২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পালক পুত্র/কন্যা গ্রহণ সম্পর্কে

-

একটি সেমিনারে শিশুদের দত্তক গ্রহণ সম্পর্কে আলোচনা হয়। এ প্রসঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি তুলে ধরছি :
পৃথিবীর সব দেশেই কিছু পরিবারে সন্তান থাকে না। সেসব পরিবার সাধারণত পালনের জন্য অন্যের সন্তান গ্রহণ করে থাকে। এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ প্রত্যেকেরই সন্তানের কামনা থাকে। বাংলাদেশ এবং যেকোনো দেশে অসহায় শিশুর সংখ্যা অনেক। এসব শিশুর অনেককে সন্তানহীন পরিবার পালনের জন্য গ্রহণ করে থাকে। অনেক পরিবার মানবিক দায়িত্ব মনে করেও এ ধরনের দু-একজন শিশুকে মানুষ করে থাকে। অনেকেই গরিব আত্মীয়স্বজনের সন্তানকেও পালনের জন্য গ্রহণ করে।

অনেক সময় দু-এক দিনের শিশুকে পথে পাওয়া যায়। বিশেষ করে অবৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে যেসব শিশু জন্মগ্রহণ করে তাদেরকে পথে রেখে দেয়া হয়, এই মনে করে যে কেউ-না-কেউ তাকে তুলে পালবে। প্রকৃতপক্ষেই অনেক সহৃদয় ব্যক্তি তাদের তুলে নিয়ে মানুষ করে থাকেন। এসব শিশুকে উদ্ধার করার জন্য সামাজিক ব্যবস্থাও থাকা উচিত। এসব অল্প বয়স্ক শিশুকে রক্ষা করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ জন্য প্রত্যেক হাসপাতালে ও এতিমখানায় বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিত।

বিশেষ করে অবৈধ বা বেওয়ারিশ শিশুদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে আন্তঃদেশ দত্তক আইন প্রণয়ন করেছিল। এ আইনের আওতায় বাংলাদেশের শিশুদের বিদেশীদের কাছে দত্তক দেয়া হতো। পরে এ আইন বাতিল করা হয়। বিদেশে এসব শিশুর অপব্যবহারসংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ আইন বাতিল করা হয়েছিল। তদুপরি দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক আমাদের দেশের মুসলিম শিশুদের খ্রিষ্টানদের কাছে প্রতিপালিত হওয়া সঙ্গত মনে করেননি এবং এ দেশেই ব্যবস্থা করা তারা সঙ্গত মনে করেছেন। কেননা কিছু শিশুকে বিদেশে দত্তক দিলেই আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না।

অবৈধ শিশু ছাড়া অন্য পালিত শিশুদের জন্যও আমাদের দেশে কোনো আইন নেই। তাই এসব শিশুর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে পালকের মর্জির ওপর। পালক যদি ভালো হন তাতে তাদের ভবিষৎও উজ্জ্বল হয়। নতুবা তারা পরবর্তী সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে পড়ে। এসব কিছু বিবেচনা করে পালিতদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

এ ধরনের আইন প্রণয়নের সময় দেশের জনগণের ধর্মীয় আইনের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। কেননা আমাদের জনগণের কাছে এমন কোনো আইন গ্রহণযোগ্য হবে না যা ধর্মের কোনো মূলনীতির বিরোধী। এ প্রসঙ্গে ইসলাম কী বলে তা প্রথমত দেখা যেতে পারে। ইসলাম অসহায় শিশুকে অত্যন্ত ভালোবাসার নজরে দেখে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতগুলো উল্লেখ করা হলো :
হে নবী! লোকে তোমাকে এতিমদের সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলো, তাদের সুব্যবস্থা করা উত্তম (সূরা বাকারা, ২:২২০)।

(আল্লাহ তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন) সেই হুকুমগুলো যা অসহায় শিশুদের সম্পর্কে তোমাদের দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে এতিমদের প্রতি ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করবে (সূরা আন নিসা, ৪:১২৭)।

এমিতদের তাদের ধনসম্পদ দিয়ে দাও এবং তাদের সাথে সম্পদ বদল করবে না। তোমাদের সম্পদের সাথে তাদের সম্পদ মিশিয়ে গ্রাস করো না (সূরা আন নিসা, ৪:২)।

কুরআনে সাধারণভাবে সুবিচারের কথা এবং বিশেষভাবে এতিমদের প্রতি সুবিচারের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। ওপরে সূরা নিসার ১২৭ নম্বর আয়াতে অসহায় শিশুদের কথা এতিমদের থেকে আলাদা করে উল্লেখ করা হয়েছে।

পথে পাওয়া বেওয়ারিশ শিশু ইসলামের নজরে নিষ্পাপ। তাদেরকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। ফিকাহর ভাষায় এসব পথে পাওয়া শিশুকে ‘লাকিত’ বলা হয়। এ সম্পর্কে হানাফি ফিকাহর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘হিদায়া’-তে রয়েছে ‘পথ থেকে বাচ্চা কুড়িয়ে নেয়া প্রশসংসনীয় কাজ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ফরজ। ফরজ তখন হয় যখন কুড়িয়ে না নিলে শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দেয়। মুসলিম দেশে এ ধরনের শিশু পাওয়া গেলে তাকে মুসলিম গণ্য করতে হবে’ (হিদায়া, লাকিত অধ্যায়)।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শিশুদের পালনের জন্য গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ। এ কাজকে আমাদের দেশে আরো উৎসাহিত করতে হবে। সরকারের পক্ষে সব শিশুর ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। কাজটি যথাযথভাবে করার জন্য পালক ও পালিতের স্বার্থ রক্ষা করে একটি আইন করা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ইসলামের একটি বিশেষ বিধানকে কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এটি হচ্ছে- শিশুর বংশপরিচয় যদি জানা না-ও থাকে তবুও তাকে পালকের ঔরসজাত সন্তান- এ কথা প্রচার করা যাবে না। সূরা আহযাবের ৪ নম্বর আয়াতে এ কথা সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে, পালক পুত্র কখনো ঔরসজাত পুত্র বলে গণ্য হবে না।

ঔরসজাত পুত্র না হওয়ার আইনগত তাৎপর্য রয়েছে। এর প্রথম তাৎপর্য হচ্ছে ঔরসজাত সন্তান যেভাবে স্বত্বই উত্তরাধিকার পেয়ে থাকে পালিত পুত্র/কন্যা সেভাবে উত্তরাধিকার পাবে না। সে জন্য পালক ব্যক্তিকে হয় জীবদ্দশায় হিবা করে সম্পত্তি দিতে হবে বা অসিয়ত করে যেতে হবে, যাতে পালকের মৃত্যুর পর সম্পত্তির অনধিক তিনের এক অংশ পেতে পারে। তেমনিভাবে এর অন্য তাৎপর্য হচ্ছে পালিত শিশু পালকের পুত্র-কন্যাকে বিবাহ করতে পারবে। ভাই-বোনের মধ্যে ইসলামে বিবাহ হতে পারে না। কিন্তু পালিত শিশু যেহেতু পিতার বংশের ভাই-বোন নয়, সেহেতু এই নিষেধাজ্ঞা তার বেলায় প্রযোজ্য হয় না।

কিন্তু ইসলামের এ বিধান ভঙ্গ না করেও শিশুদের অধিকার সংরক্ষেণের জন্য আইন প্রণয়ন করা খুবই সম্ভব। এই আইনে নিম্নোক্ত বিধান রাখা যেতে পারে!
ক. পালক পালিতের পূর্ণ ভরণপোষণের জন্য দায়ী থাকবে।
খ. পালক পালিতের ওপর কোনো মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন করতে পারবে না।
গ. পালক জীবদ্দশায় হিবা করে বা অসিয়তের মাধ্যমে পালিতের ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে যাবে।
ঘ. সরকারের এ ধরনের শিশুর স্বার্থ দেখার অধিকার থাকবে।
ঙ. নির্যাতনের ক্ষেত্রেও সরকার এসব শিশুকে পালকের অধিকার থেকে নিজ কর্তৃত্বে নিতে পারবে।
চ. পালক অসুস্থ ও অভাবগ্রস্ত হলে পালিত ব্যক্তি যদি সক্ষম হয় তবে পালকের ভরণপোষণ করতে বাধ্য থাকবে। এ আইনের নামকরণ করা যায়, ‘বাংলাদেশ শিশু গ্রহণ ও প্রতিপালন আইন’।

লেখক : সাবেক সচিব বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement