২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ভানুর কৌতুক এবং বাস্তবতা

-

‘শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রাখুন।’ দেশবাসীর প্রতি আবারো উপর্যুক্ত আহ্বান জানিয়েছেন দৃশ্যত, দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পুরুষ ও দেশের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘নিউজিল্যান্ড ও ভিয়েতনাম পারলে আমরা কেন পারব না?’ অত্যন্ত যৌক্তিক ও আশাজাগানিয়া প্রশ্ন।

বাসভবন থেকে নিয়মিত ব্রিফিংকালে এসব কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার ও গুজব রটানো হচ্ছে। এসব গুজব ভাইরাসের চেয়েও ভয়ঙ্কর। তবে অনেক ক্ষেত্রে তাদের কাছে যেগুলো গুজব, জনগণের কাছে সেগুলোই বাস্তবতা। এটিই আজকের দিনে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।

একজন মন্ত্রী বলেছেন, ‘ভেন্টিলেশন পিপিইর সঙ্কট ইউরোপ আমেরিকায়; আমাদের নয়।’ মনে হয়, তারা থাকলে এই দেশে কোনো দিন কোনো কিছুর অভাব পড়বে না এবং এই দেশ থেকে গুজবের ফ্যাক্টরি কখনোই শেষ হবে না।
সর্বদা নিজেকে সফল দেশ ও মানুষদের কাতারে কল্পনা করা একটি বড় রোগ। এই রোগে আমরা কতটুকু আক্রান্ত তা এখন উপলব্ধিতে এসেছে। এ রোগে অনেক আগেই আমরা সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, নিউইয়র্ক বনে গিয়েছিলাম। এই হ্যালুসিনেশনের বাইরে যারা থাকতেন তারা সবাই ‘রাজাকার এবং চেতনাবিরোধী’।’

বিবিসির মতো সংবাদমাধ্যমও উল্টাপাল্টা প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করেছে। সিঙ্গাপুরে করোনায় আক্রান্তদের এক-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশী শ্রমিক। তারা যেসব ডরমেটরিতে থাকতেন সেখানে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। সিঙ্গাপুর সরকার তখন এদের বিভিন্ন তারকা হোটেল, ক্রুজ ও অন্যান্য উঁচুমানের হাউজিং ফ্যাসিলিটি, আইসোলেশন ফ্যাসিলিটিতে স্থানান্তর করে। বিনা পয়সায় পাঁচতারকা হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় ওই আক্রান্ত ও গরিব বাংলাদেশী শ্রমিকদের। বিপরীত দিকে, আমাদের দেশে অন্যতম ধনাঢ্য শিল্পপতি পরিবারের এক ভাইয়ের ভেন্টিলেটর খুলে অন্য ভাইকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হয়। সেই চেষ্টাও বিফলে গিয়েছে। বিবিসি বাংলা এ শ্রমিকদের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে! কাজেই আসল সিঙ্গাপুর এবং মেকি সিঙ্গাপুরের মধ্যকার পার্থক্যটি স্পষ্ট হয়ে পড়ে।

এই অগাধ আস্থার বদৌলতেই কিছু দিন আগে বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করে ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় জীবন পেয়েছেন। সেই ‘বোনাস জীবন’টিও আগের স্টাইলে যাপন করা শুরু করেছেন। এখন কোভিডের মোকাবেলায় নিজেরা এক ধরনের লখিন্দরের বাসর ঘরে অবস্থান করে অপরাপর দেশবাসীকে নেত্রীর ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।

এই আহ্বান এবং কলকাতার ভানুর কৌতুক সিরিজের সুর তাল লয় সব মিলে যাচ্ছে! টালিউডের প্রখ্যাত কমেডিয়ান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তার এক কৌতুক নকশায় টিনের বাক্সে বারো টাকা ফেলার বিনিময়ে এক আজব পরামর্শের অফিস খুলেছিলেন। পরামর্শক তার মক্কেলকে বারবার আশ্বাস দেয়, ‘চিন্তা কইরো না, আমি বেঁচে থাকতে আসামির কিছুই হবে না। আমার ওপর ভরসা রাখো।’ এভাবে ভরসা রাখতে রাখতে মক্কেলের যখন ফাঁসির হুকুম হয়ে যায় তখনো সেই ভরসার ভরসা শেষ হয় না, ‘খোকনকে বল, আমার ওপর ভরসা রাইখ্যা ঝুইল্যা পড়তে। আমি তো আছিই! মইরা তো যাই নাই।’

সরকারের উন্নয়নের সব চাপাবাজি যেন ভানুর ওই টিনের বাক্সে জায়গা করে নিয়েছে। গত ১১-১২ বছরে উন্নয়নের নামে ‘টিনের বাক্স’ই বানানো হয়েছে। এরকম অনেক আশা ও ভরসার বাণী শুনতে শুনতে জাতি এখন সত্যিকার অর্থেই ঝুলে পড়েছে। জাতিকে পুরো ঝুলিয়ে দিয়ে ভানুর মতো করেই যদি বলা হয়, আমার ওপর ভরসা রাখুন! তা হলে কী লাভ?

এ আস্থার মাহাত্ম্য দেশবাসী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে। সাবেক মেয়র কামরান এ আস্থার পুরস্কারস্বরূপ বেহুঁশ অবস্থাতেও সিলেট থেকে উড়ে ঢাকায় করোনার চিকিৎসা নিতে সক্ষম হয়েছেন। আবার একই রঙ ও একই আস্থা থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রামের উপজেলা লেভেলের জনৈক নেতা চার হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। জগন্নাথ কলেজের সাবেক প্রফেসর করোনায় আক্রান্ত হয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে চক্কর দেয়ার সময় গাড়িতেই ইন্তেকাল করেছেন। এই ভদ্রলোকের খানদানের সবাই ‘বাই ডিফল্ট আওয়ামী লীগার’। স্ত্রীও মাঝারি গোছের নেত্রী। সরকারের এক যুগ্ম সচিব যার মেয়ে নিজেও সরকারি ডাক্তার, তিনিও এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতেই ইহলীলা সাঙ্গ করেছেন! ফলে আমজনতা যে ম্যাসেজ পাওয়ার কথা তা পেয়ে গেছে। এ দেশের ডন কুইক্সোটরা কী উপায় উপকরণ নিয়ে করোনার বিরুদ্ধে নিজেদের মাসল দেখিয়েছিল, জনগণ তাদের ‘হ্যাডম’ মেপে ফেলেছে।

এ রকম শর্তহীন ও অগাধ আস্থাশীল থাকার পরেও হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে বেড়ানো হতভাগার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এদের ‘হতভাগা’ বলার মূল কারণ হলো- এই অন্তিম সময়েও জায়গামতো মন খুলে একটা গালি দিয়ে মরতে পারেনি।

আজ যারা বাসায় বসে অপরাপর দেশবাসীর মতো ‘ইয়া-নাফসি’ ‘ইয়া-নাফসি’ করছেন কিংবা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে চক্কর দিচ্ছেন, এদের অনেকেই বর্তমান সরকারের উন্নয়ন উন্নয়ন স্লোগানে নিজেরাও কণ্ঠ মিলিয়েছেন। ‘ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা’ হিসেবে নিজেদের চাপার ও জীবনের সব শক্তি ব্যয় করে গেছেন। সাবেক এক কর্তাব্যক্তি এবং তার ‘তালেবে এলেম’ আমেরিকা প্রবাসীপুত্রের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগকে নিজেদের মতো আড়াল করেছেন। হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা গলাবাজি করে এগুলোকে বিএনপি-জামায়াতের অপপ্রচার বলে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। সমালোচনার কণ্ঠকে স্তব্ধ করার সব পরিকল্পনাকে জাস্টিফাই করে গেছেন।

অথচ এসব সাগরচুরি সামান্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও দেশের প্রতিটি উপজেলার হাসপাতালকেও আইসিইউ ইউনিট দিয়ে সজ্জিত করা যেত। প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্বমানের হাসপাতাল চালু করা যেত।। তুলনামূলকভাবে উত্তম (ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র) একটা সিস্টেমকে বদলিয়ে একদলীয় ফ্যাসিবাদ কায়েমে নিজেদের জীবন ব্যয় করে গেছেন। কেউ কেউ এর সিকোয়েন্সিয়াল কনসিকোয়েন্স নিজেরা উপভোগ করে গেলেও বাকিদের তারপরেও হুঁশ ফিরবে না।

চলুন, একটু হিসাবটা দেখে নেই। একটা আইসিইউ বেডের দাম বিশ্ববাজারে পঁচিশ থেকে ত্রিশ হাজার ডলার। আমাদের টাকায় যা দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ২২ থেকে ২৬ লাখ টাকা। আনুষঙ্গিক খরচ আরো চার লাখ ধরে নেই। দশটি আইসিইউ বেডের খরচ পড়বে প্রায় ৩ কোটি টাকা। দেশের ৫০০টি উপজেলা হাসপাতালের প্রতিটিতে দশটি করে এবং ৬৪টি জেলা সদরের হাসপাতালে ৫০টি করে আইসিইউ বেড বসালে সর্বোচ্চ খরচ পড়ার কথা-(৫০০ঢ১০+৬৪ঢ৫০) ৩০,০০,০০০=২,৪৬০ কোটি টাকা। প্রতিটি হাসপাতালের ৫০টি বেডে অক্সিজেন সরঞ্জাম বসাতে খরচ এক কোটি টাকা ধরলে আরো ৫৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২৪৬০+৫৬০= ৩০২০ কোটি টাকা দিয়েই দেশের মানুষকে বর্তমান ‘ইয়া-নাফসি’ ‘ইয়া-নাফসি’ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করা যেত। দশ হাজার মানুষ যখন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে চক্কর দিচ্ছে তখন কমপক্ষে দশ কোটি মানুষ ঘরে বসে ‘ইয়া-নাফসি’ ইয়া-নাফসি জপছে। জনাব ওবায়দুল কাদের, এগুলো গুজব নয়। লখিন্দরের বাসর ঘর থেকে বের হয়ে ‘এই-নাফসি’ শুনতে চেষ্টা করুন।

হলমার্ক রাজকোষের চার হাজার কোটি টাকা তছনছ করলে তখনকার অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা পি-নাট! অর্থাৎ সেই একটি কথিত পি-নাটের চেয়েও কম টাকা দিয়েই এই কাজটুকু করা সম্ভব হতো! এবার আসুন, আরো কিছু হিসাব একটু তলিয়ে দেখি। তিন হাজার কোটি টাকা দিয়ে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো হয়েছে। অথচ সেই টাকা দিয়ে দেশের হাসপাতালগুলোতে আট হাজার আইসিইউ বেড স্থাপন করা যেত! নব্বই কোটি টাকা দিয়ে বৃহত্তম মানব পতাকা বানানো হয়েছে, যা দিয়ে ২৭টি উপজেলা হাসপাতালে দশটি করে আইসিইউ বেড কি বসানো যেত না?

গত ১১ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে সাত লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে নানা নামে স্রেফ লুট করা হয়েছে কয়েক লাখ কোটি টাকা। শেয়ারবাজার থেকে লুট হয়ে গেছে এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। কুইক রেন্টালের মাধ্যমে লোহালক্কড় কিনে সরকারের ভর্তুকি খেয়ে কত টাকা লুটপাট হয়েছে সেটাও সঠিকভাবে জানা যাবে না। কারণ এসবের বিরুদ্ধে যাতে মামলা মোকদ্দমা না হয় তজ্জন্য ইনডেমনিটির মাধ্যমে আইনগত সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে! এভাবে আইন করে লুটেরাদের রক্ষার নজির পৃথিবীর কোথায়ও নেই। কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিক যাতে এসব হিসাব বের করে আনতে না পারেন তজ্জন্য কালাকানুনসহ নানা আইনের মাধ্যমে সংবাদপত্রের মুখ ‘সেলাই করে’ রাখা হয়েছে। আপনারা এতটুকু শুনছেন সেই সেলাইয়ের ফাঁক দিয়ে!

আশার কথা করোনার ধাক্কা খেয়ে কারো কারো হুঁশ কিছুটা (সবটা নয়!) ফিরেছে। জনৈক হেভিওয়েট মিডিয়াম্যান এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল যাবেন? আইসিইউ নাই। পাঁচ তারকা হাসপাতালে যাবেন? মালিকের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে যেতে পারবেন না। কপাল ভালো হলে সরকারি হাসপাতালে ঠাঁই হতে পারে। চিকিৎসা কেমন, বুঝতে হলে জেনে নিন সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি সাহেব ভর্তি হননি। ভিআইপিদের জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা আছে। আপনার আমার জন্য কিছু নেই। কোথাও কেউ নেই।’

অথচ বর্তমান এই পরিস্থিতি সৃষ্টিতে এই হেভিওয়েট রাই বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। এই আজব ব্যক্তিরা এ দেশে তাজ্জব মিডিয়ার ধারা সৃষ্টি করেছেন। কোনো কাজের জন্য মূল সিস্টেম বা সিস্টেমের মাথাকে সমালোচনা করা যাবে না। এ দেশে কোনো নায়িকার সংসার জোড়া লাগলে কিংবা কোনো ক্রিকেট ম্যাচে দেশের জয় এলে তজ্জন্যও সরকারপ্রধানকে কৃতিত্ব দেয়া যাবে। সরকারের বড় বড় ব্যর্থতা কিংবা অকর্মণ্যতার জন্য ক্ষমতাবানকে বাঁচিয়ে অন্যদের সমালোচনা করতে হবে। তারা গণভবনের বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে নোবেল প্রাইজের লবিংয়ের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। এসব না করে পেশার প্রতি সামান্য শ্রদ্ধা দেখিয়ে দেশের বাস্তব পরিস্থিতি কিছু জানালে আজকে ‘কোথাও কেউ নাই’ বলে বিলাপ করতে হতো না। 

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement