যা প্রত্যাশা ছিল বিচার বিভাগ থেকে
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ০৪ এপ্রিল ২০২০, ০৭:০১
অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২৫ মাস কারাভোগের পর ২৫ মার্চ ২০২০ পিজি হাসপাতাল থেকে মুক্ত হয়ে নিজ বাসভবন গুলশানের ফিরোজা ভবনে গেলেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারা মোতাবেক নির্বাহী আদেশে তার দণ্ড স্থগিত করা হয়েছে। পত্রপত্রিকার ভাষ্যমতে, সরকারের দেয়া মুক্তির আদেশটি শর্ত সাপেক্ষে যথাÑ ক. ৬ মাসের জন্য সাজা স্থগিত, খ. বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে, গ. উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারবেন না।
১/১১ সরকারের সময় দুদকের দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট শিরোনামে পরিচিত দুই মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনকে সাজা দেয়া হয়েছে। তিনি মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আইনগত সব প্রচেষ্টা সম্পন্ন করেছেন, সবকিছু জেনেশুনে লন্ডন থেকে চলে এসে রায়ের দিন আদালতে উপস্থিত হয়েছেন, কিন্তু খালাস পাননি। অধিকন্তু হাইকোর্টের রায়ে জিয়া অরফানেজ মামলায় সাজা পাঁচ বছরের স্থলে ১০ বছরে উন্নীত করা হয়েছে। অথচ তারই (বেগম জিয়া) কাউন্টার পার্টি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে দুদকের দায়ের করা সব মামলা থেকে বিচার বিভাগ অব্যাহতি দিয়েছেন। নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক ৬ মাসের সাজা স্থগিত করে বেগম জিয়ার প্যারোলে মুক্তি দেয়ার বিষয়টি আমরা যেভাবেই দেখি না কেন; মোটা দাগে এটাই বিবেচ্য যে, সাময়িক মুক্তির প্রশ্নে নির্বাহী বিভাগ মানবিক বিষয়টি মূল্যায়ন করেছে বটে, কিন্তু জামিনের প্রশ্নে যা বিবেচনা করতে পারেনি আমাদের বিচার বিভাগ। [অথচ দৃশ্যত যাই হোক না কেন, কাগজে কলমে এবং সাংবিধানিকভাবে বিচার বিভাগ স্বাধীন(!)] এ জন্য শত হাজার বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ না জানালে কৃপণতা করা হবে। আরো ধন্যবাদ জানাতে হবে ম্যাডামের বড় বোন সেলিমা ইসলাম, ভাই শামীম ইসকান্দার ও ম্যাডামের পরিবারকে; দিন শেষে বিএনপি এ মর্মে কোনো ক্রেডিট নিতে পারেনি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, আপসহীন নেত্রী বেগম জিয়া নিজেও প্যারোলে মুক্তি চাননি, তিনি ও বিএনপি চেয়েছিল একজন বিচারপ্রার্থী হিসেবে ‘জামিন’ নামক অধিকারের বাস্তবায়ন। এ জন্য বারবার বিচার বিভাগের দারস্থ হয়েও কোনো লাভ হয়নি। বরং আশাহত হয়েছেন নেতাকর্মী এবং বিতর্কের বেড়াজালে জড়িয়েছে বিচার বিভাগ; যার জন্য বারবারই অভিযোগ করা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কারণে বেগম জিয়ার জামিন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার থেকে বারবার কথাগুলো অস্বীকার করলেও দিন শেষে এটাই প্রমাণিত হলো যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কারামুক্তির চাবিকাঠি প্রধানমন্ত্রীর হাতেই বন্দী ছিল। অন্য দিকে, এটাও প্রতীয়মান হয়েছে যে, বিচার বিভাগ বেগম জিয়ার কারামুক্তির (জামিন) দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিতে চায়নি।
আমাদের বিচারব্যবস্থায় সুপ্রিম কোর্ট (অ্যাপিলেট ও হাইকোর্ট ডিভিশন) সাংবিধানিক আদালত নামে প্রতিষ্ঠিত। নির্বাহী বিভাগের প্রস্তাবে প্রণীত আইন সংবিধান, সামাজিক ন্যায়বিচার বা জনগণের জীবনযাত্রার চাহিদার পরিপন্থী হলে উচ্চ আদালত সংশ্লিষ্ট আইন বা আইনের অংশ রদ ও রহিত করতে পারেন। অন্য দিকে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সাজা দেয়াই কি বিচার বিভাগের একমাত্র দায়িত্ব। ‘আইন’ হলো নির্বাহী বিভাগের প্রোডাক্ট, অন্য দিকে ‘বিচার’ হলো বিবেক থেকে উৎপাদিত জবাবদিহিতামূলক একটি সিদ্ধান্ত, যা সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক। নির্বাহী বিভাগ রাজি খুশি থাকতেই হবে এমন কোনো দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপর বর্তায় না।
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে প্রদত্ত ‘মৌলিক অধিকার’ মূলত কার্যকর নেই। তবুও বলা যায়, যদি মৌলিক অধিকারগুলো নির্বাহী ক্ষমতার দাপটে অসহায় হয়ে না পড়ত তবে সংবিধানটি গণমানুষের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারত (!)। সংবিধানের ‘প্রস্তাবনার’ তৃতীয় ভাগে বলা হয়েছে যে, ‘আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাÑ যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক, সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ উল্লেখ্য, সংবিধানে শুধু ‘বিচার’ নয় ‘সুবিচার’ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ‘মৌলিক মানবাধিকারের’ প্রতি গুরুত্ব অর্পণ করা হয়েছে। ‘সুবিচারই’ সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে; অন্যথায় সৃষ্টি হয় স্বৈরাচার তথা একনায়কতন্ত্র।
রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান যখন কোনো একটি বিষয়ে আইন প্রণয়নের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তখন তিনি এমনিভাবে আইন প্রণয়ন করেন যাতে মনে হয় যে, তারা কোনো দিন ক্ষমতাচ্যুত হবেন না অথবা তারই প্রণীত আইন কোনো দিন তার বিপক্ষে যেতে পারে এ কথা কেউ তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় না। কারণ আশপাশে বিজ্ঞ, মহাবিজ্ঞ, রথী, মহারথীরা যারাই থাকে, তাদের একমাত্র কাজ হলোÑ নির্বাহী প্রধানের আজ্ঞাবহ থেকে জি হুজুর, জাঁহাপনা বলে নিজের অবস্থান কর্তার কাছে সুদৃঢ় রাখা।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ (দুদক আইন) বিএনপি সরকার প্রণয়ন করেছে। এতে দুদক কর্মচারীদের প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন। সেখানে দুর্নীতি ও ঘুষ কি তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি, শুধু বলা হয়েছে যে, ১৯৪৭ সালের প্রণীত আইনে প্রদত্ত ব্যাখ্যাই দুর্নীতি। ঘুষ গ্রহীতাকে দোষী করা হলেও ‘ঘুষ’দাতাকে করা হয়েছে বাদি বা সাক্ষী। অথচ ‘ঘুষ’দাতাই সংশ্লিষ্ট দুর্নীতির সবচেয়ে বেশি লাভবান, ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র। অথচ সেই ঘুষদাতাকে আইনের আওতায় আনা হয়নি, দুর্নীতি থেকে উপার্জিত তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয় না। ১৯৪৭ সালের আইনে দুর্নীতির সর্বোচ্চ সাজা নির্ধারিত ছিল সাত বছর, বিএনপি যা বাড়িয়ে করেছে ১০ বছর। এখন নিজেদের গড়া সেই দুদক আইনেই ফেঁসে যাচ্ছেন বিএনপি নেতারা।
মাঝে মধ্যে হাতেগোনা আওয়ামী লীগারদের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করলেও পিরোজপুরের জেলা জজের মতো নাজেহাল হতে হয় বিচারককে। অন্য দিকে তারেক রহমানকে খালাস দেয়ায় বিচারক মোতাহার হোসেনকে দেশান্তরী হতে হয়েছে।
[অথচ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার ভাষায় লেখা রয়েছে যেÑ ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’] পক্ষান্তরে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা হাইকোর্টের নিজস্ব এখতিয়ার ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৫৬১ক সঙ্কুুচিত করে দুদক কর্মচারীদের ক্ষমতা দিয়েছিলেন আরো বাড়িয়ে। এখন নিজেই তিনি গ্যাড়াকলে আটকা পড়েছেন।
আইন প্রণেতার মনমর্জির ওপর বিচারকের কোনো দায়বদ্ধতা নেই; দায়বদ্ধতা রয়েছে সৃষ্টিকর্তা ও নিজ বিবেকের কাছে। শুধু আইন দিয়ে বা আইন প্রণেতাদের চাহিদা মোতাবেক যদি বিচারকরা ‘ন্যায়পরায়ণ’ হতো তবে শপথপূর্বকÑ এত সম্মানজনক বিচার বিভাগের প্রয়োজন ছিল না; এ দায়িত্ব থানার ওসিকে দিলেই হতো, উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনানির পর ধারা অনুযায়ী রায় বা সাজা দিলেই হতো বৈ কি! সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ, Legal system-এর ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয়।
দুদক আইনে দুদক কর্মচারীদের অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছ। যেমনÑ মামলা রুজু করবে দুদক, কিন্তু প্রমাণের দায়িত্ব তাদের নয়, বরং অভিযোগ খণ্ডাতে হবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে। অন্য দিকে ক্ষমতাসীন নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টি থেকেই যায়। কারণ দুদকের নিজস্ব কর্মচারী নেই। তাদের নিয়োগকর্তা নির্বাহী বিভাগ, প্রমোশন ও ট্রান্সফার সবই নির্বাহী প্রধানের মর্জির ওপর নির্ভরশীল।
তাছাড়া সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) তো নির্বাহী প্রধানের রক্ষাকবচ হিসেবে রয়েছেই। এ জন্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাষ্ট্রপতিকেও প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য নেই বলে সংবিধানই একনায়কতন্ত্রের জন্ম দিচ্ছে।
বেগম খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী থেকে আপাতত ৬ মাসের জন্য মুক্তি দিতে সরকার বয়স ও মানবাধিকার বা মানবতাকে উছিলা করেছে। বিগত ২৫ মাস সময় কি মানবতা ও বয়স বেগম জিয়ার জামিনে মুক্তির জন্য যথেষ্ট ছিল না? প্রধানমন্ত্রী তার মূল প্রতিপক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী বেগম জিয়া সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ কি সে সিদ্ধান্ত নিতে পারত না? এসব বিষয় যখন মাথায় ঘুরপাক খায় তখন কারো না কারো ওপর আস্থাহীন হয়ে পড়ি; জাতির পারসেপশন এর ব্যতিক্রম কিছু কি মনে করে? প্রশ্নগুলো নিজের মন-মগজে না রেখে জাতির বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিলাম, ভবিষ্যৎ ‘মৌলিক অধিকার’ বাস্তবায়নসম্পন্ন একটি বাংলাদেশ দেখার প্রত্যাশায়।
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ থেকে ৭৭৬ দিন কারাভোগ করে বেগম জিয়া আপাতত মুক্ত হলেন বটে, তবে আমার প্রত্যাশা সাজার স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়বে। তাকে আর কারাভোগ করতে হবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি বিদেশে যেতে পারবেন এবং তিনি সক্রিয় রাজনীতি করবেন। এটা আমার প্রত্যাশা, যার বাস্তবায়ন সময় বলে দেবে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারার ক্ষমতা বলে নির্বাহী আদেশে ছয় মাসের জন্য সাজা স্থগিত করে রাজনৈতিক কৌশলে শেখ হাসিনা বলটি তার কোর্টে নিয়ে গেলেন, যার সুযোগ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস। আমরা আশা করি, করোনাভাইরাস তো বটেই রাজনৈতিক ভাইরাস থেকে একদিন দেশ মুক্ত হবে, ইনশাআল্লাহ।লেখক : বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা