতিকারের জন্যও খাওয়ানো হয় ক্লোরোকুইন ট্যাবলেট। ওষুধটির রাসায়নিক সূত্র হলো, C18H26CIN3। 

এখন পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি যে, ক্লোরোকুইন কোভিড-১৯ মহামারীর একটি কার্যকর প্রতিরোধক বা প্রতিষেধক। এ নিয়ে গবেষণা চলছে কয়েক দেশে। অনেকের প্রত্যাশা, ক্লোরোকুইন করোনাভাইরাস ঠেকাতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর ব্যবহার যথাযথ প্রেসক্রিপশনের ওপর নির্ভর করে। সম্প্রতি স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর প্রেসক্রিপশন দিয়ে কোনো কোনো করোনা রোগীর ‘মৃত্যুর পথ সুগম করেছেন’ বলে অভিযোগ। তা নিয়ে বিতর্ক করা গেলেও এটা অবিতর্কিত যে, ক্লোরোকুইন নিয়ে উঠেপড়ে লেগে তিনি পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের ক্ষোভ ও ব্যঙ্গের পাত্র হয়েছেন। সম্প্রতি ব্রাজিলে এই ওষুধ নিয়ে গবেষণায় ইতি টানা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কোভিড রোগীরা এটা ‘অতিরিক্ত সেবন’ করায় এই গবেষণার অবসান ঘটে। এদিকে কোভিড-১৯ ব্যাধির আপাত সূচনাস্থল চীন দেশের গবেষণাগারে ক্লোরোকুইনসহ কয়েকটি ওষুধ নিয়ে গবেষণা চলছে। এতে গবেষকরা সফল হলে ওষুধগুলো কোভিডসহ শ্বাসযন্ত্রের ব্যাধির চিকিৎসায় ‘নয়া দিগন্তের সূচনা করবে’। তবে ব্রাজিলে এ সংক্রান্ত গবেষণার ব্যর্থতা জনমনে সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে দেশের প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসোনারো ওষুধটির ব্যবহার অব্যাহত রাখতে চান একগুঁয়েমির মাধ্যমে।

উল্লেখ্য, ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত দু’টি পুরনো ওষুধ হচ্ছে ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। পর্যাপ্ত স্বচ্ছতা ও সতর্কতা না থাকলে এ ধরনের ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মারাত্মক হওয়া অসম্ভব নয়। তবুও এ জন্য ট্রাম্প, মোদি, বোলসোনারো প্রমুখ রাষ্ট্রনেতার একগুঁয়েমি অযৌক্তিক বলা যায়। 

২২ মের একটি খবর, ম্যালেরিয়ার যেসব ওষুধ রয়েছে ক্লোরোকুইনসহ, সেগুলো কোভিড-১৯ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলে মারাত্মক পরিণতি ঘটতে পারে বলে এক গবেষণায় জানা যায়। এমনকি এতে মৃত্যুও ঘটতে পারে রোগীর। অথচ ১৮ মেও জানা গেল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি আপত্তিকর কাজ হলো হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ওষুধ সেবন করা যাতে তিনি কোভিড থেকে বাঁচতে পারেন। সিএনএন মিডিয়ার চিকিৎসাবিষয়ক একজন সিনিয়র প্রতিনিধি বলেছেন, ‘এটা বিপজ্জনক প্রবণতা।’ অথচ এই ট্রাম্পই কিছু দিন আগে কোভিড মহামারীকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন A little flu বলে। তার ভক্তদের একজন ব্রাজিলের দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসোনারো। ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ আমাজন মহারণ্য ধ্বংসের জন্য নিন্দিত বোলসোনারো ট্রাম্পের মতো আরেক প্রবক্তা ক্লোরোকুইন সেবনের পক্ষে। উভয়েই প্রথমে করোনা সংক্রমণকে অবমূল্যায়ন করে এখন এ মহামারীর তাণ্ডবে দিশেহারা হয়ে ম্যালেরিয়ার ওষুধকে কোভিডের ওষুধ হিসেবে দেখতে উঠেপড়ে লেগেছেন। অথচ বোলসোনারো বলেছিলেন, ক্লোরোকুইন হচ্ছে কোভিড চিকিৎসার Potential wonder drag. এখন করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম ও দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে ক্লোরোকুইন ‘প্রতিদিন সেবন’ করার দাবি করলে কী হবে, বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘ল্যান্সেট’ বলেছে, ‘গবেষণায় জানা যায়- কোভিড চিকিৎসায় এ ওষুধ গ্রহণ করা হলে রোগীর বিরাট ক্ষতি হতে পারে। কারণ এটা হৃৎপিণ্ডের মারাত্মক ক্ষতি করারও আশঙ্কা রয়েছে।’ সাময়িকীটি পরে অবশ্য তাদের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয়।

জানা গেল, কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলার জন্য গঠিত বাংলাদেশের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ক্লোরোকুইন সেবনের বিষয় গাইডলাইনে না রাখার পরামর্শ দিয়েছে। অপর দিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবাণী উপেক্ষা করে ২০ লাখ ডোজ ডাইড্রক্সিক্লোরোকুইন পাঠালেন তার ভক্ত, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর কাছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আবার হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনকে কোভিড মহামারীর ওষুধ হিসেবে চূড়ান্তভাবে প্রেসক্রাইব করা উচিত হবে না।


আরো সংবাদ



premium cement