২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

অস্বাভাবিক সময়ের গতানুগতিক বাজেট

অস্বাভাবিক সময়ের গতানুগতিক বাজেট - ছবি : নয়া দিগন্ত

গত সপ্তাহে আমাদের অর্থমন্ত্রী এ এইচ এম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করেছেন। করোনাভাইরাসের সময় দেয়া এ বাজেটে সঙ্গত কারণেই আগের বাজেটগুলোর চেয়ে কিছুটা ভিন্নতা থাকবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু হতাশ হতে হলো। ৩৩ বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরেছি দুই যুগের বেশি হয়েছে। কিন্তু প্রতি বছর বাজেটে আমি একই কথা শুনে আসছি। মজার বিষয় হলো- যারা বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান, তাদের পরিভাষাও এক। বিরোধী পক্ষের ভাষাতে পরিবর্তন নেই, সরকার পক্ষেরও তাই। বাংলা ভাষায় একটি কথা আছে ‘গৎবাঁধা’। এটা সে রকম। এ বক্তব্য দিতে বাজেট বোঝার দরকার হয় না।

আবার এটাও ঠিক, বাজেটে কোনো মৌলিক পরিবর্তন থাকে না। বরাদ্দ যা থাকে, তা কোথাও কমানো আর কোথাও বাড়ানো; নিরেট যোগ-বিয়োগের চর্চা। আমাদের অর্থনৈতিক অন্তর্নিহিত সমস্যা নিয়ে আলোচনা এবং সেগুলো দূর করার উপায় নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ বা প্রস্তাব থাকে না।
এখন সময়টি অস্বাভাবিক। সব দেশই স্বীকার করছে, বিশ্ব বহু দশক এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক বাজেট। হ্যাঁ, পরিস্থিতি ‘অস্বাভাবিক’, এ কথা ঠিক, কিন্তু বাজেট কিভাবে অস্বাভাবিক?

এ বাজেট বিগত বাজেটগুলোর চেয়ে চিন্তা ও চেতনায় কোন দিক দিয়ে ‘অস্বাভাবিক?’ আমাদের বাজেটে তো বিরাজমান অবস্থার প্রতিফলন থাকা দরকার ছিল। তা হয়নি; আগের মতোই- জ্বর দেখে রোগীকে জ্বরের ট্যাবলেট খাওয়ানো, কিন্তু জ্বরের আসল কারণ খতিয়ে দেখার গরজ অনুভব না করা। মাথা ধরলে এর কারণ না খুঁজে শুধু একটা ওষুধ খাইয়ে দিলেই হলো। এটা মলমের প্রলেপ দিয়ে ক্যান্সারের ক্ষত ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টার মতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে পিএইচডি করতে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাই। আমার পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই এখানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ফলে পাকিস্তান সরকার আমার স্কলারশিপ বাতিল করে দেশে ফেরত আসার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সেই নির্দেশ না মেনে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ফলে আমাকে প্রায় দুই বছর রাষ্ট্রহীন অবস্থায় থাকতে হয়েছিল। সেই সময়ে এক দিকে পড়াশোনা, অন্য দিকে পরিবার চালানো নিয়ে আমাকে অকূল পাথারে পড়তে হয়। কমিউনিটি কলেজে মাস্টারি করা, আরো কয়েকটি কলেজে লেকচার, নিজের পড়াশোনা চালানো- সব মিলিয়ে আমি সকাল ৮টায় ঘর থেকে বের হতাম, আর ফিরতাম রাত ৮টায়। কেউ যদি জিজ্ঞেস করত ছেলেমেয়ে কত বড় হয়েছে, তখন আমাকে দুই পাশে হাত দিয়ে দেখাতে হতো। কারণ প্রতিদিন ওদের শোয়াই দেখতাম। যখন বাসা থেকে বের হতাম তখন ওরা ঘুমে থাকত। আবার যখন বাসায় ফিরে আসতাম তখনো ওরা শোয়া। কোনো দিন ছুটি পেলে আমি নিজেই বেঘোরে ঘুমাতাম। তখন একদিন আমার পেটে ব্যথা শুরু হয়। ভাবলাম, হয়তো আলসারের ব্যথা। আমার হিস্ট্রি শুনে ডাক্তার বললেন, তোমার সমস্যা পেটে নয়, মাথায়- ‘ইউ আর ওভার স্ট্রেসড’। বেকার ও দেশহীন থাকার সময় এই স্ট্রেস ও টেনসন আমি হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছি। এখনো যখন দেখি- লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাচ্ছে, কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে- এটা আমার কাছে মহাবিপর্যয়ের আভাস বলে মনে হচ্ছে।

এ সমস্যার উত্তরণে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। দরকার মৌলিক পরিবর্তন।
বাজেটে খাতওয়ারি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, কিন্তু খাতওয়ারি বরাদ্দের কী প্রভাব পড়বে সেই কথা কি বলা হয়েছে? আমি যখন ঝড়ের আভাস পাচ্ছি, সেই ঝড় মোকাবেলার জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তার ব্যাখ্যা নেই। করোনাকালে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুরবস্থা আমাদের সামনে স্পষ্ট। প্রতি বছরই স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ থাকে। কিন্তু এরকম একটি মহাদুর্যোগ প্রতিরোধের জন্য আমরা স্বাস্থ্য খাতকে কেন গড়ে তুলতে পারিনি? কারণ আমরা বাজেট বরাদ্দের প্রভাব বিশ্লেষণ করিনি এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও নেইনি। করোনা দুর্যোগের কারণে ভবিষ্যতে আমরা সম্ভাব্য যে পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছি তা কি বাজেটে বিশ্লেষণ করা হয়েছে? সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে কি?


আমাদের বাজেটে কোনো ‘ফোকাস’ নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজেট দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। যারাই ফোকাস করেছেন তারাই উন্নতি করতে পেরেছেন। যেমন আমাদের সরকার বিদ্যুতের ওপর জোর দিয়েছে। এটা ভালো উদ্যোগ। উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে বিদ্যুৎ দরকার। এটা হলো ফোকাস। বাজেটে এই ফোকাসটি থাকলে কালো টাকা সাদা করার প্রশ্ন উঠত না বারবার। কালো টাকার কথা সেই এরশাদ সরকারের আমল থেকেই শুনে আসছি। এটার উৎস নির্মূল করা এবং কেন কালো টাকা কামানোর সুযোগ দেয়া হলো, সেই প্রশ্ন বাজেটে করা হচ্ছে না। ‘কালো’ টাকা ‘সাদা’ করার সুযোগ দেয়ার মানে দুর্নীতিকেই প্রশ্রয় দেয়া। প্রতি বছর কালো টাকা সাদা হচ্ছে আর আমরা প্রতিবাদ করেই যাচ্ছি। কালো টাকা সাদা করতে দেয়ার মানে যারা অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে তাদের সেই সম্পদ স্বীকার করে নিয়ে তাদের আরো ক্ষমতাশালী হওয়ার সুযোগ দেয়া।

অন্য দিকে যাদের শোষণ করে এই কালো টাকা জমানো হয়েছে, তাদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা। কালো টাকার মালিকরা টাকা সাদা করে নিয়ে সদর্পে ঘুরে দাঁড়াবে। এই দর্প ব্যবহার করে সে যে আরো কালো টাকা কামাবে না, সেই গ্যারান্টি কোথায়? কালো টাকা দূর না হওয়ার কারণ, প্রশাসনেরই একটি অংশ কালো টাকার মালিকদের লালন করছে। রাজনৈতিক দলগুলোও এদের উৎসাহিত করছে। এখানে ‘বটম লাইন’ হলো আমাদের নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে। আমরা ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্লোগান দিই। এটা শুধু মুখেই। আমাদের কথার সাথে কাজের মিল সমান্যই। সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ হতে হবে। সোনার মানুষ মানে, নৈতিকভাবে উন্নত হতে হবে। আমাদের বাজেট হয়ে পড়েছে স্লোগানমুখী- দারিদ্র্যবিমোচন করতে হবে, কর্মসংস্থান করতে হবে, বেকারত্ব দূর করতে হবে, আরো কত কী।
আরেকটি বিষয় হলো- আমাদের বাজেটে ধনী-গরিব বৈষম্য দূর করার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। এর জন্য করকাঠামো ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। করের বড় অংশ গোপন বা পরোক্ষ কর। এখানে কর মওকুফের সুবিধা অবৈধ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধনীরাই কর ফাঁকি দেয়ার ফন্দিফিকির করতে পারেন। গরিবরা তা পারেন না। কারণ পরোক্ষ কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই।

গরিবের লবণ, কাপড় ওষুধের ওপর যে কর সেটি ফাঁকি দেয়ার উপায় নেই। কিন্তু ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার-ইনভয়েসিং করে একজন শিল্পপতি কর ফাঁকি দিতে পারেন। আমাদের বাজেটে কখনো বলা হয় না আগে প্রত্যক্ষ কর এত শতাংশ ছিল এবার এত শতাংশ হয়েছে। আগে পরোক্ষ কর কত শতাংশ ছিল এবার কত শতাংশ হয়েছে। এ হিসাব দিলেই জনসাধারণ বুঝতে পারে করের বোঝা কার ঘাড়ে চাপছে।
আসলে আমাদের বাজেট হওয়া উচিত ‘থ্রি-ইন-ওয়ান’ বা ত্রিমুখী; অর্থাৎ করপোরেট সেক্টর, নন ফরমাল সেক্টর, ভলান্টারি সেক্টরের সমন্বয়। এগুলোর ওপর আলাদাভাবে ফোকাস দিয়ে বাজেট করা গেলে সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব। আমার প্রস্তাবিত ত্রিমুখী বাজেটের প্রথম অংশ বাজারভিত্তিক (করপোরেট সেক্টর) অর্থনীতির বাজেট। এর মূল লক্ষ্য হবে- রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, অপচয় হ্রাস আর প্রশাসনের পরিধি সঙ্কোচন। দ্বিতীয় অংশ হবে বাজারবহির্ভূত (নন করপোরেট সেক্টর) তৃণমূল অর্থনীতির বাজেট, যার প্রধান লক্ষ্য হবে দারিদ্র্যবিমোচন।

গ্রাম ও স্থানীয় পর্যায়ের সর্বনিম্ন স্তরের জনগণ যেমন- ভূমিহীন মজুর, প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র কারিগর, ব্যবসায়ী, শহরাঞ্চলের বেকার, ক্ষুদ্র পল্লী শিল্প এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে জীবনের ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর মতো প্রান্তিক প্রবৃত্তি পূরণের ব্যবস্থা করা; সঞ্চয় প্রবণতা বাড়াতে আগ্রহী করা; তাদের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা। আর শেষ ও তৃতীয় অংশ হবে- স্বেচ্ছাসেবক খাতের (ভলান্টারি সেক্টর) অর্থনীতি। এর লক্ষ্য হবে বিশেষ করে সামাজিক তহবিল গঠন ও সামাজিক বিনিয়োগের জন্য ইসলামী অর্থব্যবস্থার বাধ্যতামূলক ও স্বেচ্ছামূলক বিবিধ কর্মসূচি গ্রহণ।
দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য আমি দেশের স্বেচ্ছাসেবক খাতকে সক্রিয় করার কথা বহু দিন ধরে বলে আসছি। এ পর্যন্ত কোনো বাজেটে সে দিকে নজর দেয়া হয়নি। ওয়াক্ফ সম্পত্তি বা দেবোত্তর সম্পত্তি উন্নয়ন করে রাজস্ব আয়ের চিন্তা কোনো সরকারের মাথায়ই যেন আসছে না। এসব সম্পত্তি থেকেই সরকারের রাজস্ব আয়ের বড় অংশ আসতে পারে। হিসাব করে দেখেছি, দেশে ২৭ শতাংশ রাজস্ব আসতে পারে শুধু স্বেচ্ছাসেবক খাত থেকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ১৯৮৬ সালের তথ্যমতে, সারা দেশে এক লাখ ৫৩ হাজার ওয়াক্ফ স্টেট রযেছে। তবে ওয়াক্ফ ভবনের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে দুই লাখের বেশি ওয়াক্ফ স্টেট রয়েছে। প্রায় তিন যুগ আগের এ পরিসংখ্যান। ইতোমধ্যে এমন সম্পত্তি যে আরো বেড়েছে অনায়াসে তা বলা যায়। উপরের হিসাব শুধু নিবন্ধিত সম্পত্তির। যেগুলো মৌখিকভাবে ওয়াক্ফ করা হয়েছে, সেগুলোর হিসাব নেই।

আমাদের দেশে ওয়াক্ফ সম্পত্তি নিবন্ধন করাও বিশাল এক ঝামেলার বিষয়। এ ব্যাপারে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই বলে আসছি। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কর্ণপাত করছে না। এ খাতের অর্থ যাচ্ছেতাইভাবে খরচ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক কাজে খরচ হতেও দেখেছি। ওয়াক্ফর সম্পত্তির উন্নয়ন করে আয় বাড়ানো যায় সে দিকে খুব কমই নজর দেয়া হয়। সরকার এ জন্য ‘ওয়াক্ফ প্রপার্টি ডেভলপমেন্ট বোর্ড’ গঠন করতে পারে।
আমি ব্যাংকে থাকাকালে এ ধরনের কিছু উদ্যোগও নিয়েছিলাম; বিশেষ করে মসজিদে থোক অনুদান দেয়ার বদলে এর কোনো সম্পত্তি থাকলে সেগুলোর উন্নয়ন করা; দোকান বা এমন কোনো স্থাপনা নির্মাণ করে দেয়া, যা একটি স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা হতে পারে। আমরা মসজিদ, মাদরাসায় চাঁদা দিই। কিন্তু মসজিদ মাদরাসার সম্পত্তি উন্নয়ন করে সেগুলোর স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করার কথা ভাবি না। এটা করা গেলে আমাদের মসজিদ-মাদরাসাগুলো আত্মনির্ভরশীল হতে পারে। সমাজ ও অর্থনীতিতেও এর বিশাল প্রভাব পড়বে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে ৯০ শতাংশ মুসলমানের যে অন্তর্নিহিত শক্তি তা কাজে লাগাতে পারলে আমাদের দৈন্য থাকার কথা ছিল না।

কিন্তু আমরা সেটি করতে পারিনি। অথচ এই ঢাকাকেই বলা হয় ‘মসজিদের নগরী’।
আজকে করোনা মহামারীর মতো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে উপরের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনা আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা যদি সত্যিকারের কল্যাণমুখী ও গরিববান্ধব বাজেট তৈরি করতে চাই তাহলে এগুলোর ওপর ফোকাস দিতেই হবে।


লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement