ফ্যানাটিকদের যুতসই হাতিয়ার করোনা
- জসিম উদ্দিন
- ০৬ মে ২০২০, ২১:২৩
ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সংখ্যালঘু মুসলিমদের হেনস্তা করার একটা যুতসই অস্ত্র পেয়ে গেছে। সুযোগটি তৈরি করে দিয়েছে মুসলমানদের একটি পক্ষ। বৈশ্বিক মহামারীর মধ্যে নিজেদের স্বর্গীয় জামাতের আয়োজন করা থেকে তারা বিরত থাকতে পারেননি। এমন ধারণা অনেকে করেছেন, ‘আমরা করোনায় আক্রান্ত হবো না’। যারা স্রষ্টার বিরাগভাজন তারাই করোনায় আক্রান্ত হবেন। এমন ধারণা করে কেউ রক্ষা পাচ্ছেন এমন দেখা যাচ্ছে না। ইহুদি-খ্রিষ্টান-হিন্দু-বৌদ্ধ, গির্জা-সিনাগগ সব জায়গায় মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন।
দিল্লির নিজামুদ্দিনে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছেন। প্রয়োজনে মানুষের বড় বড় জমায়েত দোষের কিছু নয়। রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক উদ্দেশ্যে মানুষ একত্রিত হতে পারে। অন্যদিকে জরুরি পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জমায়েত বাতিল হওয়া একটা সাধারণ ব্যাপার। কোভিড-১৯ একটি অতি ছোঁয়াচে রোগ। এর জন্য দায়ী ভাইরাস নভেল করোনা রকেট গতিতে ছড়ায়। পৃথিবীতে আর কোনো ভাইরাসের এত দ্রুত ছড়ানোর নজির নেই। দিল্লির নিজামুদ্দিনে যখন তাবলিগের জমায়েতটি হচ্ছিল তখন ইউরোপের ইতালিতে মহামারী বিপুল বিস্তার ঘটছিল। এ অবস্থায় এই বিজ্ঞ! মানুষরা এমন বড় একটি জমায়েত করায় অনেকে অবাক হয়েছেন।
তাবলিগ জামাত ভারতে মুসলমানদের বড় একটি সংগঠন। দেশটিতে সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে মুসলমানরা এখন কোথাও সঙ্ঘবদ্ধ না। সরকার ও উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলোর আক্রমণে সব জায়গায় মুসলমানরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। ভারতজুড়েই মুসলমানরা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক শক্তি হারিয়ে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছেন। সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে ভারত সরকারও নানা কালাকানুন চাপিয়ে দিচ্ছে। সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানরা অধিকারহীন হয়ে পড়ছেন। সম্প্রতি আমরা দেখলাম, দিল্লিতে ঠাণ্ডামাথায় দাঙ্গা বাধিয়ে মুসলমানদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। এ ধরনের রায়টের মূল লক্ষ্য মুসলমানদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেয়া। যাতে করে সামান্য প্রতিবাদ করার যে গণতান্ত্রিক অধিকার তা-ও মুসলমানদের না করে। সেই অর্থে ভারতের বর্তমান সরকার ও বিজেপির সাম্প্রদায়িক অঙ্গসংগঠনগুলো সফল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা দুর্গত মুসলমানদের এলাকা পরিদর্শন করেননি। কোনো ধরনের সমবেদনা প্রকাশ করেননি। এতে বার্তা পরিষ্কার, ‘তোমরা এ দেশে থাকলে পদানত হয়ে থাকো। অধিকারের কথা বলতে পারবে না।’
একটি সম্প্রদায়ের নিজেদের বিশ্বাসের চর্চার জন্য প্রথমত দরকার তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করা। ভারতে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। তাবলিগ একটি সংগঠন হিসেবে টিকে থাকার মধ্যে শেষ পর্যন্ত কী গুরুত্ব থাকতে পারে। যদি একসময় সেই দেশ থেকে মুসলমানরা উচ্ছেদ হয়ে যায়? যাদের নিয়ে বড় বড় জমায়েত করা হচ্ছে তারা যদি বাড়িঘরে ফিরে যেতে না পারেন, কিংবা বাড়িতে গিয়ে যদি তারা দেখতে পান তারা বহিষ্কৃৃত হয়েছেন। নিজামুদ্দিনে জমায়েতের পর ভারতে এমন ঘটনা ঘটেছে। সংগঠনের এক নম্বর অগ্রাধিকার থাকা উচিত সদস্যদের অস্তিত্ব বজায় রাখার কর্মসূচি। বৈশ্বিক মহামারীর মধ্যে নিজামুদ্দিনে আয়োজিত জমায়েত এখন ব্যবহৃত হচ্ছে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিপন্ন করার কাজে।
মুসলিম কারা, তাদের বৈশিষ্ট্যই বা কী? নবী মুহাম্মদ সা:-এর আগমনের সমসাময়িক ইতিহাস থেকে তা বুঝে নেয়া যায়। মানুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার তাগিদ কতটা জরোলো ছিল, সেই সময়টা প্রমাণ হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছে। মুহাম্মদ সা:-এর আগমনে একটি অজ্ঞ ও মূর্খ সমাজ আলোকিত হয়ে যায়। বর্বরদের মধ্যে উন্নত সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলন হয়। তখনকার সবচেয়ে বড় দুটো সভ্যতা এর সংস্পর্শে এসে অল্প দিনের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এর কারণ যদি তলোয়ার মনে করা হয়, সেটি ভুল হবে। রোমান বা পারস্যকে আরবের পেছনে পড়া প্রাচীন অসভ্য মানুষরা তলোয়ার দিয়ে কাবু করে ফেলবে তা কখনো যৌক্তিক নয়। কার্যত দুটো রাজশক্তির পতন হয়েছিল উচ্চমানের সংস্কার-সংশোধন আন্দোলনের কাছে।
আজ ভারতে মুসলমানদের অস্পৃশ্য বলা হচ্ছে। তারা এতটাই সেখানে নীচ, সংখ্যাগুরুদের অনেকের ধারণায় ‘ভাইরাসের পছন্দ’। উগ্র হিন্দুদের প্রচারণায় তারা জীবাণু বহনকারী আদমি। জীবাণুকে ভয় পাওয়ার কথা বলছে না। তারা ভীতি ছড়িয়ে দিচ্ছে জীবাণু ছড়ানো মুসলমানদের বিরুদ্ধে। এমন দুর্ভোগ ও তাচ্ছিল্যের পাত্র হওয়া থেকে কারা সে দেশের মুসলমানদের রক্ষা করবে। তাবলিগ জামাত চরম দুর্দিনে হাজার হাজার মানুষের সামগম ঘটিয়ে মুসলমানদের দুরবস্থাকে আরো ত্বরান্বিত করার সুযোগ করে দিয়েছে।
বিজেপি যখন দেশটিতে একের পর এক মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে, প্রতিবেশী বাংলাদেশের সাথে তাদের বন্ধুত্ব তখন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে দেশের মুসলিম নিপীড়নের মধ্যেই বাংলাদেশের সাথে নানা চুক্তি হচ্ছে, নানা সহযোগিতা গড়ে উঠছে। প্রতিবেশী মুসলমানরা ভারতে মুসলমান নির্যাতনকারী শাসকদের সাথে মধুর সম্পর্ক গড়ে নিচ্ছেন। উচ্চ গভীর সম্পর্কের দোহাই দিয়ে একবারো তারা ভারতের মুসলমানদের জন্য একটু স্বস্তির পরিবেশ তৈরি করার চাপ দিতে পারে না ভারত সরকারকে। মুসলমানদের ভ্রাতৃসম্পর্ক এখন তলানিতে ঠেকেছে। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ বরং উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের সমর্থক হয়ে থেকেছে।
নিজামুদ্দিনে জড়ো মুসলমানদের অনেকে করোনায় আক্রান্ত হন। ঠিক এ ধরনের একটি সুযোগ মৌলবাদি গোষ্ঠী নিজেদের ফসল তোলার জন্য ব্যবহার করেছে। বিজেপি সরকার ওই মুসলমান ‘সাধুদের’ অনেকের বিরুদ্ধে এ সুযোগে মামলা করেছে। আর নিজেদের কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, মুসলমানরা ভাইরাস ছড়াচ্ছে। ‘করোনা টেররিজম’, ‘করোনা জিহাদ’ নামে সামাজিক মাধ্যমে হ্যাশটেগ দিচ্ছে তারা। তাবলিগ জামাতের অসময়োচিত এই মানুষ জড়ো করার কর্মসূচিকে পুরো মুসলমান সমাজকে উচ্ছেদ ও নির্যাতনের কাজে সারা ভারতে ব্যবহার করা হচ্ছে। উপমহাদেশে তবলিগের বড় বড় জামাত হয়। তাদের রয়েছে বিপুল সদস্যসংখ্যা। এ বিশাল সংগঠন সামাজিক, রাজনৈতিক ও নাগরিক দাবি নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে ভারতের মুসলমানরা তাদের দাবি জোরের সাথে উত্থাপন ও আদায় করার সুযোগ পেত। শুধু উপমাহদেশ নয়, সারা বিশ্বে তাবলিগের সদস্যদের বিপুল সংখ্যা মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় কোনো কাজে আসে না।
ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি হাসপাতাল এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দেয়, মুসলিম রোগীদের প্রমাণ করতে হবে তারা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত নন। এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বৃহৎ ধর্মীয় গোষ্ঠী হিন্দুদের এমন প্রমাণ দেয়ার কথা উল্লেখ করেনি। তাদের বিজ্ঞাপনের টোন হচ্ছেÑ এই ছোঁয়াচে রোগে কেবল মুসলমানরা আক্রান্ত হতে পারে। কারণ এ রোগ নি¤œবর্ণের ধর্মীয় অস্পৃশ্যদের আক্রান্ত করে। অন্তত তাদের বিজ্ঞাপনের সাম্প্রদায়িক স্টাইল থেকে তাই মনে হয়। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের উন্নাসিকতা বুঝতে পেরে এই বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে নেয়।
‘নভেল করোনা মুসলমানদের দিয়ে ছড়ানো একটি জীবাণু’ এই হেইট ক্যাম্পইন পুরো ভারতে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মুসলিমদেরই ভাইরাস হিসেবে সেখানে ট্রিট করা হচ্ছে। ছোট গ্রাম থেকে বড় শহর এমনকি রাজধানী দিল্লিতে পর্যন্ত এর হিংসাত্মক প্রভাব পড়েছে। এ সুযোগে মুসলমানদের নির্বিচারে মারধর করা হচ্ছে। গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। আগে থেকে শুরু হওয়া সামাজিক বয়কট এ সুযোগে আরো জোরদার করা হয়েছে। অনেককে তাদের বসতবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকে বাড়িঘরে ফিরতে পারছেন না। অনেককে তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী যাতে তাদের ব্যবসা দোকানপাট চালাতে না পারেন সেই নির্দয় ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায় করোনাকালে ভারত সরকারের সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিরদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি একটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সরকার সাম্প্রদায়িক বিভক্তি উসকে দেয়ার কাজে ব্যবহার করছে করোনা ইস্যু। তিনি বলছেন, ভারত শুধু কোভিড-১৯ সঙ্কটে নয়, বরং এর সাথে এ থেকে সৃষ্ট মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা সঙ্কটেও ভুগছে। তিনি আহ্বান জানান, বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত মোদিকে মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত রাখা।
jjshim146@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা