২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

স্রষ্টা ও সৃষ্টি : এক অপরূপ বৈচিত্র্য

-

সৃষ্টজগতের বিভিন্ন সৃষ্টির একটির সঙ্গে আরেকটির মিল বা সামঞ্জস্য নেই। অগণিত সৃষ্টির মধ্যে কারো পরিমাপ, রূপ, কণ্ঠের স্বর, চেহারা এক নয়। পৃথিবীর সব রাষ্ট্র থেকে মুসলিমরা সৌদি আরবে হজ করার জন্য সমবেত হয়। এ বছর (২০১৯) মক্কার পাশের মিনা, মুজদালিফা, আরাফাত ময়দান, কাবা মোবারক, মসজিদে নববীতে (মদিনা) লাখ লাখ লোকের সমাবেশ দেখলাম, দেখলাম তাদের বিভিন্ন ভাষা, রঙ, আকার এবং চেহারা। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সমাবেশ এটি। মক্কা বা মদিনায় হজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিতদের মতে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ৪৫ লাখ মুসলমান নর-নারী এ বছর হজব্রত পালন করেছেন। বাংলাদেশ থেকে এ বছর এক লাখ ২৭ হাজারের অধিক নর-নারী হজ করেছেন। ৫৬টি মুসলিম দেশ ছাড়াও পৃথিবীর এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যেখান থেকে হজ পালন করতে মুসলিমরা আসেননি। ইহুদি-খ্রিষ্টান রাষ্ট্র আমেরিকা ও ব্রিটেন থেকে অনেক মুসলমান লাব্বায়িক ধ্বনিতে শরিক হয়েছেন। যেসব রাষ্ট্রে মুসলমানদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন হচ্ছে যেমন- ভারত, জম্মু কাশ্মির, নেপাল, চীন প্রভৃতি এলাকা থেকেও মুসলিম নর-নারীরা হজ পালনে এসেছেন। শিশু, কিশোর, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারে না, এমন অতিশয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও দেখলাম যারা হজরত মুহাম্মদ সা: রওজা মোবারকে সালাম পেশ করার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। সব চেয়ে আশ্চর্য বিষয় এই যে, লাখ লাখ মানুষের মধ্যে কারো সাথে কারো চেহারা, কণ্ঠস্বরের মিল দেখা গেল না। একই দেশ, একই পরিবার থেকে এসেছে কিন্তু চেহারা বা কণ্ঠের সাথে কারো কোনো মিল নেই। পাঞ্জাবি, বাঙালি, কোরিয়ান, নেপালি, সুদানি, মিসরি, চীনা, ইরানিদের শরীরের গঠন দেখে বোঝা যায় তারা কোন দেশের, তার পরও নিজেদের মধ্যেও কারো চেহারার সাথে কারো চেহারা বা কণ্ঠের কোনো সঙ্গতি নেই। এ অসঙ্গতি থেকে বোঝা যায়, সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টির মধ্যে কত বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে পারেন।

অপরাধ বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, গবেষকরা প্রমাণ পেয়েছেন যে, যমজ দুই ভাইয়ের আঙুলের ছাপে মিল নেই। ব্রিটিশ ভারতের কুচবিহারের সিভিল সার্জন Sir William Herschel মানুষের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে আবিষ্কার করেন যে, বয়স বৃদ্ধি পেলেও আঙুলের রেখার কোনো পরিবর্তন হয় না। খ্রিষ্টের জন্মের ১৭৯২-১৭৫০ পর্যন্ত নরম মাটিতে আঙুলের ছাপ গ্রহণের নিয়মনীতি চালু ছিল। ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দে Dr. Nehemiah মানুষের হাত মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে আঙুলের রেখা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতেন। ১৭৮৮ সালে Johann Mayer আবিষ্কার করলেন যে, দুইজনের হস্তরেখা এক নয় এবং একজনের হস্তরেখার সাথে অন্যজনের হাতের রেখা কোনো দিনই মিলবে না। এ কারণেই চীনে দলিল বা মূল্যবান প্রমাণাদিতে আঙুলের ছাপ তিন হাজার বছর আগে ব্যবহার শুরু করে।

বারবার যারা অপরাধ করে তাদের শনাক্ত করার জন্য ১৮৮৩ সালে Alphonse Bertillon আঙুলের রেখার ওপর গুরুত্ব দেয়ার নিয়ম চালু করেন। Sir Francis Galton Ges Sir Edmund Richard Henry আঙুলের রেখাকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেন। ১৮৯১ সালে থেকে Ivan (Juan) Vucetich ১০টি আঙুলের রেখার ছাপ ব্যবহার করার প্রচলন শুরু করেন।

গবেষণায় আরো দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের চোখ, ঠোঁট, চোখের দৃষ্টিপাত, এমনকি চোখের ভেতরে চোখের মনির আশপাশে যে রগ আছে তাতেও কারো সাথে কারো মিল নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞান এমনি ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে যে, মানুষের অঙ্গের প্রতি স্তরের আলাদা ভিন্নতা রয়েছে যা থেকে একজনকে আর একজনের সাথে আলাদা করা যায়।

অপরাধ বিজ্ঞান বা অপরাধী শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা এখন ডিএনএর ওপর নির্ভরশীল। ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা যায় যে, একজন মানুষের সাথে অন্য একজনের ৯৯ শতাংশ মিল থাকলেও এক শতাংশ জায়গায় গরমিল থেকেই যায় (উপরিউক্ত তথ্যগুলো এফবিআই থেকে প্রকাশিত জার্নাল থেকে গৃহীত)।

একই ফল যেমন আম ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আছে যার আবার জায়গা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ রয়েছে। থাইল্যান্ড থেকে আম গাছ আমদানি করে বাংলাদেশে রোপণ করলে একই স্বাদ বহন করে না। সৃষ্টির ক্ষেত্রে একই প্রকারভেদ প্রাণী জগৎ, উদ্ভিদ জগৎ, জলজপ্রাণী প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেন সৃষ্টিরহস্য লুক্কায়িত। বায়ুমণ্ডলের প্রকারভেদ ও কার্যক্রম আরো রহস্যজনক।

পৃথিবীর অনেক রহস্য এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে যা আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীরা ছুটে চলছেন। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে না সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে- এ নিয়েও বিজ্ঞান যখন তল্লাশি চালাচ্ছিল তখন ১ হাজার ৫০০ বছর আগেই আল কুরআন বলেছে যে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে এবং সূর্য ও চন্দ্র নিজ নিজ কক্ষপথে চলে কেউ কাউকে অতিক্রম করে না। সাম্প্রতিককালে প্রায় ২০০ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন যে, গাছের প্রাণ আছে। কিন্তু প্রায় এক হাজার ৫০০ বছর আগে আল কুরআন ফয়সালা দিয়েছে, তরুলতা অর্থাৎ গাছ সৃষ্টিকর্তাকে সেজদা করে। আল কুরআনের মতে, পাখিরাও ভিন্ন ভিন্ন সুরের মাধ্যমে সৃষ্টি কর্তাকে স্মরণ করে। সৃষ্টিকর্তা অনেকটা অহঙ্কারের সাথেই বলেছেন যে, মানুষের দেহ পচে গলে শেষ হয়ে গেলেও তাকে আমি পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম। তিনি হজরত মূসা আ:-কে পরীক্ষা করার জন্য নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন যে, একটি পাখিকে জবাই করে চার টুকরা করে চারটি পাহাড়ে রেখে এসে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে ডাকো। আর পাখিটি জীবন্ত হয়ে উঠে আসার কথা আল কুরআন সাক্ষ্য দেয়।

পৃথিবীতে ভাষা, ধর্মের কোনো অভাব নেই। ভাষাবিদদের গবেষণায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশেই ৪৫টি নৃগোষ্ঠী রয়েছে যাদের নিজস্ব মাতৃভাষা আছে এবং ধর্ম ও সংস্কৃতি আলাদা। পৃথিবীতে ধার্মিক ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসীদের সংখ্যাই বেশি। নাস্তিক যারা সৃষ্টি কর্তায় বিশ্বাস করে না তাদের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম, তবে নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য গলাবাজিতে তারা একটু বেশি উচ্চকিত, প্রচার মাধ্যমে তাদের পৃষ্ঠপোষক অনেক রয়েছে।

আচরণগতভাবেও একই পরিবারে বেড়ে ওঠা, একই সমাজে লালিতপালিত মানুষের মধ্যেও বিপরীতমুখী চরিত্র দেখা যায়। এখানেও সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাটাই প্রধান। আল কুরআনের সাক্ষ্যমতে তিনি (সৃষ্টিকর্তা) যাকে ইচ্ছা তাকেই সৎ পথে পরিচালিত করেন।

আল কুরআনের সাক্ষ্যমতে, ভাষাজ্ঞান ও কলম সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। এ কলম ও ভাষাই পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আবার অনেকের কণ্ঠ কেড়ে নেয়া হয়েছে, যারা কথা বলতে পারে না। এটাও সৃষ্টিরই একটি রহস্য। মরণব্যাধি ক্যান্সার অত্যন্ত জটিল। কিন্তু কোন কারণে ক্যান্সার হয় তা সুনির্দিষ্টভাবে এখনো আবিষ্কার হয়নি। ফলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিজ্ঞানের এ যুগেও অনেক আবিষ্কারই রহস্যের মধ্যে ঘনীভূত হয়ে রইল যার কূলকিনারা এখনো বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারছে না।

স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একই বিষয় কোথাও বৈধ, কোথাও অবৈধ, কোনো ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য, অন্যক্ষেত্রে নিন্দনীয়। সময় ও সমাজ এ মর্মে একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। খরস্রোতা নদীও মরে যায়। একূল ভেঙে ওকূল গড়ে। রাজা-প্রজায় পরিণত হয় আবার প্রজাও রাজা হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। আজকে ধনী কালকে ফকির, কালকের ফকির আজকের ধনী। নিয়তির এ খেলা চিরন্তন। নিয়তির নিয়ন্ত্রক ছাড়া কেউ তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শুধু ব্যর্থ নয়, বরং অপারগও বটে।

বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে সৃষ্টির তথ্য আরো বিস্ময়কর। মহাজাগতিক ভাঙা-গড়ার দৃশ্যাবলি আরো অবিশ্বাস্য। নভোমণ্ডলে এমন সব দূরবর্তী গ্রহ-নক্ষত্র রয়েছে যেখানে আলোর গতিতে ছুটলেও পৌঁছতে লাগবে আমাদের সময়ের বহু সহস্র কোটি বর্ষ। মহাশূন্যের অজানা তথ্য আরো কত গভীরে, কত বিলিয়ন ট্রিলিয়ন আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দিলে মহাকাশের সীমানা পাওয়া যাবে তা বিজ্ঞানীরা এখনো আবিষ্কার করতে পারেননি। এ মর্মে সৃষ্টিকর্তার ঘোষণা আরো স্পষ্ট। তিনি বলেছেন ‘হে জিন ও মানবকুল। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সীমা তোমরা যদি অতিক্রম করতে পার, তবে অতিক্রম করো, কিন্তু ছাড়পত্র ছাড়া তোমরা তা অতিক্রম করতে পারবে না।’ সে ছাড়পত্র একজনই পেয়েছিলেন যিনি হজরত মুহাম্মদ সা:।

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: aimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement