২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ফের খুন করলেন ক্ষমায় মুক্ত খুনি!

ফের খুন করলেন ক্ষমায় মুক্ত খুনি! - ছবি : নয়া দিগন্ত

কয়েক দিন আগে টেলিভিশনের এক টকশোতে এক আইনজীবী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি বললেন, একটি পুরনো শাড়ি চুরির অপরাধে একজনকে বছরের পর বছর কারাবন্দী থাকতে হতে পারে। এর দু’টি কারণ : এক তিনি দণ্ডিত হতে পারেন, অপরটি হলো তিনি বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকতে পারেন। যদি এ ব্যক্তি দীর্ঘদিন কারান্তরীণ থাকেন তা হলে তার পরিবার, স্বজন প্রত্যেকেই একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন। যদি তাকে আপনি ক্ষমা করে দেন তবে তার পরিবারটি রক্ষা পায় এবং হয়তো এ ধরনের অপরাধ ওই ব্যক্তি না-ও করতে পারেন। কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ ব্যক্তি যে অপরাধ করেছেন তা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ বটে কিন্তু সে ধরনের মারাত্মক নয়। সে কারণে এ ধরনের অপরাধীকে ক্ষমা করা যায়। সাধারণত এ সব অপরাধে ছয় মাস বা এক বছর কারদণ্ড হয়। কিন্তু অপরাধের রায় কারাদণ্ড ঘোষণা পর্যন্ত পৌঁছাতে তাকে হয়তো জেলে থাকতে হয় দুই থেকে ১০ বছর। আর এ সময়টিতে ধ্বংস হয়ে যায় একেকটি পরিবার। এ বিষয়টির দিকে খুব গুরুত্বের সাথে নজর দেয়া প্রয়োজন। কেননা কারাগারে এখন নানা কারণে হাজার হাজার বন্দী রয়েছেন এবং এ সংখ্যা কারাগারের ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি। সে কারণে সরকার সম্প্রতি চিন্তা করেছে যে, কারাগার থেকে ৯০ হাজার বন্দীকে তারা মুক্তি দেবেন।


প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছে, যেসব বন্দী তিন মাস বা ছয় মাস দণ্ডিত তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হবে। আমার দৃষ্টিতে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। দেখা যাবে দণ্ডিতরা হয়তো ইতোমধ্যেই পাঁচ মাসের দুই মাস বা ছয় মাসের তিন মাস কারাগারে কাটিয়েছেন। সুতরাং এর ফলে কারাগারে অনেক বেশি স্থান সঙ্কুলান সম্ভব হবে। কারাগারে শুধু যে অপরাধীরাই রয়েছেন তা নয়, বরং সেখানে বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মী বন্দী আছেন। বহু ব্যক্তি আটক আছেন, যাদের বিরুদ্ধে হয়তো মামলাই দায়ের হয়নি। সে রকম পরিস্থিতিতে সরকারের ৯০ হাজার বন্দীকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কারাগারে যে শুধু অপরাধীরাই যান, কিংবা শুধু রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরই কারাগারে রাখা হয়, তা-ও কিন্তু নয়। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো একটি ঘটনা ঘটলে, মারামারি-হানাহানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা এরকম পরিস্থিতিতে পুলিশ সাধারণত কিছু লোকের নাম উল্লেখ করে, আর হাজার হাজার অজ্ঞাত নামে মামলা করে এবং পরবর্তীকালে ওই মামলার আসামিদের অজ্ঞাত অর্থাৎ যাকে খুশি তাকে তারা গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। এ ধরনের মামলা বছরের পর বছর চলতে থাকে। ফলে একটি সমাজের ভেতরে ধ্বংস হয়ে যায় একেকটি পরিবার, একেকটি সংসার। এর সাথে শুধু যে পারিবারিক জীবন ধ্বংস হয়ে যায় তা নয়, এর সাথে সাথে অর্থনৈতিক জীবন এবং রাজনৈতিক জীবনের সব কিছুই জড়িত। এ ধরনের হাজার হাজার অজ্ঞাত আসামির সংস্কৃতির অবসান হওয়া উচিত।


না দেখে থাকলেও অথবা কোনো প্রমাণ না থাকলেও একজনকে ধরে অজ্ঞাত আসামির নামে চালিয়ে দেয়া কিছুতেই যৌক্তিক হতে পারে না। এখন কথা হলো, যাদের এই কারাগার থেকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে তারা সবাই কি খুব সাধারণ আসামি? তারা সবাই কি খুব লঘু দণ্ডে দণ্ডিত? তারা সবাই কি সাধারণ অপরাধী? যদি তা হয় সে ক্ষেত্রে আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে এ উদ্যোগ ভালো। কিন্তু তারা যদি হয়ে থাকে সরকারদলীয় দাগী আসামি, সরকারদলীয় খুনি বা লুটেরা বা অন্য কোনো বড় অপরাধীকে জেলখানা খালি করার নামে তাদের মুক্তি দেয়া হয়; সেটি হবে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি। এর ফলে সমাজে নতুন করে অরাজক পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যায়।
সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে যেমন ক্ষমা করা যেতে পারে, তেমন রাষ্ট্রপতিও ক্ষমা করতে পারেন। যদিও রাষ্ট্রপতি নিজ উদ্যোগে কোনো ক্ষমা সাধারণত করেন না। তিনি সরকারের পরামর্শক্রমে ক্ষমা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি হতে পারেন খুনের আসামি, তিনি হতে পারেন দাঙ্গার আসামি , তিনি হতে পারেন বা অন্য কোনো গুরুতর অপরাধীও। তা সত্ত্বেও তাদের ক্ষমা করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে। এর আগে আমরা দেখেছি, রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় যাদের মুক্তি দেয়া হয়েছে তারা হয়তো খুনের আসামি। ওই রকম আসামি যখন মুক্তি পেয়ে এলাকায় যায়, তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা দলে দলে গিয়ে তাকে ফুলের মালা দিয়ে সম্বর্ধনা জানান যেন তিনি কোনো অতি সম্মানজনক কাজ করে এসেছেন। এ অবস্থাটা আসলে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কারণ দণ্ডিত ব্যক্তির ভেতরে যদি কোনো অনুশোচনা না হয়, তা হলে এ দণ্ড মওকুফের মানেই হয় না।

সম্প্রতি এরকম ঘটনা ঘটেছে যে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় বেরিয়ে এসে তিনি আবারো হত্যা মামলার প্রধান আসামি হয়েছেন। এ আসামি হলেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার সাবেক যুবলীগ সভাপতি আসলাম ফকির। ২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আসলাম ফকির ভাঙ্গার মানিকদহ ইউনিয়নের চেয়াম্যান এ কে এম শাহেদ ওরফে শাহেদ মিয়াকে হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ পান। প্রথমে তাকে ফরিদপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আপিলও হাইকোর্টে বহাল থাকে। আসামিরা দোষ স্বীকার করে ২০১৩ সালের ১৯ মে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু ২০১৪ সালের ১৩ অক্টোবর এ আবেদন নামঞ্জুর হয়। ফলে ওই বছর মাত্র এক মাস পর ১৩ নভেম্বর তার ফাঁসি কার্যকরের দিন ধার্য হয়। ফলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য চিঠি দেয়া হয়। তবে ফাঁসি কার্যকরের এক দিন আগে কারাগারে অস্বাভাবিক ও অসুস্থ আচরণ করলে আসলামের ফাঁসি স্থগিত করা হয়। ওই দিনই দ্বিতীয় দফায় আসলাম ফকিরের পক্ষে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয়। দ্বিতীয় দফায় আসলাম ফকিরের প্রাণভিক্ষার আবেদন গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি এবং তার ফাঁসি মওকুফ করে ১৪ বছরের সাজা দেয়া হয়। এরপর ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ বিশেষ দিবসে বন্দীদের সাধারণ ক্ষমা লাভের সুযোগ নিয়ে তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য আবেদন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী নিলুফার জাফরুল্লাহ । তবে তাকে সে সময় মুক্তি দেয়া হয়নি। ১৩ বছর দুই দিন কারাভোগের পর ২০১৭ সারের ২৫ আগস্ট গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে মুক্তি পান আসলাম।

কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েই তিনি নিজ এলাকায় গিয়ে আবার রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হন। ফাঁসির দণ্ড থেকে ফিরে আসা এই আসলাম ফকিরের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ কথা বলতে সাহস পায় না। গত ২১ এপ্রিল তার নির্দেশে এলাকায় হত্যা ও লুটপাটের ঘটনায় মামলা করে প্রতিপক্ষ। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ এপ্রিল এই মানিকদহ ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে জমির পানি অন্যের জমিতে যাওয়া নিয়ে শাজাহান মাতবর ও জাহাঙ্গীর মাতবরের সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এই জাহাঙ্গীর মাতবরের পক্ষে মদদ দেন আসলাম ফকির। আসলাম ফকির আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লার অনুসারী বলে পরিচিত। তার মদদে সেদিন শাজাহান মাতবরের সমর্থক শহিদ শেখ নামক এক কৃষককে পেটে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার পর কয়েক বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করার অভিযোগ করা হয়।

পরের দিন বুধবার শাজাহান মাতবর বাদি হয়ে আসলাম ফকিরসহ ৫৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরো অজ্ঞাত ১৫ থেকে ২০ আসামির নামে ভাঙ্গা থানায় হত্যা, ভাঙচুর, লুটপাটের অভিযোগে মামলা করেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা সার্কেলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী রবিউল ইসলাম মামলার কথা নিশ্চিত করেন। প্রধান আসামি আসলাম ফকিরসহ অন্যরা এখন পলাতক রয়েছেন। তাদের মধ্যে অবশ্য সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। এখানে প্রশ্ন, তা হলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার মূল্য কোথায় রইল। রাষ্ট্রপতির ক্ষমার অর্থটা এরকমই ছিল যে, তাকে যদি ক্ষমা করা হয় তা হলে সমাজে ফিরে গিয়ে তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন। এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি করবেন না।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ঘটনাটি সম্পূর্ণ বিপরীত হয়েছে। যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা নিক্সন চৌধুরী এমপির সমর্থক বলে পরিচিত। এখন এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী? আমরা যে কথা বলতে চাই তা হলো, সাধারণ ক্ষমা বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই যেন করা হয় যিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। কিংবা এমন ব্যক্তির পক্ষে যেন করা হয় যিনি গুরুতর অসুস্থ, যিনি সমাজে আর কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না বা যার আর কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতাও নেই। সে রকম ব্যক্তিদের যদি ক্ষমা করা হয় তা হলে সমাজে নতুন করে যে সঙ্কট আসলাম তৈরি করেছেন, সে রকম সঙ্কট হবে না। সুতরাং সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বিবেচনায় সাধারণ ক্ষমা না করে যেন ন্যায়বিচারের বিবেচনায় বা ন্যায়ের ভিত্তিতে বা মানবিক বিবেচনায় এই ক্ষমা করা হয়। 

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

rezwansiddiqui@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement