২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

করোনা-পরবর্তী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাপনা

-

কোভিড-১৯ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, আমদানি-রফতানি, ফরেন রেমিট্যান্স, শিক্ষা, পরিবহন, পর্যটন প্রভৃতি সব ক্ষেত্রে নির্মম আঘাত হেনে চলেছে। এই বিপর্যয় কত দিন স্থায়ী হয়, তা বলার সময় এখনো আসেনি। ক্ষতির ধকল কাটিয়ে উঠতে যে বেশ সময় লাগবে, তা সহজে অনুমেয়। করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষাকার্যক্রম চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের দেশে ঐতিহ্যগতভাবে মাদরাসা শিক্ষা ত্রিধারায় বিভক্তÑ সরকারি আলিয়া, বেসরকারি আলিয়া ও কওমি। বাংলাদেশে সরকারি মাদরাসা রয়েছে তিনটিÑ ঢাকা আলিয়া, সিলেট আলিয়া ও বগুড়া মুস্তাফাবিয়া। এই তিন মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের ভেতন-ভাতা, পেনশন, অবকাঠামো উন্নয়নসহ যাবতীয় ব্যয়ভার রাষ্ট্র বহন করে থাকে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আলিয়া মাদরাসা রয়েছে ১৯ হাজার ৯৮৫টি, এর মধ্যে তিনটি সরকারি এবং বাকিগুলো বেসরকারি। ২০১৫ সালের বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, এসব মাদরাসায় দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিলপর্যায়ে মোট ২৪ লাখ ৯ হাজার ৩৭৩ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। ডয়চে ভেলের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে ইবতেদায়ি মাদরাসার সংখ্যা ৬,৮৮২টি, দাখিল মাদরাসা ৯,২২১টি, আলিম মাদরাসা ২,৬৮৮টি, ফাজিল মাদরাসা ১,৩০০টি ও কামিল মাদরাসা ১৯৪টি। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করেই আলিয়া মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে।

এসব মাদরাসা এমপিওভুক্ত। বেতন-ভাতা রাষ্ট্র বহন করে। তবে বাড়িভাড়া ও চিকিৎসাভাতা হিসেবে যা দেয়া হয়, তা একেবারে নগণ্য। শিক্ষক-কর্মচারীদের পেনশন সুবিধা নেই; তবে অবসর নেয়ার পর ৫-১০ বছর অপেক্ষা করে কল্যাণ তহবিল ও অবসর ভাতা হিসেবে এককালীন নগদ অর্থ পেয়ে থাকেন তারা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো বেসরকারি আলিয়া মাদরাসায় গ্র্যাচুইটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই। যত শিক্ষক প্রয়োজন, ‘জনবল কাঠামোর কারণে তত শিক্ষককে এমপিও দেয়া হয় না। শিক্ষাকার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হয়। তাদের বেতন-ভাতা মাদরাসা ফান্ড থেকে পরিশোধ করতে হয়। শ্রেণীকক্ষ, অফিস, লাইব্রেরি ভবন, ছাত্রাবাস, অডিটোরিয়াম ও শৌচাগার নির্মাণ, মাদরাসা সম্প্রসারণের জন্য জমি ক্রয়, ঘেরাও বেড়া মেরামত, দৈনন্দিন খরচ বিশেষ করে বিদ্যুৎ, পানি, অফিসিয়াল সামগ্রী, পাঠাগারের গ্রন্থ ক্রয়সহ সব খরচ প্রতিষ্ঠানের ফান্ড থেকেই নির্বাহ করতে হয়। কিছু মাদরাসায় সরকারের ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ থেকে দু’একটি ভবন তৈরি করে দেয়া হয়। কিছু মাদরাসা ছাত্রাবাসের স্বল্পসংখ্যক এতিম নিবাসীদের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট পেয়ে থাকে। এগুলো অনেকটা নির্ভর করে তদবিরের ওপর। এ অবস্থায় এমপিওভুক্ত আলিয়া মাদরাসার পুরো বাজেটের একটি বিরাট অংশ জোগান দিয়ে থাকে ধর্মপ্রাণ জনগণ। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের সরকারি অংশ, ছাত্রবেতন, বার্ষিক সভা, রমজানের চাঁদা, কোরবানির পশুর চামড়ার দাম এবং বিত্তশালীদের অনুদান নিয়ে বার্ষিক বাজেট তৈরি করা হয়।

কওমি মাদরাসাগুলো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বা অনুদান গ্রহণ করে না। এসব মাদরাসা স্থানীয় দ্বীনদরদি পৃষ্ঠপোষকদের অনুদান ও সাহায্য সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে। প্রায় মাদরাসায় রয়েছে এতিমখানা। সেখানে আর্থিক অনুদান শুধু এতিমদের জন্য ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা আছে। একেবারে হাতেগোনা কিছু এতিমখানায় ছাত্রদের খাবার হিসেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় চাল, ডাল, তেল বা নগদ অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে ক্যাপিটেশন গ্র্যান্টের আওতায়। এসব সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল। এতিমখানায় সহায়তা দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা
প্রতিষ্ঠানগুলোর অতীত শিক্ষা কর্মকাণ্ড বিবেচনা করেন। বেশির ভাগ কওমি মাদরাসা ও এতিমখানা সরকারি সহায়তা নিতে ইচ্ছুক নয়।

১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশে কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা। এই শিক্ষাব্যবস্থা যুগের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে গড়ে ওঠে, তবে কোনো প্রকার সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই। আর এখন তারা সরকারের স্বীকৃৃতি নিলেও বেতন-ভাতা বা অন্য কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা নিতে রাজি নয়। মাদরাসার জমি ক্রয়, বেষ্টনী-প্রাচীর তৈরি, ভবন নির্মাণ, কিতাব সংগ্রহ, বিদ্যুৎ, পানি, ছাত্রদের খাবার, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, অফিসিয়াল খরচ প্রভৃতি মাদরাসা ফান্ড থেকে নির্বাহ করা হয়। সব কওমি মাদরাসায় বার্ষিক মাহফিল হয়ে থাকে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মাহফিলে সাধারণত চাঁদা তোলা হয় না। তবে স্বেচ্ছায় কেউ দান করতে চাইলে তা গ্রহণের জন্য গেটে অথবা নির্ধারিত স্থানে লোক থাকে। পরিচালনার অষ্টনীতির (উসুলে হাশতাগানা) ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালার ওপর তাওয়াক্কুল এবং জনগণের সহায়তায় কওমি মাদরাসা শিক্ষা কার্যক্রম চলে আসছে।

কওমি মাদরাসা মূলত একটি বিশেষায়িত শিক্ষাব্যবস্থা। তাদের টার্গেট কুরআন-হাদিসে শিক্ষিত সুদক্ষ আলিম গড়ে তোলা। প্রথম থেকেই দারসে নিজামির আলোকে কওমি মাদরাসার ছাত্রদের আরবি নাহু সারাফ, আরবি সাহিত্য, তাফসির, উসুলে তাফসির, হাদিস, উসুলে হাদিস, ফারায়েজ, আকায়েদ, ফিকহে ইসলামী পড়ানো হয়। আধুনিক বিষয়ে পড়ালেখা করার জন্য আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে।

২০১৫ সালের ব্যানবেইস তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদরাসা রয়েছে। এসব মাদরাসায় ছাত্রসংখ্যা ১৪ লাখ। কিন্তু বাস্তবে এটা আরো বেশি। নূরানি মাদরাসার সংখ্যা এই হিসাবের বাইরে। ছয়টি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে এসব মাদরাসা পরিচালিত হয়ে আসছে। ছয়টি বোর্ডকে সমন্বিত করে উচ্চতর একটি প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ রয়েছে, যা ‘হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়াহ’ নামে পরিচিত। এটি সরকার কর্তৃক স্বীকৃত। এটার প্রদত্ত দাওরায়ে হাদিসের সনদ মাস্টার্সের সমমর্যাদা সম্পন্ন। স্বীকৃতি সংক্রান্ত আইনের ২(১) ধারায় ‘কওমি মাদরাসা’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সহায়তায় উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এবং ইলমে ওহির শিক্ষাকেন্দ্রই হলো কওমি মাদরাসা।

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে দেশের ছয় হাজার ৯৫৯টি কওমি মাদরাসাকে আট কোটি ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। অনুদানের অর্থ ইলেকট্্রনিক ফান্ড ট্্রান্সফারের মাধ্যমে মাদরাসাগুলোর কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অনুদানপ্রাপ্ত কওমি মাদরাসার মধ্যে রংপুর বিভাগে ৭০৩টি, রাজশাহী বিভাগে ৭০৪টি, খুলনা বিভাগে ১০১১টি, বরিশাল বিভাগে ৪০২টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৯৭টি, ঢাকা বিভাগে ১৭৮০টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৪৮১টি এবং সিলেট বিভাগের ৪৮১টি মাদরাসা রয়েছে। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে।

২ মে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মজলিসে খাসের এক সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সরকারি অনুদান গ্রহণ, কওমি মাদরাসার দেড় শ’ বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি ও আদর্শকে বিসর্জন দেয়া। তাই এ ধরনের অনুদান গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য সব কওমি মাদরাসার দায়িত্বশীলদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বেফাক নেতৃবৃন্দ বলেন, উপমহাদেশব্যাপী বিস্তৃত কওমি মাদরাসাগুলো বিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি-আদর্শ ও শিক্ষাক্রম অনুসরণ করেই পরিচালিত হয়ে আসছে। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাকালে অলঙ্ঘনীয় যে মূলনীতি নির্ধারণ করেছে, তার অন্যতম হলো, ‘যেকোনো পরিস্থিতিতে সরকারি অনুদান গ্রহণ থেকে বিরত থাকা’। সুতরাং এই মূলনীতিকে বিসর্জন দিয়ে দেশের কোনো কওমি মাদরাসা সরকারি অনুদান গ্রহণ করতে পারে না। অতীতেও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কঠিন সঙ্কটকালে আমাদের পূর্বসূরিরা অনুদানের জন্য সরকারের দ্বারস্থ হননি (নয়া দিগন্ত, ০২.০৫.২০২০)।

স্মর্তব্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরে আরেক ধরনের প্রাইভেট মাদরাসা আছে যেগুলো প্রাথমিক, নি¤œ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের। এসব মাদরাসার সংখ্যাও কম নয়। মাদানি বা অন্য বিশেষ নেসাবের অধীনে এগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। কওমি ও আলিয়া পাঠ্যক্রমের সমন্বয়ে অনেকে নিজস্ব সিলেবাস তৈরি করে পাঠদান করে থাকেন। এ রকম বেশির ভাগ মাদরাসা ভাড়া করা ভবনে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কিছু মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জনগণের আর্থিক অনুদান গ্রহণ করে; আবার এ জাতীয় অনেক মাদরাসা আছে যারা ছাত্রবেতনের ওপর নির্ভরশীল। জনগণের চাঁদা, জাকাত, সাদাকাহ ও ফিতরা তারা গ্রহণ করে না।

ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে আহলে হাদিস চিন্তাধারার কিছু মাদরাসা আছে যেগুলো বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অবকাঠামো নির্মাণে সরকারি কোনো অনুদান নেই। এসব মাদরাসার সিলেবাস তাদের স্কলারদের দ্বারা প্রণীত। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জনগণের আর্থিক সহায়তা নিয়ে থাকে। অনেকটা কওমি আদলে এগুলো পরিচালিত হচ্ছে।

বহু বছর ধরে স্থানীয় জনগণ কোরবানির পশুর চামড়া বেসরকারি মাদরাসাগুলোতে দান করে আসছে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষও আবার কিছু চামড়া কেনে। এসব চামড়া বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ মাদরাসার তহবিলে জমা করা হয়। মাদরাসা, এতিমখানা ও হিফজখানার জন্য এটা বড় ধরনের আয়। কিন্তু ২০১৮-২০১৯ সালে চামড়ার বাজারে ধস নামে এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ রফতানি খাত চামড়াশিল্প মুখথুবড়ে পড়ে। দাম না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে মানুষ কোরবানির পশুর চামড়া রাস্তায় রেখে যায়; ডাস্টবিনে ফেলে দেয় অথবা মাটিতে পুঁতে ফেলে। চামড়াশিল্পে বিপর্যয় নেমে আসার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাদরাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষ। চামড়া বিক্রি করলে তা অনাথ, দরিদ্র ও দুস্থদের দান করাই শরিয়তের বিধান। এই স্বেচ্ছাদানের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মাদরাসা, হিফজখানা ও এতিমখানার শিক্ষার্থীর খাবারের জোগান দেয়া হয়। বিক্রি করতে না পেরে অনেক এতিমখানা চামড়া ভাগাড়ে ফেলে দিয়েছে। এতে মাদরাসাগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে কওমি মাদরাসাগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। সাধারণত শাবান মাসে পরীক্ষা পরিচালিত হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঈদুল ফিতরের পর পরীক্ষার তারিখ পুনর্নির্ধারিত হতে পারে। বেসরকারি মাদরাসাগুলোর আর্থিক সহায়তা লাভের জন্য রমজানুল মুবারক গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মাদরাসায় অনুদান ও সহায়তা দিয়ে থাকে। মাদরাসার বার্ষিক বাজেট এর ওপর অনেকটা নির্ভর করে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকা, লকডাউন ও হোম কোয়ারেন্টিনের কারণে এ সহায়তা দেয়া অথবা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। যারা নিয়মিত দান করত তাদের মধ্যে অনেকে বেকারত্ব ও ব্যবসা বন্ধ থাকার কারণে সহায়তা দানে অপারগ। ইতোমধ্যে বহু মাদরাসার কর্তৃপক্ষ শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারেনি। যেসব প্রাইভেট বা বেসরকারি মাদরাসা, এতিমখানা ও হেফজখানা ভাড়া করা ভবনে পরিচালিত হয়ে আসছে তাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এ অবস্থায় ছাত্রবেতনের জন্য অভিভাবকদের চাপ দেয়াও বেমানান। অনেকে দিচ্ছে তবে অনেকের পক্ষে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো যায় কি না, ভেবে দেখতে হবে। অন লাইনে সব ক্লাস নেয়া হয়তো সম্ভব হবে না কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্লাস নেয়া যেতে পারে। কওমি মাদরাসাগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা এখনো হয়নি। সে ক্ষেত্রে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের প্রমোশন দেয়া যেতে পারে। দারুল উলুম দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ এই পদ্ধতি চালু করেছে।

মাদরাসা শিক্ষা আমাদের সমাজের জন্য আল্লাহ তায়ালার রহমত। এই শিক্ষাধারায় বিজ্ঞ আলিম, মুহাদ্দিস, মুফতি, মুনাজির, খতিব, ওয়ায়েজ ও পীর মাশায়েখ সৃৃষ্টি হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। ইসলামী শিক্ষা ও কৃষ্টির বিকাশ, সমাজে ধর্মীয় পরিবেশ সৃষ্টি, নৈতিকতার উজ্জীবন এবং মানুষকে আখিরাতমুখী করার ক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষিতদের অবদান ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়। মাদক, সন্ত্রাস, সহিংসতা, ইভটিজিং, বেহায়াপনা, যৌতুক, নারী নির্যাতনের মতো সামাজিক ব্যাধি দূরীকরণে আলিমদের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবদীপ্ত। মাদরাসা সামাজিক শক্তির কেন্দ্র। সমাজের সদস্যদের সাথে মাদরাসার সম্পর্ক সুনিবিড়।
করোনা-পরবর্তী সময়ে সঙ্গত কারণে সব বেসরকারি মাদরাসা কম বেশি একাডেমিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সঙ্কট তৈরি হচ্ছে, ধার-দেনা বেড়ে যাচ্ছে।

যেকোনো বৈরী পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মানসিক দৃঢ়তা আলিমদের রয়েছে। তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ, তাকওয়া আর নিশীথ রজনীর চোখের পানির বরকতে আল্লাহ তায়ালা ইলমে নববীর বাগানগুলোকে আবার সজীব করে তুলবেন। ইতিহাসে এমন নজির ভূরি ভূরি। বলশেভিক আন্দোলনের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। ৭০ বছর পর সমাজতন্ত্রের পতন হলে মধ্য এশিয়ায় ইমাম বুখারি রহ:-এর মাদরাসাসহ সব মসজিদ-মাদরাসা পূর্ণ উদ্যমে আবার চালু হয়ে যায়। আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে।

আমাদের দেশেও করোনা-পরবর্তী সঙ্কট ও বিপর্যয়ের ধকল কাটিয়ে উঠতে সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসতে হবে। তারা মাদরাসার প্রতি সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করবেন এবং প্রয়োজন অনুসারে কর্জে হাসানা দেবেন, এমনটাই জনগণ প্রত্যাশা করে। শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের মতো বেতনের ১০ শতাংশ কেটে রেখে একটি আপৎকালীন তহবিল গঠন করা যেতে পারে। কারণ করোনা, ইবোলা, সার্স অথবা অন্য কোনো মারাত্মক ভাইরাস যেকোনো সময় মহামারী আকার ধারণ করে মানবসভ্যতাকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে। তাদাবির গ্রহণ, সতর্কতা অবলম্বন এবং প্রস্তুতি গ্রহণ আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়। মাদরাসা পরিচালনায় পরনির্ভরতা ধীরে ধীরে কমানো যায় কি না এবং স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করা যায় কি না, ভাবতে হবে। হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী রহ: এ বিষয়ে জোর দিয়েছেন। যেসব মাদরাসা সরকারি অনুদান নিতে ইচ্ছুক, তাদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা অথবা বিনাসুদে কর্জের ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক। মাদরাসার সব ছাত্র দরিদ্র বা অনাথ নয়, তাদের মধ্যে যারা সচ্ছল পরিবারের, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে মাসিক টিউশন ফি ও খোরাকি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। বহু মাদরাসায় এ নিয়ম চালু আছে। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন। 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গনি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।

 


আরো সংবাদ



premium cement