নোয়াম চমস্কির ভাইরাস পরবর্তী আশঙ্কিত বিশ্ব
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ১৫ এপ্রিল ২০২০, ২১:০৮
বিশ্ববিশ্রুত মার্কিন প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি করোনাভাইরাস তথা কোভিড-১৯ আক্রান্ত ও পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে তার আশা ও আশঙ্কার কথা বলেছেন। নিজ কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন থাকা ৯১ বছর বয়সী এই বুদ্ধিজীবী গত ২৮ মার্চ ক্রোয়েশিয়ার দার্শনিক ও লেখক সার্কো হর্ভাটকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ সব কথা বলেন। বর্তমান মহামারীর দায়দায়িত্ব ও পরবর্তী বিশ্বের অবস্থা কেমন হবে- এটা ছিল তার বক্তব্যের মূল বিষয়। তিনি তার আলোচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পাশ্চাত্য বিশ্বের সমালোচনা করেন। তিনি এই সময়ে ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ ব্যবস্থার প্রতিবাদ করেন। বামধারায় বিশ্বাসী এই নবতিপর দার্শনিক ভাইরাস পরবর্তী বিশ্বে পুঁজিবাদের অবস্থান নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি মন্তব্য করেন, করোনাভাইরাস সঙ্কট নয়া উদারতাবাদের শেষ ফসল।
এই সাক্ষাৎকারে নোয়াম চমস্কি পাশ্চাত্যের সমালোচনা করে বলেন, এই মহামারী ঠেকানো যেত। এ সম্পর্কে আগে থেকেই তথ্য ছিল। এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ঠিক আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়ে ছিল যে, এ ধরনের একটি মহামারী দেখা দিতে পারে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সাথে যৌথ উদ্যোগে করা জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটির ‘ইভেন্ট-২০১’ নামের এক গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি দাবি করেন, করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় আসলে কিছুই করা হয়নি। ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে হাতের কাছে থাকা তথ্যে মনোযোগ দেয়া হয়নি। এতে সঙ্কট আরো জটিল হয়ে উঠেছে। চমস্কি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একদিন বললেন, এটা কোনো সঙ্কটই নয়। এটি সাধারণ ফ্লুর মতো। পরদিন তিনি বললেন, এখন ভয়াবহ সঙ্কটের সময় এবং আমি সবই জানতাম।’ এ ধরনের বৈপরীত্য সঙ্কটকে যে তীব্র করে তুলেছে তা সহজেই বোধগম্য। চমস্কি আরো বলেন, চীনের বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাস সম্পর্কে তথ্য দেয়ার পর কিছু ভাইরাস বিশেষজ্ঞসহ অন্যরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনের অপেক্ষা করতে থাকেন। তারা এই ভাইরাস সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তারা এটাও জানতেন, সামনে এই ভাইরাস মোকাবেলা করতে হবে। বিশে^র একজন বিবেক বলে কথিত চমস্কি প্রশ্ন করেন, তারা কি কোনো পদক্ষেপ নিয়ে ছিলেন? মার্কিন এই চিন্তাবিদ বলেন, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুর পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছিল। ইউরোপে কিছু ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছে।
জার্মানি অনেকটা স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেদের রক্ষা করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা রোগ নির্ণয় কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়েছে, যাতে সহজেই করোনা পরীক্ষা করা সম্ভব হয়। অন্য দেশগুলো স্র্রেফ উপেক্ষা করেছে, যার খেসারত দিচ্ছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশ। এখানে প্রায় ছয় লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ২৪ হাজার মানুষ। পৃথিবীর ২১০টি দেশ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। প্রায় এক লাখ ১৪ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এসব ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করে নোয়াম চমস্কি পরবর্তী আরো বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমরা মানবসভ্যতার সবচেয়ে বিপর্যয়ের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছি। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার সহযোগীরা সর্বনাশের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। পৃথিবী দুটো ভয়াবহতার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। প্রথমটি হলো পারমাণবিক যুদ্ধ, আর দ্বিতীয়টি হলো বৈশি^ক উষ্ণতার আশঙ্কা। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা একদিন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু অন্য দুটো আশঙ্কা থেকে পৃথিবী মুক্ত হবে না। সব শেষ হয়ে যাবে। তিনি ট্রাম্পের ইরান নীতির তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ইরান যখন হাজার হাজার মৃত্যু নিয়ে ভাইরাস মোকাবেলা করছে, তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানকে শায়েস্তা করার জন্য অবরোধ অব্যাহত রেখেছেন। এতে জনগণের দুঃখ-কষ্ট আরো বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপর্যয়কর অবরোধ চাপিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং প্রভুসুলভ মনোভাব নিয়ে অন্যদের তা করতে বাধ্য করছে। এভাবে ইরানকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে নিক্ষেপ করেছে। নোয়াম চমস্কি প্রশ্ন উত্থাপন করেন- কেন এই করোনাভাইরাস সঙ্কট? এটা হচ্ছে বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক ব্যর্থতা। এটি হচ্ছে বাজার অর্থনীতির বাড়াবাড়ি। এতে অনৈতিক নয়া উদারতাবাদের গভীর সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যা প্রতিভাত রয়েছে।
আশঙ্কার সাথে নোয়াম চমস্কি আশার কথাও ব্যক্ত করেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, নয়া উদারতাবাদ অবশেষে আশার কারণ রয়েছে। করোনাভাইরাসের একটা ভালো দিক হলো- মানুষ এটা ভাবতে বাধ্য হবে যে, আমরা বসবাসের জন্য কী ধরনের পৃথিবী চাই? দীর্ঘ দিন ধরে ভাইরাসের আশঙ্কা করছিল পৃথিবী। ১৫ বছর আগে সার্স মহামারী এসেছিল।
এর প্রতিষেধকও আবিষ্কৃত হয়েছিল। পরবর্তী মহামারীর আশঙ্কা সত্ত্বেও পৃথিবীর গবেষণাগারগুলো এ ধরনের ভাইরাসকে প্রতিহত করার জন্য গবেষণায় লিপ্ত হয়নি। তার কারণ, বাজার অর্থনীতি। বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো ভাইরাস প্রতিষেধক আবিষ্কারে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দেখেনি। এভাবে আমরা বেসরকারি স্বৈরাচারের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছি। এরই নাম বহুজাতিক করপোরেশন। এরা জনগণের কাছে জবাবদিহি করে না। এদের কাছে ভাইরাস প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেয়ে শরীরের জন্য নতুন ক্রিম আবিষ্কার অধিকতর লাভজনক। জনগণের ধ্বংসের চেয়ে মুনাফা তাদের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৫০ দশকের পোলিও মহামারীর কথা স্মরণ করেন। সে সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সলক’ প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের ফলে জনগণ এই রোগ থেকে রক্ষা পায়। এবারো এ ধরনের ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু নয়া উদারতাবাদের ‘প্লেগ’ সরকারকে তা করতে দেয়নি। করোনাভাইরাস প্রতিহতকরণে ব্যবহৃত যুদ্ধকালীন ভাষা ও টার্ম ব্যবহার সম্পর্কে তার মতামত চাওয়া হলে তিনি এর যৌক্তিকতার পক্ষে মত দেন। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস করোনাভাইরাস সঙ্কটকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে অভিহিত করেছেন। নোয়াম চমস্কি তার সাথে একমত পোষণ করেন। তিনি করোনাভাইরাস পরবর্তী মন্তব্য করেন, চরম কর্তৃত্ববাদী নিষ্ঠুর রাষ্ট্রগুলো সমাজের আশু পুনর্গঠন এবং অধিকতর মানবিকতা প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। তিনি মন্তব্য করেন- আমাদের মনে রাখতে হবে, চরম কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলো কথিত নয়া উদারতাবাদের প্রতিরূপ।
নোয়াম চমস্কি করোনাভাইরাসের মতো মহামারীকে গরিব দেশ ও গরিব মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সঙ্কট বলে মনে করেন। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশের পক্ষে মহামারী পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করা সম্ভব, কিন্তু যে সব দেশে সাধারণ মানুষ দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বসবাস করে তাদের অবস্থা ভিন্নতর। টোটাল লকডাউন বা সর্বাত্মক বিচ্ছিন্নতার সময়ে গরিব মানুষ খুবই অসহায় হয়ে পড়ে। এ সময়ে তাদের সাহায্যের জন্য ধনী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আর ধনী রাষ্ট্রগুলোর উচিত, বিশ^সভ্যতার এই পর্যায়ে গরিব দেশগুলোর জন্য অনৈতিক অবরোধ এবং সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার পরিবর্তে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করা। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য মানুষকে সম্ভাব্য সব উপায়ে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বর্তমান গণমাধ্যম ব্যক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেয়ে বিচ্ছিন্নকরণে সক্রিয় রয়েছে। তিনি এ ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির চরম বিকাশকে দায়ী করেন।
তিনি উল্লেখ করেন, মোবাইল ফোন বিশেষত নতুন প্রজন্মকে অধিকতর বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। এ প্রসঙ্গে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে স্বআরোপিত সংস্কৃতির সমালোচনা করেন। তিনি সামাজিক বন্ধন জোরদার করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, বর্তমান ভাইরাসজনিত বিচ্ছিন্নতার চেয়ে প্রযুক্তিগত বিচ্ছিন্নতা হচ্ছে প্রকৃত বিচ্ছিন্নতা। যেভাবেই হোক- সাংগঠনিক পরিধি বাড়িয়ে, সমাজের গতিশীলতা বৃদ্ধি করে, কর্মের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করে এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে- ‘মানুষকে একীভূত করতে হবে’। মানুষ যে সমস্যা মোকাবেলা করছে- পরামর্শ দিয়ে, সহায়তা দিয়ে এবং কাজের মধ্যেমে মানুষকে উজ্জীবিত করতে হবে।
নোয়াম চমস্কির ভাষায়, উপর্যুক্ত আলোচনা বর্তমান সময়ে ও সভ্যতার যথার্থ চিত্র তুলে ধরে। অপ্রিয় সত্য কথা বলার জন্য তার জুড়ি নেই। গোটা পৃথিবীর নাগরিক সাধারণ্যে রয়েছে তার আকাশছোঁয়া গ্রহণযোগ্যতা। করোনাভাইরাসের এই সময়ে এবং ভাইরাস উত্তীর্ণ পর্যায়ে তার কথা ও পরামর্শ আমাদের আলোকবর্তিকা স্বরূপ- এই আমাদের ব্রত হোক।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা