২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সুদের বিস্তার : করজে হাসানার ভূমিকা

-

বাংলাদেশে নানা কারণে একদল সুদ ব্যবসায়ী জনগণকে ব্যাপকভাবে শোষণ করছে। দরিদ্র জনগণের অনেকসময় সামান্য অর্থের প্রয়োজন পড়ে থাকে। কিন্তু এটা পাওয়ার ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। আবার অনেকের সাময়িকভাবে করজের বা ঋণের প্রয়োজন হয় তাদের চিকিৎসা খরচের জন্য অথবা ছেলে-মেয়ের বিয়ের জন্য অথবা বাড়ি সংস্কার অথবা ছোট একটি ঘর নির্মাণের জন্য ইত্যাদি। কিন্তু এসব প্রয়োজন মেটানোর জন্য সমাজের করজের ব্যবস্থা নেই। ব্যাংকগুলোর কোনো ব্যবস্থা নাই যে, তারা এইসব প্রয়োজনে বিনা সুদে সাহায্য করবেন। এই ধরনের ছোট করজে হাসানা দেয়ার প্রতি ব্যাংকগুলোর আগ্রহ দেখা যায় না।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এইসব প্রয়োজন মেটানোর জন্য সমাজে কিছু ব্যক্তি সুদে ঋণ দেয়ার পেশায় নেমেছে। তারা অত্যন্ত উচ্চ চার্জে গরিব জনসাধারণকে এবং নিম্নসাধারণ ব্যক্তিদের করজ দিয়ে থাকে। তাদের সুদের হার খুব বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতি মাসে শতকরা ১০ ভাগ। এর অর্থ হচ্ছে বছরে সুদ দিতে হবে ১২০ শতাংশ। এর মানে হচ্ছে কেউ যদি ১০ হাজার টাকা ঋণ নেয় তাকে এক বছর পর আসল ১০ হাজার টাকা এবং অতিরিক্ত ১২ হাজার টাকা সুদ দিতে হবে। অর্থাৎ মোট ২২ হাজার টাকা শোধ করতে হবে। এ হিসাবে, এক লাখ টাকা নিলে বছর শেষে ১২০ হাজার টাকা সুদসহ মোট ২২০ হাজার হাজার টাকা দিতে হবে।

এর ফলে মানুষ ভয়ানক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অনেকে এত বেশি টাকা ফেরত দিতে পারে না। ফলে তারা নিজেদের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে নিঃস্ব হতে বাধ্য হয়। অনেকে পালিয়ে বেড়ায়। এমনকি কেউ কেউ আত্মহত্যা করে বলে পত্রিকার রিপোর্টে দেখা যায়। এর বিরুদ্ধে সরকার এবং পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় বলে আমরা জানি না।

এই সুদ ব্যবসা মুসলিম নামধারী ব্যক্তিরাই চালাচ্ছে। তাদেরকে পাওয়া যাবে শহরের প্রতি ওয়ার্ডে এবং প্রায় প্রতিটি গ্রামে। অথচ ইসলামে সুদ হারাম। এই সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের দু’টি আয়াত উল্লেখ করছি।

‘যারা রিবা (সুদ)) খায়, (কিয়ামতের দিন) তারা দাঁড়াতে পারবে না। তবে দাঁড়াবে ঐ ব্যক্তির মতো যে শয়তানের থাবায় পাগলামিতে উন্মত্ত। তাদের অবস্থা এ রকম হওয়ার কারণ, তারা বলে, ব্যবসাও তো রিবার মতোই।’ অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে করছেন হালাল আর রিবাকে করেছেন হারাম। যার কাছে তার প্রভুর (সুদ থেকে বিরত হওয়ার) উপদেশ পৌঁছেছে এবং সে (সুদ থেকে) বিরত হয়েছে, সে ক্ষেত্রে সে অতীতে যা খেয়েছে তাতো খেয়েছেই। তার বিষয়টি দেখার দায়িত্ব আল্লাহর। কিন্তু যারা (সুদের) পুনরাবৃত্তি করবে, তারা হবে আসহাবুন নার, (আগুনের অধিবাসী), সেখানে থাকবে তারা চিরকাল। (বাকারা-২৭৫) আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করেন এবং বৃদ্ধি ও বিকাশ করেন সাদাকাকে (জাকাত ও দান)। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোনো অকৃতজ্ঞ দুর্নীতিবাজ পাপিষ্ঠকে। (বাকারা-২৭৬)

এর থেকে মুক্তির জন্য অন্যান্য প্রচেষ্টার পাশাপাশি করজে হাসানার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করছি। কুরআনের কয়েকটি আয়াতে করজে হাসানার কথা বলা হয়েছে। ‘করজে হাসানা’র অর্থ হচ্ছে এমন ঋণ বা করজ দেয়া যেটা সময়মতো পরিশোধ করা হবে; কিন্তু দাতা কোনো অতিরিক্ত অর্থ বা বেনিফিট নিতে পারবেন না। এটার উদ্দেশ্য ছিল সমাজের একটি প্রয়োজন পূর্ণ করা। সেটি হচ্ছে ব্যবসাবাণিজ্যের বাইরেও নানা কারণে মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের করজে হাসানা লাগতে পারে। সব সময় ব্যক্তির কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ থাকে না। কিন্তু সম্ভাবনা থাকে যে, পরে হবে এবং সেই অর্থ দিয়ে করজ পরিশোধ করা হবে। সুদকে ইসলাম হারাম করেছে। ফলে কোনো ব্যক্তির পক্ষে সুদে অর্থ নেয়া সম্ভব ছিল না বা উচিত ছিল না। এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা করজে হাসানার নীতি দিয়েছেন, যেন মানুষ সাময়িকভাবে করজে হাসানা নিতে পারে সুদ ছাড়া এবং পরে তা শোধ করে দিতে পারে।

এই প্রসঙ্গে আমি করজে হাসানার ওপর নাজিল হওয়া কুরআনের আয়াতগুলো উল্লেখ করছি।

‘তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, আল্লাহকে ‘করজে হাসানা দিতে প্রস্তুত, তা হলে আল্লাহ তাকে কয়েক গুণ বেশি ফিরিয়ে দেবেন। হ্রাস-বৃদ্ধি উভয়ই আল্লাহর হাতে নিহিত। আর তারই নিকট তোমাদের ফিরে যেতে হবে। (বাকারা-২৪৫)

আল্লাহ বনি ইসরাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এবং আমি তাদের মধ্য থেকে বারোজন সর্দার নিযুক্ত করেছিলাম। আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। যদি তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠিত কর, জাকাত দিতে থাক, আমার পয়গম্বরদের প্রতি বিশ্বাস রাখ, তাদের সাহায্য কর এবং আল্লাহকে উত্তম পন্থায় করজে হাসানা দিতে থাক, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের গোনাহ দূর করে দেবো এবং অবশ্যই তোমাদেরকে উদ্যানসমূহে প্রবিষ্ট করব, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে নির্ঝরিণীসমূহ প্রবাহিত হয়। অতঃপর, তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি এরপরও কাফের হয়, সে নিশ্চিতভাবেই সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। (আল মায়েদাহ-১২)

কে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহকে উত্তম করজে হাসানা দিবে, এরপর তিনি তার জন্যে তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানিত পুরস্কার। (আল-হাদীদ-১১)

নিশ্চয় দানশীল ব্যক্তি ও দানশীল নারী, যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে করজে হাসানা দেয়, তাদেরকে দেয়া হবে বহুগুণ এবং তাদের জন্যে রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার। (আল-হাদীদ-১৮)

যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম করজে হাসানা দান কর, তিনি তোমাদের জন্য তা দ্বিগুণ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী, সহনশীল (আত-তাগাবুন-১৭)

আপনার পালনকর্তা জানেন, আপনি ইবাদতের জন্য দণ্ডায়মান হন রাত্রির প্রায় দু-তৃতীয়াংশ, অর্ধাংশ ও তৃতীয়াংশ এবং আপনার সঙ্গীদের একটি দলও দণ্ডায়মান হয়। আল্লাহ দিবা ও রাত্রি পরিমাপ করেন। তিনি জানেন, তোমরা এর পূর্ণ হিসাব রাখতে পার না। অতএব, তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাপরায়ণ হয়েছেন। কাজেই কুরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর। তিনি জানেন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশে-বিদেশে যাবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত হবে। কাজেই কুরআনের যতটুকু তোমাদের জন্য সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর। তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্য যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে। তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু ( আল মুজজামমিল-২০)’

আপনারা কুরআনের উপরের আয়াতগুলো থেকে করজে হাসানার ব্যাপারে জানতে পারলেন। প্রত্যেকটিতে করজে হাসানা দেয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ এত আয়াতে কেন করজে হাসানার বিষয়ে বললেন এটা আমাদের চিন্তা করা দরকার। ‘আল্লাহকে ঋণ দেয়া’র অর্থ হচ্ছে গরিব-দুঃখীদের, অভাবীদের, যাদের প্রয়োজন, তাদের ঋণ দেয়া। এটা ইসলামী অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা কমে গেছে। করজে হাসানা না থাকলে সুদের প্রচলন বাড়ে। বাংলাদেশে এটাই হয়েছে। এখানে মহাজনী সুদ ব্যবসা বা ব্যক্তিপর্যায়ে সুদের ব্যবসা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের সুদের হার মাসিক ১০ শতাংশ অর্থাৎ বছরে ১২০ শতাংশ, যা খুবই ভয়াবহ ব্যাপার। এই ব্যবসা বাংলাদেশের কিছু মুসলিম নামধারী লোক করছে।

করজে হাসানা হচ্ছে ইসলামের দারিদ্র্য ও অসুবিধা দূরীকরণের অর্থনীতির তিনটি পদ্ধতির একটি। অন্য দু’টি হচ্ছে জাকাত ও সাদকা। জাকাত সম্পর্কে আমরা কম বেশি জানি। জাকাত ফেরত দিতে হয় না। এর মাধ্যমে ফকির মিসকিন ঋণগ্রস্তদের জন্য ব্যবস্থা করা যায়। আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে সাদকা বা দান। যাদের অভাব তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা দান করতে উৎসাহ দিচ্ছেন; এটাও ফেরত নেয়া হয় না। কিন্তু করজে হাসানা হচ্ছে সেই পদ্ধতি ও সেই করজ যা তাদেরকেই দিতে হবে যারা পরিশোধ করতে পারবেন। এ জন্য ফেরতের বাস্তবসম্মত সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement
‘দিনে দাওয়াতি কাজ করতে হবে আর রাতে আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে’ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রাণি ও পরিবেশের জন্য বড় হুমকি নতুন পর্যটন গন্তব্যের সন্ধান করছে সরকার : হাসান আরিফ বানারীপাড়ায় হত্যা ও প্রতারণা মামলায় গ্রেফতার ২ রাবির আরবি বিভাগের নতুন সভাপতি অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম ‘ট্রাম্পের সাথে অভিন্ন ক্ষেত্র খুঁজে পাবেন অধ্যাপক ইউনূস’ তাজিকিস্তানকে হারাল বাংলাদেশ ছাত্র-জনতা বুকের রক্ত দিয়ে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করেছে : মির্জা ফখরুল খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি ফেরতের দাবি জানালেন আলাল টানা দুই ওভারে ২ উইকেট শিকার তাসকিনের ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন’

সকল