ড. হামিদ আলগাবিদ : মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছি যার কাছে
- প্রফেসর ড. এম এ মান্নান
- ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২২:০৭, আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২২:২১
কর্মজীবনে আমি দেশে-বিদেশে টানা প্রায় ৩৩ বছর নানা পদ ও ভূমিকার সাথে জড়িত ছিলাম। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমি কাজগুলো নিয়েছিলাম সুযোগ হিসেবে। আমি সবসময় এগুলোর মানবপুঁজি হিসেবে ব্যবহারের কথা ভেবেছি। কর্মজীবনের পথ পরিক্রমায় ওআইসির সাবেক মহাসচিব ও নাইজারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. হামিদ আলগাবিদের সাথে আমার পরিচয় ঘটে, যা একসময় অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্কে রূপ নেয়। ড. আলগাবিদ ছিলেন ‘রেলি ফর ডেমক্র্যাসি অ্যান্ড প্রগ্রেস’ (আরপিডি-জামা) পার্টির নেতা এবং একাধারে আইনজীবী, ব্যাংকার ও টেকনোক্রাট। তিনি ১৯৮৩ সালে নাইজারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এ পদে ছিলেন। পরের বছর ওআইসির (ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা, ২০১১ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা) মহাসচিব হন। দুই মেয়াদে আট বছর, ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। মূলত এই সময়টিতেই তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়। বয়সে তিনি আমার চেয়ে দুই-তিন বছরের ছোট ছিলেন।
আলগাবিদের সাথে পরিচয়পর্বটি আমার জন্য বিস্ময়কর ছিল। আমি তখন আইডিবিতে (ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক) কাজ করি। আর উনি সবেমাত্র মহাসচিব পদে যোগ দিয়েছেন। আইডিবি ও ওআইসির সদর দফতর কাছাকাছি জায়গায়, সৌদি আরবের জেদ্দায়। একদিন বেলা ১১টা বা ১২টা হবে। ওআইসি সচিবালয় থেকে আমার কাছে ফোন আসে। টেলিফোনকারী আমাকে বলেন, ওআইসির মহাসচিব আমাকে খুঁজছেন। আমি অবাক। তিনি আমাকে কেন খুঁজবেন? আমি এমন কেউ নই। তা ছাড়া প্রটোকলেও এটা পড়ে না। প্রটোকলে আইডিবির প্রেসিডেন্টও তার অধীনস্থ। তিনি কাজ করেন রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে। তিনি হলেন সব রাষ্ট্রপ্রধানদের সেক্রেটারি জেনারেল। আর আইডিবি হলো অর্থমন্ত্রীদের জায়গা। তার গবেষণা শাখায় কাজ করি আমি। অবাক হয়ে আমি টেলিফোনকারীকে পাল্টা প্রশ্ন করি, আপনি কি ঠিক বলছেন?
উনি বললেন, হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। মহাসচিব আপনাকে স্মরণ করেছেন। আপনি কখন আসতে পারবেন?
আমি বললাম, যখনই বলবেন তখনই আসব।
বিষয়টি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। ফলে কিছুটা উচ্ছ্বসিতও ছিলাম। আমি গেলাম, বেলা সাড়ে ১১ বা ১২টা নাগাদ। আইডিবি ভবন থেকে ওআইসি সেক্রেটারিয়েট বেশি দূরে নয়, গাড়িতে ৩০ মিনিটের পথ। রুমে গিয়ে বসার পর প্রথমেই মহাসচিব বললেন, ‘ড. মান্নান, ইউ আর মাই টিচার’। আমি হতভম্ব, বলেন কি। আমি কিভাবে তার শিক্ষক হলাম। বয়সে কিছুটা ছোট হলেও কর্মক্ষেত্রে তিনি আমার চেয়ে অনেক ওপরে। তিনি নাইজারের অর্থমন্ত্রীও ছিলেন। নাইজার কিন্তু ফরাসিভাষী রাষ্ট্র। আলগাবিদ ফ্রেঞ্চের পাশাপাশি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। তিনি পিএইচডি করেছেন ‘ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’-এর ওপর। জানতে চাইলাম, কিভাবে আমি তার শিক্ষক হলাম। বললেন, পিএইচডি করার সময় একটি ইসলামিক সমাজ গঠনের জন্য এর ভিত্তির মৌলিক ধারণাটি কী হবে সে বিষয়ে লেখা খুঁজছিলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তোমার একটি বই পাই। সেখানে এ ব্যাপারে এত সুন্দরভাবে লেখা রয়েছে যে, আমি পুরো অধ্যায়টি হুবহু কপি করে তুলে দিয়েছি। বলেছি এটা তোমার বই থেকে নেয়া হয়েছে। সেই দিক দিয়ে তুমি আমার শিক্ষক। আমিও আর দ্বিধা না করে একে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করি। বলি, হ্যাঁ, তা তো বটেই, আপনি আমার ছাত্র।
আমি দেখি অত্যন্ত অমায়িক, অহমিকাহীন একটি মানুষ এই আলগাবিদ। একসময় তিনি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের পদের জন্য আফ্রিকা অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে লড়েছিলেন। আমার মনের মধ্যে তখন ভাবনার উদয় হলো যে ওনার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা গেলে মুসলিম বিশ্বের জন্য অনেক কাজ করা যাবে। আমার দেয়া ‘সোশ্যাল ইসলামিক ব্যাংকিং’-এর মডেলের কথা মনে এলো, যেখানে ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের কথা বলা হয়েছে। তখন পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের কথা কেউ ভাবেনি। তখন পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকিংয়ের মেমোরেন্ডামে দারিদ্র্যকে টার্গেট করার কথা বলেছে বলে আমার জানা ছিল না। তারা ব্যবসা করতে এসেছে, দারিদ্র্য দূর করার কাজ তাদের নয়। আমি যে মডেলটি দিয়েছিলাম সেটি ছিল একটি বিকল্প চিন্তাধারা। আলগাবিদ নিজে যেহেতু অর্থনীতিবিদ এবং উন্নয়ন অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেছেন তাই তার কাছে আমার ধারণা তুলে ধরা সহজ হবে বলে আমি বুঝতে পারলাম।
প্রথম সাক্ষাতের পর থেকে একের পর এক দেখা-সাক্ষাৎ ও বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় হতে থাকে। তার বাসাতেও যাতায়াত হতে লাগল। একসময় সম্পর্ক এমন ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হলো যে, আমি তার বাসায় কার্পেটের ওপর বসে, আধশোয়া অবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে নানা বিষয়ে আলোচনা করতাম। আফ্রিকানরা জীবনযাত্রায় খুবই সাদাসিধা। পশ্চিমাদের মতো স্টেরিওটাইপড নয়। তাদের মধ্যে পদ-পদবির অহমিকা কম। এরই মধ্যে আমি আমার দারিদ্র্যদূরীকরণ মডেলটি তার কাছে তুলে ধরি। তিনি এ ব্যাপারে একটি প্রেজেন্টেশন দিতে বললেন। আমি প্রেজেন্টেশন দেয়ার পর আলগাবিদ এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি বললেন, ড. মান্নান তোমার জন্য আমি কী করতে পারি? আমি বললাম, অনেক কিছুই তো করতে পারেন। কারণ আপনার সেই ক্ষমতা আছে। আমার এই মডেল মুসলিম বিশ্বে প্রবর্তন করতে পারেন। আমি যে থ্রি-সেক্টর (আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক ও স্বেচ্ছাসেবক খাত) মডেল তুলে ধরেছি সেটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলোকে লিখতে পারেন।
সত্যিই তিনি লিখতে শুরু করলেন। সেই চিঠির কপি এখনো আমার সংরক্ষণে আছে। চিঠিতে তিনি লিখেন যে, এই মডেল এতটাই চমৎকার যে এটা মুসলিম দেশগুলোতে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকেও চিঠি লিখেন। তার সাথে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার যতবার সাক্ষাৎ হয়েছে ততবারই বলেছেন ‘আমার ব্যাংকের কী হলো’। আমি এখানে সোশ্যাল ইনভেস্ট ব্যাংক (এসআইবিএল) স্থাপনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম (পরে এর নামকরণ হয় সোশ্যাল ইসলামিক ব্যাংক নামে) তা বাস্তবে রূপ নেয়ার পেছনেও আলগাবিদের অবদান অনেক। এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি তার মধ্যে ঐশ্বর্যময় মানবিকতার এ ধরনের বহু গুণ দেখেছি।
এসআইবিএল যখন চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমি তাকে ব্যক্তিগত ক্ষমতাবলে আমন্ত্রণ জানাই। আমার মতো নগণ্য একজন ব্যক্তির ওআইসির সিটিং সেক্রেটারি জেনারেলকে আমন্ত্রণ জানানো, কতটা হৃদ্যতা থাকলে পারা যায় তা ভেবে দেখার মতো। উনি রাজি হলেন, আসবেন। কিন্তু তার তো প্রটোকল রয়েছে। আমি তখন স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখি। আমি বললাম, এটা একটা ব্যক্তিগত সফর। প্রথমে তারা বিশ্বাসই করতে পারেনি। পরে যখন বুঝলো যে না সত্যিই তিনি আসছেন তখন আমার সমাদর বেড়ে গেল, এই দেশে যেটা হয় আরকি। মহাসচিবের সম্মানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নৈশভোজের আয়োজন করা হলো। আমাকেও সেখানে নিমন্ত্রণ করা হলো। তখন জীবন সম্পর্কে, আমাদের কৃষ্টি ও সভ্যতা সম্পর্কে আমার মনে কিছু ভাবনা উদয় হলো। আমরা মানুষকে মূল্যায়ন করতে পারি না। অথচ হামিদ আলগাবিদের মতো ব্যক্তিরা মহানুভবতার দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে কত উপরে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের আমার অপারগতা প্রকাশ করে বললাম, আমি তো প্রটোকলে পড়ি না। তখন পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন ফারুক সোবহান। তার সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল। তিনিই আমাকে জোর দিয়ে বললেন, আমি বলছি আপনি আসেন। আসলে আমার অহমিকা বা অভিমান কিছুই ছিল না। শুধু মনে করেছি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার মতো উপযুক্ত আমি নই। যা হোক, সেখানে যাওয়ার পর আমি আসল বিষয়টি বুঝতে পারি। সেটি হলো বাংলাদেশ ওআইসিতে একটি পদ চায়। তখনো ওআইসিতে একটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেলের পদ খালি ছিল। আমি যেন এ বিষয়ে চেষ্টা করি সেটি সরকার চায়। আমাদের জানা থাকা উচিত যে ওআইসির তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল তিন অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হন। একজন আসেন আরবিভাষী অঞ্চল থেকে, একজন ইংরেজিভাষী অঞ্চল ও একজন ফরাসিভাষী অঞ্চল থেকে। মধ্যপ্রাচ্য আরব ভাষাভাষী, আফ্রিকান দেশগুলো মূলত ফরাসিভাষী এবং বাকিরা ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চলে পড়েছে। বাংলাদেশ পড়েছে ইংরেজিভাষী অঞ্চলে। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হলো- পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্কসহ এসব দেশ। ইংরেজিভাষী অঞ্চলের পদটি তখনো খালি ছিল। আমি ভাবলাম দেশের জন্য আমার এ বিষয়ে কথা বলতে অসুবিধা নেই। তখন আমি আলগাবিদকে বললাম, দেখেন এটা সম্ভব কি না। যার কথা বলেছিলাম তিনিও ভালো লোক ছিলেন। তিনি আমার কোনো কথাতেই না করতেন না। এ কথাটিও রাখলেন।
আমি যখন এসআইবিএল করার উদ্যোগ নিই তখন আমার হাতে পর্যাপ্ত তহবিল ছিল না। তখন ব্যাংক গঠনের জন্য পেইড-আপ ক্যাপিটেল দরকার ছিল আট কোটি টাকা। আমরা চার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারলাম। ইসলামী ব্যাংকের পেইড-আপ ক্যাপিটেল ছিল আরো কম, তিন কোটি টাকা। কিন্তু এই টাকা জোগাড় করতেই উদ্যোক্তাদের হন্যে হয়ে দেশে বিদেশে নানা জনের কাছে ধরনা দিতে হয়েছে। আমি যখন ব্যাংক নিবন্ধনের জন্য গেলাম তত দিনে এই অঙ্ক বিশ কোটি হয়ে গেছে। তখন এই তহবিলের ঘাটতির কথা আলগাবিদকে বললাম। তখন তিনি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে দুই লাখ ডলারের বেশি দিয়ে সাহায্য করলেন। তিনি এই তহবিলের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিলেন আমাকেই। আমার শারীরিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় সম্প্রতি আমি তাকে এই পাওয়ার ফিরিয়ে দিয়েছি। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি তার শেয়ার বিক্রি করে মুনাফাসহ নিয়ে গেছেন।
এসআইবিএল গঠনের পেছনে আলগাবিদ, আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ, শেখ আহমেদ জুমজুম, আহমেদ নাজ্জারসহ আরো যারা সহায়তা করেছিলেন তাদের বদান্যতা আমি কিভাবে ব্যাখ্য কারব? ব্যাংকের ম্যামোরেন্ডাম অব আর্টিকেলে তারা লিখেছেন ‘দিস ইজ দ্য ইসলামিক ব্যাংক অব অনলি কাইন্ড’। যে ব্যাংক জনসাধারণের জন্য, যে ব্যাংক গরিবের জন্য, যে ব্যাংক দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য, যে ব্যাংক কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করবে- সেটিই সত্যিকারের ইসলামিক ব্যাংক। ব্যাংকিংয়ের ইতিহাসে এই প্রথম এসআইসিএলের মাধ্যমে তিন খাতের মডেল প্রবর্তন করা হয়। তবে আমাদের সার্বিক চাওয়া পুরোপুরি পূরণ হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম এই মডেলের ব্যাংকের জন্য পার্লামেন্টে আলাদা আইন করা হোক। যাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতার বাইরে থেকে ব্যাংকটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। সেটি হয়নি। হয়তো এ ব্যাপারে আমাদেরই দুর্বলতা ছিল। অর্থমন্ত্রীকে হয়তো বিষয়টি ভালোভাবে বুঝানো যায়নি। পার্লামেন্টে আইন পাস করা গেলে এই ব্যাংকের চেহারা পুরোপুরি অন্যরকম হতো। এই ব্যাংক চার শ’ পল্লী শাখা করার জন্য আবেদন করেছিল। এসব শাখার নাম দেয়া হয়েছিল ‘সবুজ হাট’। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি নীরব বিপ্লব সংঘটিত হতো বলে আমি মনে করি। সেটি হয়নি। একে ‘ইসলামিক মুভমেন্ট’ বলে ভাবনাটি ভুল ছিল। আসলে এটা ছিল গরিব মানুষের ‘ডেভেলপন্টে মুভমেন্ট’।
যা হোক, হামিদ আলগাবিদের সাথে আমার বন্ধুত্ব এখনো অটুট রয়েছে। তার আমন্ত্রণে আমি নাইজারে গিয়েছি। সেখানে আলগাবিদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন করেন। এই ফাউন্ডেশন করার জন্য আমরা প্রচুর তহবিল সংগ্রহ করেছি। সেখানেও ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের কাজ করা হচ্ছে। মহাসচিবের পদ থেকে বিদায় নেয়ার পর শেষবার ২০১২ সালে তিনি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তখন বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তার সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়। আমিও সেখানে ছিলাম। সেখানে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে ‘ওয়ার্ল্ড সোস্যাল ব্যাংক’ স্থাপনের জন্য উদ্বুদ্ধ করি। তিনি রাজিও হয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই ব্যাংকের সদর দফতর স্থাপনের জন্য ঢাকায় জমি দেয়া হবে। প্রস্তাব ছিল এর সদস্যপদ হবে প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, যাতে এখানে ব্যক্তিস্বার্থ স্থান না পায়। দুর্ভাগ্য যে তাকে বিষয়টি আবারো মনে করিয়ে দিয়ে কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া যায়নি। প্রস্তাবটি এখনো প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পড়ে আছে। এর বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারব কি না, জানি না। তবে ১৯৮০ দশকে যখন বাণিজ্যিক ব্যাংকের থ্রি-সেক্টর মডেল প্রস্তাব করি তখনো অনেকে আমাকে উপহাস করেছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সেটি বাস্তবায়িত হয়েছে এবং স্বীকৃতিও পেয়েছে।
আলগাবিদ আমার ক্যাশ ওয়াক্ফ ধারণায় এতটাই মুগ্ধ হন যে, এ ব্যাপারে আমার একটি বই নিজে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন এবং তা বিনামূল্যে বিলি করার ব্যবস্থা করেন। বইটির অনুবাদক হিসেবে তার নাম লেখা আছে। ঐতিহাসিক কোনো কারণে মুসলিম বিশ্বে একমাত্র আফ্রিকান অঞ্চলেই ওয়াক্ফর বিস্তার ঘটেনি। তার আমন্ত্রণে আমি নাইজারে গিয়েও দেখেছি সেখানে আলগাবিদ খুবই জনপ্রিয়। তিনি সাধারণ মানুষের সাথে অবাধে মিশছেন। বিশাল দেশের বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র। আয়তনে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ। কিন্তু মরুভূমি। পানির অভাবে কৃষিকাজ হয় না। ২০০৯ সালে আলগাবিদ আমার সিরাজগঞ্জের বাড়িতে আসেন। সিরাজগঞ্জে আমি একটি হাসপাতাল করেছি। একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রস্তাবনা সরকারের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। তিনি ‘দ্য গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি অব ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড টেকনলজি’ নামে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
আলগাবিদের সাথে আমার সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয় ২০১৭ সালে আমেরিকার মেমফিসে। সেখানে আমার ছেলে রয়েছে, সে ডাক্তার। আর আলগাবিদের জামাই কাজ করত ডিএইচএলে। ডিএইচএলের হেডকোয়ার্টার সেখানে। সেই সুবাদে আলগাবিদের জামাই আমার ছেলের বাসায় যাওয়া-আসা করত। সেখানেই আমাদের দু’বার দেখা হয়। উনি আবারো বাংলাদেশ আসতে চেয়েছিলেন; কিন্তু বয়সের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি।
আসলে মহামানব হতে হলে নিজেকে অনেক ছোট হতে হয়। আলগাবিদের কাছ থেকে সেই শিক্ষা আমি পেয়েছি। তাদের মতো নিরহঙ্কারী মানুষের কাছ থেকে আমি মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছি। একজন বিদেশী হয়ে আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি যে অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছেন তা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা