২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পোশাক শিল্প রক্ষায় এখনই ব্যবস্থা নিন

-

করোনাভাইরাসের কারণে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং বিশেষ করে তৈরী পোশাক খাত গুরুতর সঙ্কটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। গত জানুয়ারি থেকে চীনের সাথে আমাদের বাণিজ্য প্রায় বন্ধ রয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে চীনে শিল্পকারখানা বন্ধ রাখা হয় এবং শহরগুলো অবরোধের মধ্যে পড়ে। এতে করে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত গার্মেন্ট বা তৈরী পোশাকের কাঁচামাল ও অ্যাক্সেসরিজ আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। আর বাংলাদেশ যে ১০০ কোটি ডলারের পণ্য চীনে রফতানি করত, সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। চীনের পর করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রে। সবাই জানেন, আমাদের তৈরী পোশাকের দু’টি শীর্ষস্থানীয় গন্তব্য হলো ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে পোশাকশিল্পে বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দেবে। পোশাক শিল্প মালিকরা এরই মধ্যে এই শিল্পের অস্তিত্ব সঙ্কটের আশঙ্কা করছেন।

দেড় মাস ধরে চীন থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ থাকায় চলতি মাস থেকেই চরম কাঁচামাল সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে দেশের প্রধান রফতানি খাতটি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর কাপড়-সুতা থেকে শুরু করে ডাইং কেমিক্যাল, বোতাম, জিপারসহ দেড় বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্ট কাঁচামাল আমদানি করা হয় চীন থেকে। এই বিপুল পরিমাণ পণ্য চীনের বাইরে অন্য কোনো উৎস থেকে সংগ্রহের সুযোগ এ মুহূর্তে আমাদের নেই। তার মানে হলো, ৪০-৪৫ বছর ধরে আমাদের বৃহত্তম রফতানি খাতকে এককভাবে চীনের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পণ্য চীন থেকে আমদানি করে সেগুলো দিয়ে পোশাক তৈরি করে আসছে বাংলাদেশ। এই খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনের কোনো চেষ্টা না সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে, না শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে। আর তারই পরিণামে এখন বিপর্যয়ের মুখে গার্মেন্ট শিল্প। রফতানির পাশাপাশি টালমাটাল অবস্থা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও।

সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে তৈরী পোশাক উৎপাদনেই যে সমস্যা হবে তাই নয়। বিশ্বজুড়ে এর চাহিদাও কমে যাবে। এরই মধ্যে কোনো কোনো দেশ আগের অর্ডার বাতিল করে দিয়েছে এবং কোনো কোনো দেশ বাতিল করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এর শিপমেন্ট বন্ধ রাখতে বলেছেন অনেক ক্রেতা। আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এর বিরূপ প্রভাব পড়বে গার্মেন্ট শিল্পে। কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত এই শিল্পের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার বা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হতে পারে, এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি। কোনো উদ্যোগ নেননি শিল্পমন্ত্রীও। গার্মেন্ট মালিকরা এ জন্য একটি জরুরি তহবিল গঠনের কথা বলেছেন। জানা গেছে, তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা জরুরি তহবিল গঠন করে ক্ষতিগ্রস্ত গার্মেন্ট শিল্প চাঙা রাখার ব্যবস্থা করেছে। ভিয়েতনাম ১১৬ কোটি ডলারের এবং কম্বোডিয়া ২০০ কোটি ডলারের তহবিল গঠন করেছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ছে। কারণ এখন পর্যন্ত সরকারের কোনো উদ্যোগই দৃশ্যমান নয় এ ব্যাপারে। বিশেষজ্ঞরাও কেউ কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে একটি সঙ্কট ব্যবস্থাপনা তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেছেন, যে তহবিল থেকে বিনা সুদে বা একেবারেই স্বল্পসুদে গার্মেন্ট মালিকদের ঋণ দেয়া যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে, এই করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে থেকেই কিন্তু গার্মেন্ট শিল্পে নেতিবাচক প্রবণতার সূচনা হয়েছে। বাংলাদেশের রফতানি কমে গেছে। তার মানে, প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে আগে থেকেই। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে অর্থাৎ গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তৈরী পোশাক পণ্য রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ নেতিবাচক অর্থাৎ তা হ্রাস পেয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে রফতানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ আমাদের তৈরী পোশাকের বেশির ভাগই রফতানি হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। আমাদের দেশের মোট রফতানির ৬০ শতাংশ হয়ে থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। আর যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা প্রায় ১৭ ভাগের মতো। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেনসহ অনেক দেশেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে মারাত্মক আকারে। ইতালি এরই মধ্যে তাদের নাগরিকদের ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছে। চীনের মতোই কয়েক দিন ধরে ইতালির রাস্তাঘাট জনশূন্য। ফলে ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ এ বাজারে বাংলাদেশের রফতানি কমার আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিউ ইয়র্কে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। কানাডাও ভাইরাসে আক্রান্ত। যুক্তরাজ্যও মুক্ত নয়। এসব দেশে ক্রেতাদের চাহিদা কমলে রিটেইলাররা রফতানি আদেশ বাতিল করতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন রফতানিকারকরা। এ ছাড়া বাংলাদেশে আঘাত হানা করোনাভাইরাস আরো ছড়িয়ে পড়লে কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে রফতানি আদেশ কমতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনা মহামারীর রূপ ধরেনি। তবে বেশ কয়েকজন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। জনঘনত্ব ও সচেতনতার অভাবে এটি যেকোনো সময় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে বা নিচ্ছে তাতে বহু ফাঁকফোকর থেকে যাচ্ছে, এতে সন্দেহ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত অবশেষে ঘোষণা করা হলেও এ ব্যাপারে দেরি করেছে সরকার। বিমানবন্দরে স্ক্যানার নষ্ট। এখন মাত্র একটি স্ক্যানার সচল আছে। কিন্তু বিদেশ থেকে আসা অনেকেই কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়াই বিমানবন্দর দিয়ে দেশে ঢুকতে পারছেন- এমন অনেক দৃষ্টান্ত আমরা দেখছি। হাসপাতাল থেকে সন্দেহভাজন রোগী পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। দেশের বাইরে থেকে আসা যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখার জন্য যে ব্যবস্থা সরকার রেখেছে সেখানে পরিবেশ এতটাই অনুপযোগী ও অস্বাস্থ্যকর যে, এ নিয়ে রীতিমতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে কম তোলপাড় হয়নি। সেই ধারা এখনো চলছে। সুতরাং কমপ্লায়েন্সের ধুয়া তুলে বাংলাদেশের কারখানায় উৎপাদিত তৈরী পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে আসা খুব বিচিত্র বা বিস্ময়কর হবে বলে মনে হয় না।

সার্বিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য খুবই উদ্বেগের। ইউরোপ আমেরিকায় আমাদের রফতানি ব্যাপকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে দেশগুলোতে এরই মধ্যে জরুরি অবস্থা চলছে। বাংলাদেশ ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। একই অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেও। বিশেষ করে, যে সৌদি আরবে আমাদের জনশক্তি সবচেয়ে বেশি সেই দেশ বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ইতালি থেকে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী কাজকর্ম ছেড়ে ফিরে আসতে শুরু করেছেন। অন্য দেশগুলো থেকেও আসতে বাধ্য হবেন অনেকে। কারণ জরুরি নয়, এমন সব খাতের কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে দেশগুলো।

যা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয়, সামনে বড় রকমের একটি চ্যালেঞ্জ আসছে আমাদের সামনে। রফতানি কমলে গার্মেন্ট সেক্টর ধসে পড়তে পারে। বেকার হতে পারেন লাখো শ্রমিক। আবার প্রবাসী কর্মীরা কাজ হারালে তারাও ফিরে এসে বেকারের খাতায় নাম লেখাবেন। এর ফলে কমতে পারে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি। সময় এবং মূল্য বিবেচনা করে পণ্যের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করাই এখন বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ। জাপান সেই বিকল্প উৎস হতে পারে। কিন্তু সেজন্য আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার প্রয়োজন হবে শিল্প মালিকদের। এর কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।

শুধু যে গার্মেন্ট পণ্যের জন্য আমরা চীনের ওপর নির্ভরশীল এমন নয়। তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও আমরা দেশটির ওপর প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল। চীন থেকে মোবাইল ফোনের নানা যন্ত্রাংশ আমদানি করে বাংলাদেশে সংযোজন করা হয়। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ চীনা মোবাইল সেট ব্যবহার করছেন। চীননির্ভরতার কারণে হুমকিতে পড়েছে মোবাইল ফোন সেটের উৎপাদনও। আর চীনে চামড়া রফতানি বন্ধ হয়ে গেছে গত জানুয়ারি মাসেই। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল তো নয়ই, বরং এ ক্ষেত্রে অনেকটাই ধোঁয়াশা।

আমাদের বিশ্বাস, চ্যালেঞ্জ দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যদি সময়মতো যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাহলে আমরা জাতি হিসেবে হয়তো মুখ থুবড়ে পড়ব না। কিন্তু কে নেবে সেই ব্যবস্থা? দেশে যে সরকার আছে, তাদের সামনে দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা ছাড়া আর কোনো এজেন্ডা আছে বলে মনে হয় না। অথচ গোটা জাতি তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।


আরো সংবাদ



premium cement
হামাসের ২ কি.মি. দীর্ঘ টানেল ধ্বংসের দাবি ইসরাইলের আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাবিরোধী ও জনদুশমন : রফিকুল ইসলাম খান ফরিদপুরে চিকিৎসককে মারধরের ঘটনায় বিচার দাবি নোয়াখালীতে আমেরিকা প্রবাসী ডাক্তারের মৃত্যু ২৪ ঘণ্টায় গাজায় আরো ২৩ ফিলিস্তিনিকে হত্যা তিতুমীরের গেটে পদবঞ্চিত ছাত্রদল নেতাদের বিক্ষোভ সিদ্ধিরগঞ্জে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে ২ শ্রমিক নিহত প্রেস ক্লাবের সামনে এক ব্যক্তির আত্মহত্যার চেষ্টা গাজার খ্রিস্টান সম্প্রদায় ‘মৃত্যু ও ধ্বংস’র অবসানের জন্য প্রার্থনা করেছেন পশ্চিমতীরে ইসরাইলি সামরিক অভিযানে ৮ ফিলিস্তিনি নিহত ’ভারত সরকার একতরফাভাবে আ’লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে’

সকল