মার্চ মাসের আত্মোপলব্ধি
- সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
- ১০ মার্চ ২০২০, ১৯:৪২
মার্চ স্মরণীয় মাস হতে বাধ্য
১৯৪৯ সালের ৪ অক্টোবর হালদা নদীর তীরে একটি নিভৃত পল্লীর ‘সৈয়দ পরিবারে’ যে শিশুটি জন্ম নিয়েছিল এবং নাম পেয়েছিল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, বলতে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ। সেই রণাঙ্গন শুরু হয়েছিল মার্চ মাস থেকে। এখন মার্চ মাস চলছে। ১৯৭১ সালের স্মৃতি, মাহাত্ম্য ও মহত্ত্ব আজো ইবরাহিমের চেতনাকে সমৃদ্ধ রেখেছে। অতএব সেই স্মৃতি মাহাত্ম্য ও মহত্ত্ব অন্যের সাথে শেয়ার করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। ’৭১ সালের মার্চে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল এবং প্রত্যেকটি দিনের ঘটনা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা ও মূল্যায়ন সম্ভব এবং প্রয়োজন। একটি দিন মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নয়, তা হলো বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ যদিও বঙ্গবন্ধু নিজে বাংলাদেশের জন্মের সাথে প্রত্যক্ষভাবে ও অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি; কিন্তু যেহেতু পাকিস্তানি কারাগারে আটক ছিলেন তাই সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যিনিই রাষ্ট্রপতি, তিনি সাংবিধানিকভাবেই সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক (সুপ্রিম কমান্ডার)। অতএব, মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সুপ্রিম কমান্ডার এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সুপ্রিম কমান্ডার। কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী (১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ বা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির নির্বাচিত সদস্য বা এমএনএ)। কর্নেল ওসমানী ছিলেন প্রধান সেনাপতি (কমান্ডার ইন চিফ)। মার্চ মাসের কথা বলা মানে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা মানে, বঙ্গবন্ধুর কথা বলা, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের কথা বলা, প্রধান সেনাপতির কথা বলা, বঙ্গবন্ধুর হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানকারী মেজর জিয়াউর রহমানের (তথা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম) কথা বলা, সেক্টর কমান্ডারদের কথা বলা, সে আমলের ইপিআরের সদস্য, আনসার-মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য, যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তাদের কথা বলা, মুক্তিযোদ্ধা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নগুলোর কথা বলা, বিদ্রোহী পুলিশ সদস্যদের এবং মাঠে-ময়দানে যুদ্ধ করা গেরিলা যোদ্ধাদের কথা বলা, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী মহিলাদের কথা বলা, ৯০ লাখ শরণার্থীর কথা বলা, বন্ধুপ্রতিম বিদেশী রাষ্ট্র ও জনগণ যারা আমাদের সাহায্য করেছেন, তাদের কথা বলা, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিকারী বাঙালি ও বিদেশীদের কথা বলাও। সবার কথা এক দিনে এক কলামে বা এক বইয়ে বলা সম্ভব নয়। তাই সারা বছর বলতে হয়, বিভিন্ন কলামে বলতে হয়, বিভিন্ন বইয়ে বলতে হয়। তবে শুনতে অনাগ্রহী হলেও, যে বিষয়ের আলোচনা তুলনামূলকভাবে কম করা হয়, সেটি হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতে আমরা কী বুঝি? আরেকটি বিষয়ের আলোচনা প্রচুর করা হচ্ছে, কিন্তু সেটি ২০২০ সালে আদৌ প্রযোজ্য কি না, সে কথা আলোচনা করা হয় না; বিষয়টি হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি’। যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা এই কলামে করছি। এমন কথা যা গত দু-চার বছরে বা সাম্প্রতিককালে বলেছি, তেমন কিছু কথা ইচ্ছাকৃতভাবে আজ আবার উল্লেখ করা হবে এই কলামে।
একাধিক অবিস্মরণীয় দিন
’৭১ সালের মার্চ মাসের ৭ তারিখ ছিল ঐতিহাসিক দিন। আমার মূল্যায়নে সে দিন বঙ্গবন্ধু মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ দয়াপ্রাপ্ত ছিলেন। কারণ সে দিনই তার মুখ দিয়ে এই ঐতিহাসিক কথাগুলো বের হয়েছিল। কথাগুলোর গুরুত্ব পরিমাপ করা কঠিন। সাম্প্রতিককালে ইউনেস্কো সে ভাষণকে প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ করেছে। ভালো কথা; কিন্তু যা ভালো কথা নয় সেটি হলো, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত মুক্তির সংগ্রামের অগ্রগতি কতটুকু? স্বাধীনতা হওয়ার কথা ছিল মুক্তি সংগ্রামের সহায়ক। আরো একটি দিন আছে যেটি জনসমক্ষে বহুল প্রচারিত নয়, যথা- ১৯ মার্চ ১৯৭১। ওই দিন জয়দেবপুরের (বর্তমানের গাজীপুর সদর) জনগণ এবং জয়দেবপুরে অবস্থানরত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পারস্পরিক সম্মোহনী যুক্তিতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, ওই সেনাবাহিনীর একটি দলকে প্রতিরোধ করেছিল; এটাই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ দিবস। যা হোক, ২৫ মার্চের কালরাত্রির কথা এবং ২৬ মার্চের প্রথম যুদ্ধগুলোর কথা, স্বাধীনতার ঘোষণার কথা অবিতর্কিতভাবে বর্ণিত আছে।
কেন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল?
‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যে মহাকাব্যিক ইতিহাস, সেটা এই প্রবাদবাক্যের বাস্তবতার উজ্জ্বলতম সাক্ষী। সময় যত পার হবে, প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ততই কমবে এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি ততই দুর্বল হবে। কেনই বা ৩০ লাখ বাঙালি প্রাণ দিলো, কেনই বা লাখ লাখ মা-বোন শুধু দেশের দিকে তাকিয়ে নিজেদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিল, এটি গবেষণার বিষয় বটে। কিন্তু সে গবেষণা যদি বইয়ের পৃষ্ঠায় সীমিত থাকে, তাহলে লাভ কী? কেনই বা লাখো তরুণ বুক পেতে দিয়েছিল সম্মুখশত্রুর গুলির সামনে, এই প্রশ্নের উত্তরও রূপকথার মতো, বা নিরস সাহিত্যের ভাষায়, বা নিমর্ম বা অপ্রিয় কথার মাধ্যমেও দেয়া যায়। সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে, ততই বলিষ্ঠ সত্যগুলো মিথ্যার আবরণে ঢাকা পড়ছে। তাই আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, আমাদের মনটা মাঝে মধ্যেই বিচলিত হয়ে ওঠে; সেই মনকে শান্ত করার জন্য চেষ্টা করতে হবে, সফল হই বা না হই! যেহেতু এই অনুচ্ছেদটির শিরোনাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’, তাই প্রারম্ভেই, আজকের স্মরণীয় মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, শহীদ জিয়ার প্রতিও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং রণাঙ্গনের সব মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
চুপ থাকব, নাকি কথা বলব?
উপরের অনুচ্ছেদে বলেছি : ‘সেই মনকে শান্ত করার জন্য চেষ্টা করতে হবে, সফল হই বা না হই!’ সেই চেষ্টার অংশ হলো জনগণকে সচেতন রাখা তথা সচেতন জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত থাকা। এই প্রক্রিয়ার অংশ হলো, কথা বলা। এর মানে শুধু রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে ভাষণ দেয়া নয়, বরং টেলিভিশনে, সভা-সমিতিতে, মঞ্চে বলা ও পত্রিকায় কলাম লেখা ইত্যাদি। এই কলামের মাধ্যমেই আপনার সাথে, আপনাদের সাথে কথা বলছি। কথা বললে কেউ না কেউ কথককে পছন্দ করবে, আবার কেউ না কেউ অপছন্দ করবে। আপনি বা আমি যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের কথা বলি, তাহলে স্বার্থান্বেষী গ্রুপের মানুষ আমাদের খুব অপছন্দ করবে। আমরা যদি দেশের স্বার্থে বলি, সাধারণ মানুষ আমাদেরকে পছন্দ করবে, কিন্তু ক্ষমতার অঙ্গনে যারা পদচারণা করেন, তারা আমাদের পছন্দ করবেন না এবং চরম সত্য হলো, আপনি বা আমি যদি আল্লাহকে ভয় করি তাহলে সত্য কথাটাই বলতে হবে। চাটুকারিতা থেকে থাকতে হবে দূরে। কিন্তু পরম বাস্তবতা হলো, তৃতীয় বিশ্বের তথা দক্ষিণ এশিয়ার তথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে মিথ্যা বলা ও চাটুকারিতা দু’টি ‘উজ্জ্বল’ বৈশিষ্ট্য এবং রাজনীতিতে অগ্রগতির জন্য এই কর্ম দুটিতে ‘দক্ষতা’ প্রয়োজন! তৃতীয় বিশ্বের তথা বাংলাদেশের রাজনীতির উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিরা, সত্য পছন্দ করেন না। অথচ আপনি-আমি কথা বলার সময় সত্য কথা তো বলতেই হবে; তা না হলে মানুষই আমাদের মন্দ বলবে। অতএব আপনাকে বা আমাকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি বা আমি কি কথা বলব, নাকি আপনি কথা বলবেন না, আমিও কথা বলব না? কথা না বললে কেউ আমাদের সমালোচনা করবে না। প্রবাদবাক্য আছে- ‘বোবার কোনো শত্রু নেই’। আপনি কথা না বললে, কেউ টের পাবে না যে, ‘আপনি ভরা কলসি না খালি কলসি’! আপনি কপট গাম্ভীর্য নিয়ে ভরা কলসির ভাব প্রদর্শন করতে পারবেন। রাজনীতি করতে গেলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে চাটুকারিতার সাথে যে বৈশিষ্ট্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং নিবিড়ভাবে অভ্যাস করা হয়, তার নাম ‘কপটতা’। কিন্তু আমি (ইবরাহিম) তো কথা বলতাম, এখনো বলছি। কথা বলাটা যদি দোষের হয়েই থাকে, তাহলে আমি সেই দোষ অনেক দিন যাবত করে যাচ্ছি; অন্ততপক্ষে ১৯৯৭ সালের জুলাই মাস থেকে তো করেই যাচ্ছি। একাধিক রাস্তার সংযোগ স্থলে দাঁড়ালে যেমন একটি সুযোগ আসে, কোন রাস্তা দিয়ে হাঁটব সে সিদ্ধান্ত নেয়ার; তেমনি জীবনের সাতটি দশকের শেষ ও অষ্টম দশকের শুরুর বিন্দুতে দাঁড়িয়ে, আমার জন্যও এখন গভীর চিন্তার সময়; মূল্যায়ন করতে হবে, কোন পথে হেঁটে এসেছি, কোন পথে হাঁটব; কতটুকু সাথে পেলাম, কতটুকু সাথে নিলাম? মূল্যায়ন করার আত্মার শক্তি ও চরিত্রের শক্তি কতটুকু খরচ করে ফেললাম, জমা আছে কতটুকু?
কী লক্ষ্যে বাংলাদেশের জন্ম?
যেকোনো রাষ্ট্রের সচেতন নাগরিক মাত্রই, প্রয়োজনীয় মুহূর্তে দ্বিধাহীনভাবে স্মরণ করে, তাদের প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষরা তথা ফাউন্ডিং ফাদার্স, কী চেয়েছিলেন এবং কী বলেছিলেন। আমরাও স্মরণ করতে পারি, আমাদের ফাউন্ডিং ফাদার্স বা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষরা কী বলেছিলেন? বঙ্গবন্ধু কী বলেছিলেন, সৈয়দ নজরুল কী বলেছিলেন, তাজউদ্দীন কী বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান কী বলেছিলেন, ওসমানী কী বলেছিলেনÑ এগুলো নিশ্চয়ই প্রণিধানযোগ্য। জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা কী বলেছিলেন, সেটি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। আজ সব কথা এখানে বলতে পারব না। কারণ, সীমিত পরিসর এবং পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানো উচিত হবে না। ১০ এপ্রিল ১৯৭১, পাকিস্তানের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত বাঙালি জনপ্রতিনিধিরা সম্মিলিত হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেছিলেন। ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের মুদ্রিত সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঘোষণাটির মাঝামাঝি অংশ থেকে একটি অনুচ্ছেদ হুবহু উদ্ধৃত করছি। ‘সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন, সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি’। এই অনুচ্ছেদে উদ্ধৃত অংশের মধ্যে তিনটি শব্দের প্রতি পাঠকসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যথা- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। মুক্তিযোদ্ধা ইবরাহিম দেশবাসীকে সাথে নিয়ে ওই তিনটি শব্দ স্মরণ করছেন, তেমনই যখন ডিসেম্বর মাস চলমান থাকবে, তখনো একই কথা দেশবাসী নিজেরাই স্মরণ করতে পারবেন। কারণ এই তিনটি শব্দ বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রত্যেকের জীবনকে স্পর্শ করে।
কে ফসল লাগায়, কে ফসল তোলে?
এখন আমরা একসাথে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের প্রসঙ্গটি আলোচনায় আনছি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কয়েকটি বাধা বা সীমাবদ্ধতা উল্লেখযোগ্য। আমার মতে, বাংলাদেশে গত ৪৯ বছরের সরকারগুলোর মধ্যে প্রত্যেকটি সরকার সমানভাবে বা সমানুপাতিকভাবে এই তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই সরকার জনগণের স্বার্থের ওপর দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছিল; যেমন বর্তমান সরকার দিয়ে যাচ্ছে। সে জন্যই এই বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি। জনগণের স্বার্থ মানে দেশের স্বার্থ অথবা দেশের স্বার্থ মানে জনগণের স্বার্থ। এই স্বার্থ দুই প্রকারের হতে পারে, তাৎক্ষণিক বা স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি। আমার মূল্যায়নে ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল, দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে স্বল্পমেয়াদি স্বার্থকে হাইলাইট করে অথবা দলের স্বার্থকে বেশি হাইলাইট করে থাকে, সে জন্য এ ধরনের ঘটনা ঘটে। যেহেতু সততা ও দেশপ্রেমকে শ্রেণিকক্ষে আলোচনার বিষয় ছাড়া আর কিছুই মনে করা হচ্ছে না, সেহেতু সমাজে এর প্রতিফলন ঘটানোর উদ্যোগ কোনো সময় দেখিনি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক আইনের শাসন জারির সময় একবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা শুনেছিলাম বা দেখেছিলাম। ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নামক রাজনৈতিক নাটক মঞ্চায়নের সময়ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একই রকম যুদ্ধের কথা শুনেছি। আবার অতি সাম্প্রতিককালেও (গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে) এরূপ দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কথা আমাদের চোখের সামনে আসছে। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী, বেশির ভাগ সময়ই বেশির ভাগ বিষয়ে সিরিয়াস হয়নি, কারণ দেশের স্বার্থ শাসকগোষ্ঠীর কাছে গৌণ, দলের স্বার্থ এবং নিজের ব্যক্তিস্বার্থ মুখ্য ছিল বা আছে। আমরা এর পরিবর্তন চাই। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মোটো বা নীতিবাক্য হলো : ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’। পরিবর্তন মানে রাজনীতিবিদদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে গুণগত পরিবর্তন তথা রাজনীতির প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন। পরিবর্তন মানে উন্নয়নের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্কের মূল্যায়নে পরিবর্তন। পরিবর্তন মানে, জনকল্যাণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এবং দুর্নীতিবাজদের শাসন করার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন।
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে
সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ হচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে যে দুর্নীতি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান ছিল, গত এক দশকে, বহুলাংশেই সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সে দুর্নীতি জ্যামিতিক হারে বিশালত্ব লাভ করেছে। শুধু আর্থিক দুর্নীতি নয়, বাংলাদেশের সামাজিক নৈতিকতা, শিক্ষা ক্ষেত্রের নৈতিকতা এমনকি ধর্মীয় অঙ্গনের নৈতিকতা ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার জন্য গত ১২ বছরের শাসনই মূলত দায়ী। ভৌত কাঠামোমূলক উন্নয়ন হলেও অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে। শেয়ার মার্কেটের কর্মকাণ্ড, ব্যাংকগুলোর অবস্থা, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান যথা লিজিং কোম্পানি বা ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিগুলোর অবস্থা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করলে অর্থনীতির অবস্থা বোঝা যায়। সমাজে ধর্ষণ-প্রবণতা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে, নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে, এক ধরনের মারাত্মক ভারসাম্যহীনতা গত ১২ বছরে সৃষ্টি হয়েছে। মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ভারসাম্যহীনভাবে বেড়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনগুলো যেহেতু চরম অনৈতিকতার ওপর দণ্ডায়মান এবং জনগণের অনুভূতির প্রতি বিদ্রূপস্বরূপ, তাই বর্তমান রাজনৈতিক সরকার কোনো কিছুই নৈতিক সাহস নিয়ে করতে পারেনি এবং পারছে না। ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ বলে একটি কথা আছে। এই কথাকে সত্য প্রমাণ করেই সম্রাট, এনাম, রূপন, পাপিয়া, প্রশান্ত হালদার প্রমুখের বিষয় জনগণের দৃষ্টিতে আসছে এবং আরো আসবে। পাঁচ-ছয় মাস আগে মনে করেছিলাম, পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী সিরিয়াস ও আগ্রহী; কিন্তু সেই আশায় খুব সম্ভবত গুড়েবালি। বিশেষভাবে বলতে গেলে বিগত ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে দেশের পরিস্থিতি, পাঠক সমাজের কাছে পরিচিত। দুর্নীতি, লাম্পট্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধভাবে টাকা কামানোর ও সম্পদ বাড়ানো এবং বিদেশে টাকা পাচারের কাহিনীগুলো উঠে আসছে এবং এসব খলনায়ক ক্ষমতাসীন দলের। এসব দুর্নীতির আবিষ্কার, শিলাখণ্ডের সর্বোচ্চ ভাগে হাত দেয়ার চেয়েও কম; কারণ ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও আলোচিত কোনো দুর্নীতির বিচার করার প্রবণতা এই সরকার আজ অবধি দেখায়নি। একাধিক চটকদার কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের মাধ্যমে, গত ১২ বছর যাবত নিপীড়িত, নির্যাতিত সাধারণ মানুষের মনে, নেত্রী ও শাসক দলের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য আসেনি। রাজনীতির অঙ্গনে গত ১১ বছর ধরে শাসকদল কঠোর সংগ্রাম করছে প্রধান বিরোধীশিবিরকে রাজনৈতিকভাবে মার্জিনালাইজড করতে। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সরকারপ্রধানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বেগম খালেদা জিয়া। তাকে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। লাখ লাখ অন্য কারাবন্দী বা মামলার আসামিদের কথা না-ই বা বললাম। যতটুকু লিখলাম বা বললাম, তার বহু গুণ বেশি না বলা বা অলিখিত থেকেই গেল। মার্চ মাসের এই দিনে সব বাংলাদেশী যারা চিন্তা করতে পারেন, সব মুক্তিযোদ্ধা যাদের বিবেক এখনো সক্রিয়, সব প্রবীণ ব্যক্তি যারা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দেশের জন্য কিছু করতে আগ্রহী, তাদের সবার প্রতি আবেদন- দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করুন।
নবজাগরণ প্রয়োজন
সম্মানিত পাঠক, উপরের দু’টি অনুচ্ছেদ পুনরায় লক্ষ করুন। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে, একাত্তরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ইবরাহিম মনে করে, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক নবজন্ম প্রয়োজন। বলা যায়, নতুন স্বচ্ছতা নিয়ে, নতুন প্রত্যয় নিয়ে, নতুন উদারতা ও নতুন সহনশীলতা নিয়ে, সমঝোতার পরিবেশে আমাদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমার বয়স ১২ বছরের কিঞ্চিৎ বেশি। সেই ১২ বছরের অভিজ্ঞতায়, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক ইবরাহিম, মাত্র চারটি অভিমত উপস্থাপন করছি। এক. সহনশীল ও নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বেগম জিয়াকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া প্রয়োজন, তাকে মুক্তি দেয়া হোক। দুই. সহনশীল ও নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পরিবেশে এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধানে নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচন আয়োজন করা হোক। তিন. মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং দেশ পরিচালনাকারী যেকোনো সরকারের বিভিন্ন স্তরে জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ করা হোক। চার. প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ও বিচার বিভাগের উচ্চ অঙ্গকে ভৌগোলিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করা হোক এবং দায়িত্ব বণ্টন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ করা হোক। স্বাধীনতার মাসে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমার এই চারটি বক্তব্য বিবেচনার আবেদন করছি।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com.bd
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা