করোনাভাইরাস : সতর্কতাই জরুরি
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ০৩ মার্চ ২০২০, ২০:৩৫
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় গত সোমবার মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যায়। মৃতের সারিতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির একজন উপদেষ্টাও আছেন। খামেনির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ মীর মোহাম্মদী তেহরানের একটি হাসপাতালে রোববার মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। ইরানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এটাই শীর্ষ কোনো কর্মকর্তার প্রথম মৃত্যু। এ ছাড়াও আক্রান্ত হয়েছেন ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং উপস্বাস্থ্যমন্ত্রীও। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশও রোগটির সংক্রমণের বাইরে থাকতে পারেনি। সেখানেও কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী মারা যাওয়ার খবর এসেছে। রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে। আক্রান্ত হয়েছেন ৮৮ হাজারেরও বেশি মানুষ। আইসল্যান্ড, নাইজেরিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, বেলারুশ ও নেদারল্যান্ডসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এ রোগে একজন ব্রিটিশ নাগরিক মারা গেছেন। তিনি জাপানে নোঙর করা একটি প্রমোদতরীর যাত্রী ছিলেন।
গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো, এবার ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। দিল্লি ও তেলেঙ্গানায় দু’জন অসুস্থ রোগীর রক্ত পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। গত সোমবার দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে। দিল্লিতে করোনায় আক্রান্ত ওই রোগী সম্প্রতি ইতালি থেকে দেশে ফেরেন এবং তেলেঙ্গানায় আক্রান্ত ব্যক্তি দেশে আসেন দুবাই থেকে। সংক্রমিত দেশগুলোর মধ্যে ইতালি, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়ার পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। ইরানে মৃতের সংখ্যা সরকারিভাবে ৫৪ জন বলা হলেও অসমর্থিত সূত্রের খবর দিয়ে বিবিসি জানায়, মৃতের সংখ্যা ২১০। দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্ত চার হাজারের বেশি মানুষ। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট রোগ ‘কোভিড-১৯’ ছড়ায়। তার পর থেকে কেবলই বিস্তৃতি ঘটছে রোগটির। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সর্বত্র কঠোর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সৌদি আরবে মুসলমানদের পবিত্রতম স্থান মক্কার কাবা শরিফে ওমরাহ পালন এবং মদিনায় মসজিদে নববীতে রাসূলুল্লাহ সা:-এর মাজার জিয়ারতের সুযোগ বন্ধ করে দিতে হয়েছে। সারা বিশ্বের পর্যটকরা প্যারিসের যে ল্যুভর মিউজিয়াম দেখতে ভিড় করেন, সেটিও বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। কোয়ারেন্টাইন বা রোগ সংক্রমণের শঙ্কায় পৃথক রাখার ব্যবস্থা এবং ভ্রমণ-নিষেধাজ্ঞার কারণে চীনের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। শিল্পকারখানা বন্ধ রয়েছে এবং চীন কার্যত সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের তথ্য মতে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বিশ্বের আর্থিক ক্ষতি হতে পারে এক লাখ কোটি ডলারেরও বেশি। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশ সতর্কতা হিসেবে ভাইরাস উপদ্রুত এলাকায় ভ্রমণ-নিষেধাজ্ঞা, শহর অবরুদ্ধ করা, বাসিন্দাদের ঘরে অবস্থান করতে বলা, ফুটবলের মতো বিভিন্ন বড় অনুষ্ঠান বা বাণিজ্যমেলা বাতিলের মতো ব্যবস্থা নিচ্ছে। অর্থাৎ করোনাভাইরাস একটি মূর্তিমান আতঙ্কের মতো হাজির হয়েছে বিশ্ববাসীর সামনে।
প্রতিবেশী ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর আসার পর বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন অনেক। সরকারিভাবে কিছু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে সেটি নিশ্ছিদ্র নয়। সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, বিমানবন্দরে এ জন্য যে সাতটি থার্মাল স্ক্যানার আছে তার মধ্যে ছয়টিই নষ্ট। নতুন করে আমদানির অর্ডার দেয়া হয়েছে। এই একটি তথ্য জানার পরই দেশের সরকারিপর্যায়ের সতর্কতার আর কোনো তথ্য জানার দরকার আছে বলে মনে হয় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বরং জনগণের সতর্কতার ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত মনে করি। তার আগে জানা দরকার, করোনাভাইরাস কতটা মারাত্মক বা কতটা প্রাণঘাতী! দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে।
বিবিসি বাংলার এক খবরে বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকি কতখানি, বলা কঠিন। তবে গবেষকদের মতে, প্রতি এক হাজার জনে পাঁচ থেকে ৪০ জনের মৃত্যু হতে পারে। ধারণা করা হয়, সবচেয়ে কাছাকাছি অনুমান হচ্ছে এক হাজার জনে ৯ জন। অর্থাৎ প্রায় ১ শতাংশ। এ বিষয়টি মনে রাখার মতো। এই ভাইরাসে ১০০ জন আক্রান্ত হলে মারা যেতে পারেন একজন। সেটাও অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে : আক্রান্ত ব্যক্তির বয়স, নারী না পুরুষ, স্বাস্থ্য ভালো না খারাপ এবং আক্রান্ত ব্যক্তি যে দেশের নাগরিক, সে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দক্ষতা ইত্যাদি। খবরে বলা হয়, চীনে আক্রান্ত ৪৪ হাজার মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, মধ্য বয়সী মানুষের চেয়ে বয়স্ক মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি ১০ শতাংশ বেশি। মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম ৩০ বছরের কম বয়সী লোকজনের মধ্যে। ৩০-এর কম বয়সী সাড়ে চার হাজার আক্রান্তের মধ্যে মারা গেছে আটজন। এ ছাড়াও আগে থেকে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ অথবা হৃৎপিণ্ড কিংবা ফুসফুসের রোগ আছে, এমন লোকদের করোনাভাইরাসে মৃত্যুর ঝুঁকি অন্তত পাঁচগুণ বেশি। এ ছাড়াও করোনাভাইরাসের একটু বোধহয় ‘নারীবাদী’ প্রবণতা আছে। গবেষকরা বলছেন, এই রোগে পুরুষের তুলনায় নারীদের মৃত্যুর হার কিছুটা কম। এই যে বিষয়গুলোর কথা বলা হলো, সেগুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। তাই প্রত্যেক জায়গায় প্রত্যেক মানুষের ব্যাপারে, এই মৃত্যুর হার সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশের একজন রোগী যত সহজে এই রোগে নাজুক হয়ে পড়বেন, উন্নত বিশ্বের কোনো রোগী এতটা না-ও হতে পারেন।
তবে সবাই একমত যে, সতর্কতার মাধ্যমে করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি রোধ করা সম্ভব। সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি কমিয়ে আনা যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, হাত ধুয়ে এবং যাদের কাশি হয়েছে কিংবা হাঁচি দিচ্ছে, তাদের এড়িয়ে চলার মাধ্যমে এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব। ইউনিসেফ বলছে, শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য অসুখের মতো নাক দিয়ে পানি পড়া, গলা ব্যথা, কাশি ও জ্বরসহ হালকা লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে এই ভাইরাস। কিছু মানুষের জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এর ফলে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং কোনো কোনো অঙ্গ বিকল হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। সংস্থাটি এ কথাও জানাচ্ছে, খুব কম ক্ষেত্রেই এই রোগ মারাত্মক হয়। চীনের অভিজ্ঞতার বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, আক্রান্তদের ৮০ শতাংশের প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা নেই, ১৫ শতাংশের চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। আর ৫ শতাংশের অবস্থা হয় গুরুতর, যাদের জন্য ‘নিবিড় পরিচর্যা’র প্রয়োজন হচ্ছে। প্রবণতা বলছে, কোনো দেশে এই ভাইরাস একবার ঢুকে পড়লে তার জনসংখ্যার ২৫ থেকে ৭০ শতাংশই এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। তাই সব মিলিয়ে বলা যায়, পরিস্থিতি ভালো নয় মোটেও।
এ কথাও ঠিক, করোনাভাইরাস আগেকার দিনের কলেরা, গুটিবসন্ত, প্লেগের মতো প্রাণঘাতী নয়। শুধু মনে রাখতে হবে, ‘এটি মৌসুমি ফ্লুয়ের মতো দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং এতে মৃত্যুর হার সাধারণ ফ্লুয়ের চেয়ে দশগুণ বেশি।’ এ তথ্যটি এ জন্য মনে রাখতে হবে, যাতে আমরা প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনে অবহেলা না করি এবং মনে করিয়ে দিই, করোনাভাইরাস ও অন্যান্য রোগের বিস্তার সীমিতপর্যায়ে রাখতে মেডিক্যাল মাস্ক সাহায্য করে। তবে এটার ব্যবহারই এককভাবে সংক্রমণ বন্ধ করতে যথেষ্ট নয়। নিয়মিত হাত ধোয়া এবং সম্ভাব্য সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে মেলামেশা না করাই এই ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর সর্বোত্তম উপায়।
এ দিকে এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘিরে নতুন একটি বাস্তবতা সামনে এসেছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’র বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি খবর প্রচার করেছে বিবিসি। এতে বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের আশপাশের এলাকার বাতাসে এই প্রথম নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের মাত্রা কমে এসেছে। কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবিতে ‘নাসা’ এমনটাই দেখতে পেয়েছে। বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ায় এমনটি হয়েছে। উহানের আশপাশের সব কলকারখানা বন্ধ থাকা এবং যানচলাচল স্থবির হয়ে পড়ায় এটা ঘটেছে। ক্ষতিকর গ্যাস নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড মূলত মোটরযান ও শিল্পকারখানা থেকে নির্গত হয়। এটিকে বিবিসি চীনের জন্য একটি ‘উপকার’ হিসেবে প্রচার করেছে, যা প্রাণঘাতী একটি ভাইরাস সংক্রমণের বিষয় নিয়ে এক ধরনের মশকারার মতো মনে হয়েছে। আমরা বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথেই দেখতে চাই। আমাদের মনে হয়, বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারায় কার্বন গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা যে কমিয়ে আনতেই হবে এবং তাহলেই পৃথিবী মানুষের জন্য বাসযোগ্য থাকবে, এই সত্যেরই নমুনা দেখা গেছে উহানের বাতাসে দূষিত গ্যাসের উপস্থিতি কমে যাওয়ার ঘটনায়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা