বঙ্গবন্ধুর লড়াই ছিল হক ও ইনসাফের জন্য
- প্রফেসর ড. এম এ মান্নান
- ১৩ মার্চ ২০২০, ২১:০৮
অনেক দিন আগের কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সেই দিনটির কথা মনে পড়ল। পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসেম প্রমুখের প্রচেষ্টায় ১৯৪৯ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক হন টাঙ্গাইলের শামসুল হক। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তিন যুগ্ম সম্পাদকের একজন। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিব দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন এবং পরের বছর দলীয় সম্মেলনের মাধ্যমে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। শেখ মুজিবের সাথে আমার প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ হয় ১৯৬৩ সালে। তখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের (ইপিসিএস) ট্রেনিং শেষ করার পর আমার প্রথম পোস্টিং হয় ময়মনসিংহে। বাস্তবিক অর্থে সেখান থেকেই আমার কর্মজীবন শুরু। যত দূর মনে পড়ে তখন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেয়ার বয়সসীমা ছিল ২৪ বছর। আর ছিল সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস (সিএসএস) পরীক্ষা। এটা হতো পুরো পাকিস্তানের জন্য। আটটি ক্যাডারের জন্য পরীক্ষা হতো। এর বয়সসীমাও একই ছিল। বয়সসীমার কারণে আমার একবারই পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ ছিল। তখনো বিয়ে করিনি। কর্মক্ষেত্র ময়মনসিংহের ডাকবাংলোয় থাকি। একদিন সকালে হঠাৎ দেখি বারান্দায় এক ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন। এক নজরেই আমি চিনতে পারি উনি শেখ মুজিবুর রহমান। তার সাথে আমার পূর্বপরিচয় ছিল না অথবা আগে কখনো সামনা সামনি দেখিনি। তবুও তাকে চিনতে আমার অসুবিধা হয়নি। কারণ (এই কলামের লেখায় আমি আগেই বলেছি) ১৯৫৪-৫৫ সালে সিরাজগঞ্জ কলেজে পড়ার সময় আমি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম। আমার হাত দিয়ে ওই কলেজে ছাত্রলীগের যাত্রা শুরু হয় এবং আমি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন সম্পর্কে আমার চাচা। তার সাথে শেখ মুজিবের অনেক বক্তৃতা আমি শুনেছি। ছবি তো দেখাই ছিল। মুসলিম লীগের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করে শেখ মুজিবের জ্বালাময়ী বক্তৃতা আমাকে ছাত্রজীবনেই অভিভূত করতো। আমার বাবা ছিলেন মুসলিম লীগের সমর্থক। এর কারণও ছিল। ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র তথা পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলন তিনি সমর্থন করতেন। ছাত্রলীগ করার সুবাদে আমি ছিলাম যুক্তফ্রন্টের ভক্ত। বাবা এ নিয়ে মায়ের কাছে অনুযোগ করতেন। কিন্তু মা আমাকে সমর্থন করতেন। আমার যুক্তফ্রন্টের ভক্ত হওয়ার কারণ ছিল ভাষা আন্দোলনসহ সরকারি চাকরিতে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণ। আমি মনে করতাম এর প্রতিবাদ হওয়া দরকার।
শেখ মুজিবকে চিনতে পেরে আমি আগ্রহভরে কথা বলার জন্য এগিয়ে যাই। গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘স্যার, আপনি কেমন আছেন’। যত দূর মনে পড়ে তিনি তখন একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর আমি তাকে একটি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘স্যার, আমাদের সোস্যাল ভিশনটা কী?’ এর আগে মুসলিম লীগের সমালোচনাও করি নানা আঙ্গিক থেকে। উনি যে উত্তরটি দিয়েছিলেন তাহলো: ‘তোমাদের ভিশন তোমরাই ঠিক করবা’।
আমার আরো অনেক কথা বলার ও অনেক কিছু জানার থাকলেও ওনার ব্যস্ততার কারণে সেটি আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তার এই সামান্য কথাটুকু এখনো আমার কানে বাজে। আমার ছাত্ররাজনীতি করার অভিজ্ঞতা ও একটি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে থাকা পরিবারে বড় হওয়ার কারণে শেখ মুজিবের ওই সামান্য কথাই আমার মনে দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায় এবং ভাবনার খোরাক জোগায়। এরপর চাকরির সুবাদে আমি পশ্চিম পাকিস্তান চলে যাই। ওখানে গিয়ে এত দিন আমি পূর্ব পাকিস্তানিদের সাথে বৈষম্যের যেসব কথা শুনছিলাম হাতেকলমে তার প্রমাণ পেলাম। ময়মনসিংহে আমার সাথে শেখ মুজিবের যখন সাক্ষাৎ হয় তখনো ছয় দফার কথা আসেনি। কিন্তু তার আগেই আমি পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বাস্তব চিত্রটি দেখতে পেলাম। ফলে ছয় দফার যৌক্তিকতা আমার কাছে স্পষ্ট ছিল। আমি তখন ‘ইকোনোমিক প্রব্লেমস অ্যান্ড প্ল্যানিং ইন পাকিস্তান’ (১৯৬৮ সালে প্রকাশিত) নামে যে বইটি লিখি সেখানে ছয় দফার প্রতি সমর্থনের যৌক্তিকতাগুলো বিশ্লেষণ করি। বইয়ের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছয় দফাকেই সমর্থন করেছিল।
তাই আজ শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকীর দ্বারপ্রান্তে আমার মানসপটে তার সেই টগবগে তরুণ চেহারাটি বারবার ভেসে উঠছে। তিনি বয়সে আমার থেকে ১৮ বছরের মতো বড়, দেখতে বেশ সুদর্শন ছিলেন। ওই সময়টি ছিল তার জীবনের, যাকে বলে ‘প্রাইম পিরিয়ড’। আজ সেই স্মৃতি মনে করে জন্মশতবার্ষিকীতে আমি বঙ্গবন্ধুর রূহের মাগফিরাত কামনা করি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরোটা সময় আমি আমেরিকা ছিলাম, মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছিলাম। কিন্তু সেখানে বসেও আমরা বাংলাদেশী ছাত্ররা স্বাধীনতা আন্দোলনে সাধ্যমতো সাহায্য করেছি। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান সরকার আমাকে দেশে তলব করে। আমি ফিরে না আসায় চাকরিচ্যুত করে। আমার স্কলারশিপ কেটে দেয়া হয়। ফলে আমাকে রাষ্ট্রহীন অবস্থায় পড়তে হয়। মিশিগানে আমরা ‘ডিফেন্স লিগ’ গঠন করেছিলাম। আমি এর একটি শাখার চেয়ারম্যান ছিলাম। ছাত্র হয়েও আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে কাউন্সিলর ছিলেন। তাকে পক্ষত্যাগে রাজি করানো হয়। তখন তার জন্য বাড়ি ভাড়া করতে আমি চাঁদাও দিয়েছি। সৌভাগ্যবশত ১৯৭৩ সালে তার স্বাক্ষরেই আমি স্বাধীন বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়েছিলাম।
শেখ মুজিব ক্যারিশম্যাটিক লিডার ছিলেন। জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার গুণ ছিল তার। কিন্তু তিনি রাষ্ট্র ‘কন্সট্রাকশন’ বা বিনির্মাণের সুযোগটি পাননি। ক্যারিশমা ও কন্সট্রাকশন দু’টি আলাদা বিষয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের কারণে ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেরামত করার সুযোগ তিনি পাননি। মেরামতের প্রক্রিয়ায় তিনি ছিলেন। সেই দায়িত্বটি আমাদের কাছে দিয়ে গেছেন। সে কারণেই তিনি আমাদের ভিশন আমাদেরকে ঠিক করতে বলে গেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে আমাদের দাবিটি ছিল অর্থনৈতিক অধিকার বা হিস্যার। সেটি ছিল ইনসাফ ও হকের অধিকার। কিন্তু সেই অধিকারকে এখন আমরা বিকৃত করে ফেলেছি। ছয় দফার সবগুলো একত্রিত করলে একটি দফাই দাঁড়াবে। আর সেটি হলো হক ও ইনসাফ। ইসলামেরও মূল কথা এটি। হক ও ইনসাফের জন্য শেখ মুজিব যে লড়াই করেছেন সেটিই জিহাদ। জিহাদ মানে হলো অন্যায় প্রতিরোধ করা। প্রথমে বল প্রয়োগ করে, তা সম্ভব না হলে মুখের কথায়, সেটাও সম্ভব না হলে মনে মনে ঘৃণা করা। কিন্তু শেখ মুজিব যে রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন আমার মনে হয় আমরা সেটি করতে পারিনি। যখন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ঘটে তখনও আমি দেশে ছিলাম না, পাপুয়া নিউগিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছিলাম। কিন্তু ওই মাসেই, ৬-৭ আগস্টের দিকে আমি বাংলাদেশে আসি। তখন বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তখন আমি বায়তুল মোকাররমের কাছে রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। একই সাথে দেখেছি জন্মদিন পালনের জন্য বিশাল আকারের কেক নিয়ে যেতে। এই বিপরীত দৃশ্য দেখে আমার মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে যেন চার দিক থেকে আটকে রাখা হয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতি তাকে বুঝতে দেয়া হচ্ছে না। যে দিন তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন, সেদিন একজন মানুষও প্রতিবাদে সরব হয়নি। কেন? বিষয়টি আজো আমার কাছে বড় রকমের ধাঁধা হয়ে আছে। এখন যারা দেশের ক্ষমতায় আছেন তাদেরসহ সবার জন্য এটা একটি শিক্ষার বিষয়। এ নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
শেখ মুজিবের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডটি মানবিক, ধর্মীয় বা সভ্য সমাজ কোনো দৃষ্টিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা প্রায় সব জায়গায় ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ব্যবহার করেন। কারও কারো বক্তব্য, এটা বেশি বেশি বলা হচ্ছে। কিন্তু আমি সেই কবিতার চরণ থেকে বলব: ‘কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে/ কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।’ একই দিনে পরিবারের এতগুলো আপনজনকে হারানোর বেদনা যে কত গভীর, সেটি শুধু উনিই বুঝতে পারবেন। আর কেউ না।
আমার কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই, কোনো রাজনৈতিক বিবৃতিও এটা নয়; একান্ত মানবিক মন থেকে তাকে আমি সমবেদনা জানাই। জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশ দিয়ে তিনি অনেক ভালো কাজ করেছেন। প্রায়ই অভিযোগ শুনি ছাত্রলীগ চাঁদাবাজি করে। আমিও ছাত্রলীগ করেছি। আজকের ছাত্রলীগ আর তখনকার ছাত্রলীগের মধ্যে অনেক ব্যবধান। ছাত্রসমাজের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে এই কলামেই আমি লিখেছি। স্বাধীনতা আমাদের বিশাল অর্জন। কিন্তু আমাদের যে বিসর্জন হয়েছে সেটিও কম নয়। আমাদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। মানুষ মানুষকে শ্রদ্ধা করতে ভুলে যাচ্ছে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়ার কারণেই এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব হয়। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটছে বলে আমার মনে হয় না। বরং দিনে দিনে আরো অবনতি ঘটছে। মানুষের অধিকারের জন্য যে দলটির এত আত্মত্যাগ সেই দল ক্ষমতায় থাকাকালে কেন মানবাধিকারের অবনতি নিয়ে কথা উঠবে? কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদেরই ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ আসবে? কেন কোনো শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক অবমাননার শিকার হবেন? দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেয়ার জন্যই এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা