২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫ পৌষ ১৪৩১, ১৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আমলা উপাখ্যান ও ডিসির অনুতাপ

-

আমলানির্ভর সরকার বা রাষ্ট্র কখনোই কল্যাণমুখী হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের সরকারগুলোর আমলানির্ভরতা এখন খুবই উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। আর এর ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের মাধ্যমে। মূলত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর মন্ত্রী, এমপিসহ জনপ্রতিনিধিরা পুরোপুরি আমলানির্ভর হয়ে পড়েছেন বলে শোনা যায়। আগের দিনে আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করত সরকার। কিন্তু আমলারাই এখন সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। তারাই এখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। মূলত সরকার জনগণ নির্ভর না হয়ে আমলানির্ভর হওয়ায় এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গতকারণেই বলা চলে, মন্ত্রী-যন্ত্রীরা এখন শুধুই ‘নিধিরাম সর্দার’।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ জনপ্রশাসন বা আমলাতন্ত্র। সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে আমলাদেরই আইন ও বিধিবিধানের আওতায় মুখ্য ভূমিকা পালন করার কথা। কিন্তু রাজনীতিকদের উড়নচণ্ডী মনোভাবের কারণে যেমন রাজনীতির কক্ষচ্যুতি ঘটেছে, ঠিক তেমনিভাবে আমলাতন্ত্র নিজস্ব স্বকীয়তা, ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে। একশ্রেণীর অসাধু ও মূল্যবোধহীন আমলার কারণে পুরো আমলাতন্ত্রই এখন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে। আমলারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ও জনগণের সেবক হলেও তারাই এখন রাষ্ট্রের মালিক-মোক্তার বনে গেছেন। ফলে আমলাতন্ত্র এখন জনগণের সেবার পরিবর্তে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতাচর্চা ও আত্মপূজাকেই নিজেদের ধর্ম-কর্ম ও কর্তব্য বানিয়ে নিয়েছেন।

ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রে সিভিল সোসাইটি ও জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল স্বাধীন পাকিস্তানের আমলাতন্ত্রেও। আর স্বাধীন বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে বড় ধরনে বিচ্যুতি ঘটেছে। ব্রিটিশ ও ভারতের অভিজ্ঞতায় পাকিস্তানের আমলারা ছিলেন এলিট শ্রেণীর এবং রাজনীতিবিদদের চেয়েও অধিক দক্ষ ও যোগ্যতর। বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচকই হতে পারত, যদি আমলারা দায়িত্ব পালনে পেশাদারি, আইন, সংবিধান ও গণমানুষের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতেন। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই আমলাতন্ত্রে সে সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। ফলে জনপ্রশাসনে মূল্যবোধহীন আমলারা ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। আর সৎ, যোগ্য, প্রতিশ্রুতিশীল সরকারি কর্মকর্তারা প্রবঞ্চনা ও অবহেলার শিকার হচ্ছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে নির্বাচনের নামে প্রহসন চলছে এমন অভিযোগ অবান্তর নয়। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই প্রক্রিয়ার সাথে আমলাদের বড় একটি অংশ যেভাবে যুক্ত হয়েছেন এবং মিড নাইট নির্বাচনের কুশীলবের ভূমিকা পালন করেছেন, তা জাতি হিসেবে আমাদের সব অর্জনকেই ম্লান করে দিয়েছে। বিচ্যুতি ঘটেছে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের। আর আমলাতন্ত্রের এমন অধঃপতন আমাদের জাতিসত্তার ভিতকেই নড়বড়ে করে দিয়েছে।

মূলত আমলাতন্ত্রই সুশাসনের মূল চালিকাশক্তি। সরকার নির্বাচিত, অনির্বাচিত বা স্বৈরতান্ত্রিক যা-ই হোক দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা অরণ্যে রোদন বৈ কিছু নয়। যত ভালো নির্বাচনই হোকÑ অযোগ্য, অদক্ষ, অসৎ ও মূল্যবোধহীন আমলাদের দিয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা যায় না। যে দেশে নির্বাচনে কারচুপি এবং কর্মকর্তা নিয়োগে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতা হয়, সে রাষ্ট্রের বিপর্যয়ের ক্ষণগণনা ছাড়া কোনো উপায়ও থাকে না।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আমাদের দেশের আমলাতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। জনগণের পরিবর্তে রাষ্ট্র হয়ে পড়েছে সরকার ও আমলাতন্ত্রের যৌথ সম্পত্তি। সরকারের উদ্দেশ্য হলো আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রেখে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা। আর আমলাতন্ত্রও জনগণের ম্যান্ডেটহীন শক্তিকে ক্ষমতায় রেখে মনের মাধুরী মিশিয়ে আত্মপূজা সম্প্রসারণের চেষ্টায় ব্যস্ত। আর এই দ্বৈরথের কাছে পুরো জাতিই এখন রীতিমতো জিম্মি। ফলে সাধারণ মানুষের আর্তনাদ-আহাজারি ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকছে না।

ক্ষমতার স্বার্থে দেশে যেভাবে আমলাতন্ত্রকে দলীয়করণ করা হয়েছে বা হচ্ছে এবং অপ্রয়োজনে পদোন্নতিসহ বিভিন্নভাবে আমলাতোষণ করা হচ্ছে তাতে যেকোনো মুহূর্তে প্রশাসনে ব্যবস্থায় বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

সরকারের মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতা ও আমলা তোষণের কারণেই আমলাতন্ত্র ক্রমেই স্বেচ্ছাচারি হতে শুরু করেছে। ইদানীং একশ্রেণীর আমলা রীতিমতো ইন্দ্রীয় পূজায় লিপ্ত হয়েছেন। এসব অনৈতিক ঘটনায় উপসচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারাও জড়িত বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। আর এ কথা অজানা নয় যে, জামালপুরের জেলা প্রশাসক তো নিজের অফিসকক্ষেই রঙ্গশালা বানিয়েছিলেন। দেবাশীষ রায়ের মতো আমলা অফিসকক্ষে নারী ধর্ষণ করে ভারতে পালানোর সুযোগও পেয়েছিলেন। এমনকি আমলাদের যৌন হয়রানির প্রতিকার চেয়ে আদালতে মামলার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এসব অভিযুক্ত আমলা শাস্তি পেয়েছেন বলে কখনো জানা যায়নি। বড়জোর বদলি/ওএসডি/প্রত্যাহারের মধ্যে থেকেছে এদের শাস্তিপ্রক্রিয়া।

অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই এসব আমলা ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছেন। আর সে ধারাবাহিকতায় কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন কর্তৃক সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হলে রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এমনকি দৈনিক যুগান্তর অনলাইনে প্রকাশিত সাংবাদিক আরিফুলের সাথে মোবাইল কথোপকথনের অডিওসহ প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে ওই ঘটনার সাথে ডিসির সম্পৃক্ততার আত্মস্বীকৃতিও মিলেছে। মোবাইলে কথোপকথনের ঘটনার জন্য ডিসিকে ভিকটিমের কাছে অনুতাপ করতেও দেখা গেছে।

কুড়িগ্রামের স্থানীয় সূত্র জানা গেছে, গত বছরের মাঝামাঝি জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে একটা রিপোর্ট করেছিলেন সাংবাদিক আরিফ। এ ছাড়া সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে রিপোর্ট করতে চেয়েছিলেন তিনি। এসব কারণে ডিসি তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। আর তার বিরুদ্ধে মাদকের যে অভিযোগ দেয়া হয়েছে, তা আদৌ সত্য নয়। জেলা প্রশাসক তার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাচরিতার্থ করতেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাকে নাজেহাল করেছেন বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেই গণ্য করছেন।

জেলা প্রশাসক অস্বীকার করলেও বিভাগীয় তদন্তে ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততার সত্যতা মিলেছে। আর তার সহযোগী ছিলেন সহকারী আরডিসি নাজিম উদ্দন, সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এস এম রাহাতুল ইসলাম। এদের মধ্যে নাজিম উদ্দীনের বিরুদ্ধে আগে থেকেই গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তিনি কথিত অভিযানে নেতৃত্ব এবং ভিকটিমকে নিজ হাতে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। আগের কর্মস্থল কক্সবাজারে একইভাবে তার হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা, সংবাদিকসহ সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। অভিযোগের ভিডিও থাকলেও নিজ ক্যাডারের জুনিয়র ব্যাচের সহকর্মীর কোনো অপরাধ পাননি ওই তদন্ত কর্মকর্তা। আর এটিই হলো আমলা উপখ্যান এবং কথিত ‘ব্যুরোক্রেটিক ট্রাডিশন’; যা আমলাতন্ত্রের লজ্জা বললে অত্যুক্তি হওয়ার কথা নয়।

সচিবালয় ও মাঠপর্যায়ে আমলাতন্ত্রের দাপটে জনপ্রশাসনে চরম হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক সচিবই মন্ত্রীদের গুরুত্ব দেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের মতো মাঠপর্যায়েও কর্মরত অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধিদের তোয়াক্কা না করার অভিযোগও বেশ জোরালো। তারা আচরণে, কার্যক্রমে চলেন রাজনীতিবিদদের মতোই। আমলাদের সীমাহীন ক্ষমতা প্রদর্শন করার কারণে মন্ত্রী, এমপি, সিটি মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরমেয়ররা অনেক সময় নিজের কর্মীদের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে সরকারের কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।

গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও জবাবদিহিতার অভাবেই একশ্রেণীর অসৎ আমলা একেবারে রাজাধিরাজ বনে গেছেন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই নেমে আসছে জুলুম-নির্যাতনের খড়গ। আর জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন সাংবাদিক আরিফকে বুঝিয়ে দিয়েছেন- আমলা কী, কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী! আর গোবেচারা সরকার নিজেদের মান-ইজ্জত রক্ষা করতে চার আমলাকে প্রত্যাহার করে নিয়েই দায় সেরেছে। অথচ কুড়িগ্রামের ঘটনা প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন ও ফৌজদারি অপরাধ। গুরু অপরাধে লঘু দণ্ডেই হয়তো খেল খতম হতে যাচ্ছে। কারণ, সরকারের হাতও তো পাটার নিচেই।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement