বুক ‘ফাইট্যা’ যায় কেন?
- মিনার রশীদ
- ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২০:৫৮
আসুন, পুলিশ অফিসার দম্পতি ঐশীর বাবা-মায়ের জীবনের শেষ কয়েকটি মুহূর্তের কথা একটু চিন্তা করি। আদরের মেয়ের হাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে দু’জনই তন্দ্রায় চলে যান। নিদান সময়ে চেয়ে চেয়ে দেখছেন, আদরের মেয়ে ছুরি হাতে দু’জনের গলা কাটছে। এরা যদি তাদের কলিগদের সাথে এখন কমিউনিকেট করতে পারতেন, বুকে হাত দিয়ে বলুন- তবে আলোচিত মিজানুর রহমান আজহারীর দেশত্যাগ নিয়ে তাদের কী বলতেন?
দেশ, জাতি ও ধর্মের নাকি ‘মারাত্মক ক্ষতি’ করে ফেলেছেন এই ব্যক্তি! তাকে নিয়ে এই সমালোচনা বা তর্ক শুরু হওয়ার পর তার বক্তৃতা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। তরুণ এই বক্তার টার্গেট তরুণসমাজ। তরুণসমাজের নিজস্ব ভাষায় এবং তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ভঙ্গিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামাজিক মেসেজ ট্রান্সলেট বা ট্রান্সমিট করার ক্ষমতা তার রয়েছে। তার বক্তব্যের অধিকাংশ বিষয় হলো, তরুণসমাজের চারিত্রিক, নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতি। সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় তরুণসমাজের বড় অংশ পর্নোগ্রাফি, ড্রাগ ইত্যাদিতে আসক্ত। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে ইন্ডিয়ান সিনেমা ও টিভি সিরিয়ালের পরকীয়ার কোচিং, দাম্পত্য সন্দেহ। এটা ঘরে ঘরে অশান্তি সৃষ্টি করছে, আদরের দুলালী ঐশীরা নিজের বাবা-মায়ের গলায় এখন ছুরি না বসালেও কাছাকাছি কিছু বসাচ্ছে।
প্রতিপক্ষ তারকাদের অভিযোগ, ‘আজহারী কথায় কথায় ইংরেজি মারেন।’ তবে কথা হলো, তার এই আরবি-বাংলা-ইংরেজি বলার স্টাইলটি সাবলীল। তিনি মূলত পাক ভারত উপমহাদেশের শিক্ষিত শ্রেণীর ইংরেজি মিশিয়ে মাতৃভাষায় কথা বলার ঢংটিই রপ্ত করে ফেলেছেন। অন্য ওয়ায়েজিনদের তুলনায় একটু বেশিই রপ্ত করেছেন।
তরুণ এই বক্তা এক শিল্পীর বুক যেমন করে ফাটিয়েছেন তেমনি ফাটিয়েছেন কয়েকজন ইসলামী বক্তা। কেউ তাকে চিৎকার করে ‘বাটপার’ ডেকেছেন, বৃষ্টি না হলে ‘জনপ্রিয়তা’ কাকে বলে তা দেখিয়ে দিতেন। আবার কেউ তার মোকাবেলায় নিজে বাঙালি হয়েও ইংরেজি না জানা বাঙালি দর্শকদের সম্মুখে হাস্যকর পন্থায় পুরো ইংরেজিতে ওয়াজ করেছেন! একদল মানুষ কতটুকু হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে, উপরের বর্ণিত দৃশ্যগুলো তারই প্রমাণ! দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা কিভাবে এক হয়ে গেলেন সেটি কয়েক মাস ধরে ‘টক অব দি কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে। ওয়াজ মাহফিল, সংসদ ভবন, মন্ত্রণালয়, ইউটিউব, ফেসবুক সর্বত্র আলোচনার বিষয় ছিলেন আজহারী। এ দেশের ইয়াবা সম্রাটরা এখন ইয়াবার বিরুদ্ধে এবং অশ্লীলতার সম্রাজ্ঞীরা এখন অশ্লীলতার বিরুদ্ধে ‘জেহাদে’ নেমেছেন।
এই দেশের ইতিহাসে দু’জন পাওয়ারফুল মমতাজের দেখা মিলবে। মৃত মমতাজ মহলের চেয়ে জীবিত মমতাজের শক্তি ও ঐশ্বর্য কোনোক্রমেই কম হবে না।
শাহজাহান যে টাকা দিয়ে তাজমহল বানিয়েছিলেন, সেই টাকা স্ত্রীর নামে বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় বা এ রকম কোনো জনহিতকর কাজে ব্যবহার করলে আজকে ভারতে মুসলিমদের ইতিহাস অন্য রকম হতে পারত। অনেকেই বলতে পারেন, সে সময় পৃথিবীতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, তাজমহল বানানো শুরু হয়েছিল ১৬৩২ সালে এবং তাতে খরচ হয়েছিল ৩২ মিলিয়ন রুপি। এর ৩২৭ বছর আগে ১২৫৯ সালে ইংল্যান্ডে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় তারও ৫০ বছর আগে ১২০৯ সালে এবং রাজকীয় আনুকূল্য পায় ১২৩১ সালে (Granted a royal charter by King Henry III).
কাজেই আমাদের এই ‘আলুর দোষ’ বা মাজনুন দিল অনেক আগে থেকেই। কোন যোগ্যতায় গায়িকা ১৬ কোটি মানুষের আইনপ্রণেতা সেটি জানতে চাইলে লাখে লাখে মৌমাছি আমার পানে তেড়ে আসবে। জানি না, আমাদের এই ‘শাহজাহান’দের হুঁশ আর কয় হাজার বছর পর ফিরবে?
মুহতারামা জীবনে যতগুলো গান গেয়েছেন, সেসব গানের কথা এমনকি গানগুলোর প্রথম কলি উল্লেখ করলে এটি কলাম না হয়ে রীতিমতো একটি চটি হয়ে পড়তে পারে। এক প্রতিমন্ত্রী রাত ১১টা পর্যন্ত ঈদের চাঁদ দেখতে ব্যর্থ হলেও ‘জামায়াতের প্রডাক্ট’ হিসেবে আজহারীকে সন্ধ্যা রাতেই চিনে ফেলেছেন! তাকে সমর্থন জানিয়ে সংসদে বক্তব্য রেখেছেন কেউ কেউ।
ফেসবুক ও ইউটিউব খুললেই নাকি ওয়াজ মাহফিলে ‘অশালীন এবং অকথ্য’ ভাষার কারণে বিব্রত বোধ করেন অনেক চটুল গানের কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী। আজহারী দেশ ছাড়ার পরও মেননদের আক্রোশ কমেনি। মনে হচ্ছে, ৩২ বছরের এই যুবককে সাজা দিতে পারলে মন্দ হতো না।
শোনা যাচ্ছে আজহারীর কারণে লাল টমেটোর ব্যবসা, ক্যাসিনো ব্যবসা এবং ড্রাগ ব্যবসা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল। সাথে সাথে মাজার ব্যবসা এবং ওয়াজ মাহফিলে কিসসা-কাহিনীর ব্যবসাও হুমকির মুখে পড়ে যায়। ফলে তাদের সবার মাঝেই এক ধরনের ঐক্যের সৃষ্টি হয়ে পড়ে। তাকে জব্দ করার জন্য এই গোষ্ঠী বোধহয় ওঁৎ পেতেছিলেন। এ ধরনের মতভিন্নতা প্রচুর রয়েছে, যাতে প্রতিপক্ষকে ঠিকভাবে ধরতে পারলে ‘যে দিকে ইচ্ছা সেদিকেই শুইয়ে ফেলা’ যায়।
এ দেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু হয়ে গেছে। বিয়েশাদি এবং অন্যান্য পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানকে কালারফুল বানাতে গিয়ে হিন্দি সিনেমা বা সিরিয়ালের অনুকরণ করা হচ্ছে। একটা শ্রেণী ‘ভালগার ডিসপ্লে অব ওয়েলথ’-এ মত্ত। যারা এগুলো করতে পারছে না তাদের মধ্যে অভাববোধ বা হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে! মুসলিম কিংবা বাঙালি, উভয় সংস্কৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পোশাক সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর এবং ক্রমান্বয়ে আরে ডেঞ্জারাস দিকে রওনা দিয়েছে। শিশুদের হাতে হাতেও পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ ১০০ কোটি টাকা খরচ করে যে বিয়ের আয়োজন হয় কখনো বা তার স্থায়িত্ব ১০০ দিনও হয় না।
সেসব নিয়ে কোনো টেনশন বা মাথাব্যথা দেখা যায় না। এসব সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় চ্যালেঞ্জকে আবেগি হুঙ্কারের পরিবর্তে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবেলার কার্যকর কোনো পন্থা সমালোচকদের হাতে নেই কেন?
তাদের মাথাব্যথা, কেন জানালেন যে মেয়েদের মুখ খোলা রাখার ইসলামে অনুমোদন রয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে ইসলামিক স্কলারদের দেয়া দু’টি অপশনের (মুখ ঢাকা ও মুখ খোলা রাখা) কথাই বলা হয়েছে। একটা বিষয় অনেকেই লক্ষ করে থাকবেন, ইসলামের উদার বা মধ্যপন্থী ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে, কট্টরপন্থীদের সাথে ইসলামবিদ্বেষী গ্রুপগুলো আশ্চর্যজনকভাবে এক হয়ে পড়ে। ইউরোপের অনেক দেশে নেকাবকে ‘সিকিউরিটি থ্রেট’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এর যৌক্তিক কারণটিও অবোধগম্য নয়।
বিষয়টি আধুনিক মুসলিম মানসকেও ধাক্কা দেয়। একজন ঈমানদার হিসেবে এসব দেশ অ্যাভয়েড করুন অথবা গ্রহণযোগ্য উপায় অবলম্বন করুন। আর সেই অল্টারনেটিভ উপায়টি যদি ইসলাম জেনুইন সোর্স থেকেই আপনার সম্মুখে হাজির করে তাতে গোস্বা করার কারণটি বোধগম্য হচ্ছে না। ঈমানের তারতম্য অনুসারে দেয় পুরস্কারের নিমিত্তে বেহেশত সাতটি রয়েছে। আপনি মুখ ঢেকে রেখে এবং তার পক্ষে প্রচার করে এক নম্বরে চলে যান, সেই চেষ্টায় তো কেউ বাধা দিচ্ছে না। কেউ যদি মুখটি খোলা রাখেন, তাতে এত রাগ করার কী আছে? কোনো মেয়ে যদি নিজ থেকে নেকাব পরেন, তার প্রতি যেমন শ্রদ্ধা থাকা দরকার, তেমনি কেউ যদি মুখটি খোলা রাখতে চান তার প্রতিও অশ্রদ্ধা পোষণ করা ঠিক হবে না। যে হিংসা, ক্রোধ, ঘৃণা ইসলামের অপার সৌন্দর্যকে ঢেকে দেয়; সেগুলোর সমুদ্রে ভেসে থেকে দু-একটি বাহ্যিক নির্দেশ পালন আর যাই হোক ইসলামকে মহান করবে না।
আলোচিত নারী যখন তাফসির মাহফিলে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন, সেই আন্দোলন ‘সফল না হয়ে যায় না’। যে তরুণ ও স্মার্ট যুবকদের যাওয়ার কথা কনসার্টে, তারা কেন দলে দলে মাহফিলে ছুটছে, এটিই মনোবেদনার কারণ। বিষয়টি কারো কারো বুক যেমন ‘ফাটাইয়া’ ফেলেছে, তেমনি মাথাওয়ালা সমাজচিন্তকদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে।
অমৌলবাদীদের বুক কেন ফাটে, সেটা উপলব্ধি করা সহজ হলেও অন্যান্য ব্যক্তির দিল কেন ফাটছে- তা মালুম হচ্ছে না। প্রতিটি সমাজে ধর্মীয় ‘মোরাল ব্রিগেড’ এবং ভোগবাদী খাও-দাও-ফুর্তি করো ব্রিগেডের মাঝে দ্বন্দ্ব অত্যন্ত স্বাভাবিক।
আমাদের চিফ হুইপের ফর্মুলা অনুসারে ইসলামের মহান খেদমতের জন্য এ মহান শিল্পীকেও আমরা ‘হজরত’ উপাধিতে ভূষিত করতে পারি। নতুন এবং পুরনো ‘হজরত’ সবার কোশেশ উল্কার বেগে ধেয়ে আসা তরুণ একজন বক্তাকে ঠেকানো। তারা সফল হয়েছেন। এই ওয়ায়েজকে তার তাফসির মাহফিল বন্ধ করে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়েছে।
সাপের বিষ নষ্টের জন্য যে বেজি মুখে ওষুধ নিয়ে এলো, তাকেই ‘হত্যা করা হলো’! কাদের হাতে আমাদের ইহকাল ও পরকালের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব তুলে দিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছি! জানি না আমাদের এই মরণ ঘুম কখন ভাঙবে?
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা