করোনা : মহামন্দা ও খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কা!
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ০৭ এপ্রিল ২০২০, ২১:১৯
করোনাভাইরাসে এরই মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে পুরো বিশ্ব। ২০৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা ৭০ হাজারের কাছাকাছি। উৎপত্তিস্থল চীন ছাড়া আর কোনো দেশেই এর তীব্রতা কমেনি। বরং বাড়ছে। এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার করা যায়নি। তাই সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র উপায় হলো, মানুষে মানুষে শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করা। সে জন্য আক্রান্তদের যেমন বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে তেমনি অন্য সব মানুষকে ঘরে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, বাজার-ঘাট, শপিংমল। বন্ধ হয়ে গেছে বিমান চলাচল, সামাজিক সভা-সমাবেশ, ক্রীড়া অনুষ্ঠান, নৌ-চলাচল, দেশের অভ্যন্তরের সব যানবাহন।
এর ফলে বন্ধ হয়ে গেছে যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বিশ্বের ইতিহাসে অভূতপূর্ব এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে এক মহামন্দার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। বলা হচ্ছে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতিতে যে সঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল, এবারের করোনাভাইরাসের ফলেও ঠিক একই ধরনের সঙ্কট দেখা দেবে। কেউ কেউ বলছেন, মহামন্দা দেখা দিতে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনৈতিক ইতিহাসের অধ্যাপক আলব্রেখট রিচেল ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, দুই বিশ্বযুদ্ধ দুনিয়ার অর্থনীতিকে যে সঙ্কটে ফেলেছিল, করোনাভাইরাসের কারণে সেরকম সঙ্কট দেখা দেবে। রিচেল বলেন, ১৯৩০ এর দশকের শুরুতে যে মহামন্দা দেখা দিয়েছিল এটা তার থেকেও খারাপ হতে পারে।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের যেসব আলামত যেমন, চাহিদা কমে যাওয়া, উৎপাদনে অতিমন্দা, বেকারত্ব অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, আর্থিক সঙ্কট এবং তারপর প্রবল ঋণ সঙ্কট ইত্যাদি বিশ্বকে গ্রাস করতে যাচ্ছে। কিভাবে এবং কত দিনে এই অচলাবস্থার অবসান হবে সেটাও কেউ বলতে পারছে না। জাতিসঙ্ঘ বলছে, করোনার সংক্রমণ বন্ধ হলেও এরপর বিশ্বজুড়ে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে। লকডাউন কত দিন স্থায়ী হবে সে সম্পর্কে কোনো রকম ধারণা না থাকায় দেশে দেশে বিত্তবান মানুষ সবার আগে খাদ্য মজুদের দিকে ঝুঁকেছে। তারা প্রয়োজনের চেয়েও বেশি খাদ্য মজুদ করছে। ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হতে পারে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম) এক প্রতিবেদনে বলেছে, গোটা বিশ্বের কোনো প্রান্তেই খাদ্য জোগানের কোনো অভাব নেই। কিন্তু লকডাউনের মেয়াদ যদি বাড়ানো হয়, আর বিত্তশালী ও খাদ্য সরবরাহকারীরা যদি আতঙ্কে অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ করতে শুরু করেন, তা হলে অদূর ভবিষ্যতে খাবার পাবেন না দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ। বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার গরিব দেশগুলো এতে প্রবল সমস্যায় পড়বে। এই পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, সে জন্য সব দেশের সরকারকে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কড়া নজরদারি করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। খাবার নিয়ে যাতে কোনো ধরনের কালোবাজারি না হয় সে দিকেও নজর দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্বের সব দেশের সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে লেখা নিবন্ধে তিনি বলেন, করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যর্থ হলে এর প্রভাবে সারা বিশ্বে আগুন জ্বলতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, করোনার পরে বিশ্ব আর কখনোই একই রকম থাকবে না।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রভাব কতটা পড়তে পারে সে বিষয়েও বিশেষজ্ঞরা কথা বলছেন। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। চাকরি হারাতে পারেন অনেক মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রফতানি আয় এমনিতেই পড়তির দিকে। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমেছে চার দশমিক সাত নয় ভাগ। অব্যাহতভাবে কমেছে পোশাক রফতানি। কারণ আমাদের তৈরী পোশাকের প্রধান আমদানিকারক হলো ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। করোনাভাইরাসের কারণে পুরো ইউরোপ ও আমেরিকার অবস্থা খুবই নাজুক। বাংলাদেশের পোশাক রফতানির ৬২ ভাগ যায় ইউরোপে আর ১৮ ভাগ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। স্বাভাবিকভাবেই রফতানিতে ধস নেমেছে। তৈরী পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই নি¤œমুখী। তার মধ্যেও ভালো করছিল রেমিট্যান্স। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১০৪২ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ ভাগ বেশি। এই গতি ধরে রাখা এখন কঠিন হয়ে যাবে বাংলাদেশের জন্য। যেসব দেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ। সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশী শ্রমিক বা ব্যবসায়ীরা কর্মচ্যুত হলে দেশে পরিবারের কাছে আগের মতো টাকা পাঠাতে পারবেন না। তাই স্বভাবতই রেমিট্যান্স কমতে থাকবে। এর প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।
আমরা জানি, দেশের অর্থনীতির প্রধান দু’টি খাত হলো তৈরী পোশাক রফতানি ও প্রবাসী আয়। রফতানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প-কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। অন্য দিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে না পারলে তাদের পরিবার আর আগের মতো খরচ করতে পারবেন না। অর্থাৎ তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসাবাণিজ্যে। কমে যাবে বেচাকেনা। আর চাহিদা কমে গেলে পণ্য প্রস্তুকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তীর মুখে পড়বে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এরই মধ্যে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি হতে পারে ৩০০ কোটি ডলারের মতো। আর চাকরি হারাতে পারে প্রায় ৯ লাখ মানুষ। এতে করে জিডিপি কমে যেতে পারে এক দশমিক এক ভাগ।
তবে আমাদের উদ্বেগের জায়গাটি কিন্তু খাদ্যসামগ্রীর সম্ভাব্য সঙ্কট নিয়ে। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রকোপে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভোক্তারা ঝুঁকেছেন অতিরিক্ত খাবার মজুদের দিকে। অনেক দেশও আপৎকালীন পরিস্থিতি সামলে ওঠার লক্ষ্যে খাদ্যপণ্য রফতানি বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করেছে। একই পথে হাঁটছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডের মতো এশিয়ার শীর্ষ চাল রফতানিকারক দেশগুলো। ফলে এ অঞ্চল থেকে চালের রফতানি হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে অনেক দেশ চরম খাদ্য সঙ্কটে পড়বে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। এফএও’র জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ডেভিড ডাউই বলেন, কোনো কোনো দেশ খাদ্য রফতানি বন্ধ করলে বিশ্ববাজারে খাদ্য-ঘাটতি দেখা দিতে পারে। জানা যাচ্ছে, করোনা মহামারীর প্রভাবে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সম্প্রতি ভিয়েতনাম চালের নতুন বিক্রয় চুক্তি সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। শীর্ষ চাল রফতানিকারক দেশগুলোর তালিকায় ভিয়েতনামের অবস্থান তৃতীয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত চালের রফতানি নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন। ভিয়েতনাম ছাড়াও চালের রফতানি সাময়িকভাবে বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ চাল রফতানিকারক দেশ কম্বোডিয়াও। একই আভাস দিয়েছে মিয়ানমারও।
এশিয়া অঞ্চলের চালের বাজার বিশ্লেষক ডেভিড ডাউই বলেন, এশিয়ার দেশগুলো খুব একটা সতর্ক না হয়েই চালের রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তারা কেবল নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইছে।
অন্য দিকে অনেক দেশ আবার মনোনিবেশ করেছে বাড়তি আমদানির দিকে। ফিলিপাইন এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ। করোনাভাইরাসের প্রকোপে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কায় দেশটি চালের আমদানি বাড়াচ্ছে। বর্তমান বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ বাজার সামলে নিতে চীন এ বছর রেকর্ড পরিমাণ চাল কিনতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বিশ্বজুড়ে চালের রফতানি চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় দামও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মার্চে থাইল্যান্ডের ৫ শতাংশ ভাঙা চালের রফতানিমূল্য বেড়ে টনপ্রতি ৫১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা ২০১৩ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ রফতানি মূল্য।
বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে স্বয়ম্ভর দেশ। গত ১৫ মার্চ পর্যন্ত দেশে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ৪৯৫ টন। এর মধ্যে গম আছে তিন লাখ ১৯ হাজার টন। বাকি ১৪ লাখ ২০ হাজার টন চাল। ফলে দেশে খাদ্য সঙ্কট নেই। তেমন সম্ভাবনাও নেই বলে মনে করছেন সরকার। আমরা আশ্বস্ত থাকতে চাই যে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেশে খাদ্য নিয়ে কোনো রকম সঙ্কট দেখা দেবে না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা