২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

হরিশের হাসি ও লাবণ্যের লজ্জা

-

সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচনী ডামাডোল শুরু হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না, এমন অভিযোগের মধ্যেই বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। অতীতের নির্বাচনগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করলেও এখন তা হয়ে উঠেছে আতঙ্কের অনুষঙ্গ। সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচনগুলো যে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের আত্মস্বীকৃতি ও আশাবাদ থেকে। তার ভাষায়- তারা (ইসি) বরিশাল, খুলনা ও গাজীপুর সিটির পুনরাবৃত্তি চান না। ফলে বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে, অতীতে জাতিকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারেনি তা স্পষ্ট।

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ৩০ জানুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ এবং সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হবে বলে জানানো হয়েছে ইসির পক্ষে। নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। তবে বিতর্কটা শুধুই যন্ত্রকেন্দ্রিক নয়, বরং যন্ত্রচালকদের নিয়েই অভিযোগটা জোরালো। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেকটা জোর করেই ইভিএম চালু করেছিল বর্তমান নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তা শুধু সরকার পক্ষ ছাড়া আর কোনো পক্ষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।

নির্বাচনে অনিয়ম বা কারচুপি শুধু বর্তমান কমিশনের সময়েই হয়েছে এমন নয়; বরং এর আগে কাজী রকীব কমিশন ঢাকার দুই ও চট্টগ্রামে নির্বাচনের নামে মহা-কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছিল। এই কমিশনই ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে দেশে ভোটারবিহীন নির্বাচনের আয়োজন করে বলে অভিযোগ রয়েছে। মূলত রকীব কমিশনের হাত ধরেই ভোট চুরির মহাযজ্ঞটা শুরু হয়েছিল বলে প্রবল জনশ্রুতি রয়েছে। বর্তমান কমিশন তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে মাত্র। রাজপথের বিরোধী দলগুলো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের বিরোধিতা করলেও ঢাকা দুই সিটি নির্বাচনের পুরো ভোটই গ্রহণ হবে যন্ত্রে; এমনটিই জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ রয়েছে, তারা সরকারি এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও নির্বাচনে ডিজিটাল কারচুপি করার জন্যই বিরোধীদের উদ্বেগ উপেক্ষা করেই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বলা হচ্ছে, ইভিএমে যথেষ্ট সুযোগ থাকবে ভোটের ফলাফলকে ম্যানিপুলেট করার। কিন্তু এতসব অভিযোগের পর ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে ‘ইভিএম’ ব্যবহারের সিদ্ধান্তে ইসি অটল রয়েছে।

আমাদের দেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে জনমতের প্রতিফলন ঘটছে না- এমন অভিযোগ শুধু দেশে নয়, বরং আন্তর্জাতিক মহলেও জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে বিরোধী প্রার্থীরা যেভাবে অভিযোগ করা শুরু করছেন, তাতে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সরকারি দলের লোকেরা বিরোধী প্রার্থীদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে এবং ইতোমধ্যেই একজন বিরোধী কমিশনার প্রার্থীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। আর আমাদের নিকট-অতীত স্মৃতি মোটেই সুখকর নয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গাজীপুরের নির্বাচন প্রসঙ্গ টানছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তো ‘মিডনাইট ইলেকশন’ হিসেবেই স্বীকৃতি পেয়েছে। যদিও নির্বাচনগুলোতে ভোট কারচুপি ও অনিয়ম সব নির্বাচন কমিশনই অস্বীকার করে এসেছে।

ইভিএম নিয়ে কমিশনের পক্ষে অনেক ইতিবাচক কথা হলেও বাস্তবতা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। যে দেশগুলোতে ইভিএম আবিষ্কৃত হয়েছে, সেসব বেশির ভাগ দেশই ‘ইভিএম’ তালাক দেয়া শুরু করেছে অনেক আগেই।

তার পরও শাসক দল ও নির্বাচন কমিশন ইভিএমের পক্ষে ওকালতি করছে। অবশ্য ইভিএম-পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক হতো না, যদি ডিজিটাল কারচুপির ভয় না থাকত।

গত ১২ ডিসেম্বরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনারের আশু অপসারণ ও নির্বাচন কমিশনকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর দাবি করেছে। এতে বলা হয়েছে, একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেভাবে একের পর এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিচ্ছে তা অভূতপূর্ব ও পুরো জাতির জন্য বিব্রতকর। আর বিরোধী দলের মতামত, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা উপেক্ষা করে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে অটল থেকে কমিশন তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে।

শামসুল হুদা কমিশন ২০১১ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২১ নম্বর ওয়ার্ডে ইভিএম ব্যবহার করলে ভোট গণনায় ত্রুটি ধরা পড়েছিল। বর্তমান কমিশন পুরনো ইভিএম পরিত্যক্ত ঘোষণা করে নতুন ইভিএমে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৪১ নম্বর কেন্দ্রে তা ব্যবহার করে। কিন্তু সেখানেও ত্রুটি দেখা দেয়। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণে ত্রুটির ফলে ভোটাররা ভোগান্তিতে পড়েন।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনগুলো নিয়ে সফটওয়্যার প্রোগ্রামাররা বলেছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনগুলো বিদ্বেষমূলক প্রোগ্রামিংয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং যেকোনো মুহূর্তে হ্যাকাররা মেশিনটিকে হ্যাক করে ভোট গণনাকে খুব সহজেই টেম্পারিং করতে পারে। যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে ব্যালট পেপারে ভোট গণনার সময়সাপেক্ষ হলেও ভোটারদের ওপর পরিপূর্ণ আস্থা আছে। কারণ উচ্চ প্রযুক্তি সর্বদাই হ্যাকারদের আক্রমণে ভেদ্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

জার্মানি, আমেরিকা, ভারতসহ অনেক দেশে ইভিএম মেশিন নিয়ে বিতর্ক হওয়ায় এই মেশিন ব্যবহার বন্ধ; আবার কোথাও সংস্কার করা হয়েছে। আমেরিকার অনেক স্টেট ইভিএমের ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। আবার কিছু স্টেটে ইভিএমের পাশাপাশি ম্যানুয়াল পদ্ধতিও চালু আছে। জার্মান আদালত ২০০৯ সালে এক রায়ে ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনগুলোতে কিভাবে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট কারসাজি হয়েছে, তার সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে গণমাধ্যমে।

আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, স্যান দিয়াগো, মিশিগান ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় ‘রিটার্ন ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং’ ব্যবহার করে ইভিএমের অপব্যবহার করার বাস্তবতা প্রমাণ করেছে। তারা দেখিয়েছে কিভাবে একটা ‘ভাইরাস’ ব্যবহারের মাধ্যমে ইভিএম মেশিনে হ্যাকাররা ভোটের ফলাফল সহজেই ‘ম্যানিপুলেট’ করতে পারে।

২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডে ভোটগ্রহণের মাধ্যমে ইভিএমের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৫ জুন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণের সময় ইভিএম বন্ধ হয়ে যায়। ২০১২ সালে যখন ইভিএম ব্যবহারের কথা উঠেছিল তখনো রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধিতা করেছিল। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য মতে, ইভিএম দিয়ে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেয়া যেমন সম্ভব, ঠিক তেমনিভাবে এক টিপে ৫০টি ভোট দেয়ার সুযোগও রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিদেশের মাটিতে বসেও ইভিএম হ্যাকিং করা যায় এবং একটি ইভিএম হ্যাকি করতে এক মিনিটের বেশি সময় লাগে না। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ইভিএমের চেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা বেশি জরুরি। কিন্তু এ বিষয়ে ইসিকে মোটেই ইতিবাচক মনে হচ্ছে না। অতীতের নির্বাচনগুলোতে সরকারি দলের মহড়ার কারণে বিরোধী দলের প্রার্থী এজেন্টরা কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। এ অবস্থা এবারো বিদ্যমান থাকলে ইভিএমের জটিলতা আরো বাড়বে। ক্ষমতাসীন দলের অতি উৎসাহী মাসলম্যানরা বিরোধী প্রার্থীর ভোটারদের ইভিএমের বাটনে হাত দিতে দেবে না, বলবে আপনার কষ্ট করার দরকার নেই, আমরাই বাটন চেপে ভোট দিয়ে দিচ্ছি।

আমাদের নির্বাচন কমিশনগুলো ব্যর্থতার অশুভ বৃত্ত থেকে কোনোভাবেই বেরিয়ে আসার চেষ্টা তো করছেই না, এ নিয়ে কমিশনের অনুতাপ-অনুশোচনাও নেই। বিষয়টি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘সতী’ গল্পের ‘হরিশ ও লাবণ্য’ চরিত্রে সার্থকভাবেই উপস্থাপন করেছেন।

হরিশ সমবেদনায় মুখ পাংশু করিয়া প্রশ্ন করিল, আপনি ফেল করলেন যে বড়?

লাবণ্য কহিল, এটুকুও পারবো না, আমি এতই অক্ষম?

হরিশ হাসিয়া ফেলিল, বলিল, যা হবার হয়েছে, এবার কিন্তু খুব ভালো করে এক্সামিন দেয়া চাই।

লাবণ্য কিছু লজ্জা পাইল না, বলিল, খুব ভালো করে দিলেও আমি ফেল হবো। ও আমি পারব না।

মূলত হরিশের হাসি আর লাবণ্যের লজ্জাহীনতায় একটা বাস্তবতা রয়েছে। লাবণ্য অবলীলায় স্বীকার করে নিয়েছে অপারগতা। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন বাস্তবতাকেও স্বীকার করছে না বরং ব্যর্থতাকেই সাফল্য হিসেবে বারবার দাবি করছে। হরিশের হাসি, লাবণ্যের লজ্জা ও নির্বাচন কমিশনের উপলব্ধির মধ্যে তফাতটা তো এখানেই।

smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
সিলেটে অস্ত্র ও মাদকসহ নারী গ্রেফতার শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে : শাহজাহান কপ-২৯ : ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে ২০০ মিলিয়ন বরাদ্দ দিতে ইইউ’র সমর্থন চাইল বাংলাদেশ আইসিসির পরোয়ানা : গ্রেফতার হবেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী? ছাত্র জমিয়তের ময়মনসিংহ জেলা কমিটি গঠন সবার আগে নির্বাচনী সংস্কার দরকার : এ্যানি হাসিনার নেয়া প্রতিটি রক্তের ফোটার বিচার হবে : ইসহাক খন্দকার ডেঙ্গুতে আরো ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৪৫৮ রেলওয়ে কারখানাকে আধুনিকায়ন করে জনবল নিয়োগ দেয়া হবে : রেল উপদেষ্টা বর্ণিল আয়োজনে বশেমুরকৃবির ২৭তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালিত জামায়াত কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয় : গোলাম পরোয়ার

সকল