সামাজিক সমস্যা ও আমাদের দায়িত্ব
- শাহ্ আব্দুল হান্নান
- ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ২০:৩৫
সাধারণত ধারণা করা হয়, মানবজীবনে অর্থনৈতিক সমস্যাই প্রধান সমস্যা। এটা ঠিক যে, অর্থনৈতিক সমস্যা জীবনে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা; কিন্তু সামাজিক সমস্যাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সামাজিক সমস্যা থেকে উদ্ভূত, যৌতুক প্রথার কারণে আমাদের দেশে ৯০ শতাংশ পরিবার মেয়েদের বিয়ে দিতে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, সামাজিক সমস্যা কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য সমস্যা একই সাথে বিবেচনা ও মোকাবেলা করতে হবে।
প্রথমত, আমাদের একটি বড় সামাজিক সমস্যা হচ্ছে- অশিক্ষা ও নিরক্ষরতা। আমাদের সমাজে শিক্ষার নিম্নহার সম্পর্কে সবাই অবগত। হাদিসে আছে, ‘প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর জ্ঞানার্জন করা ফরজ’ (ইবনে মাজাহ)।
কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলিম সমাজে ব্যাপক অশিক্ষা বিরাজ করছে। এ জন্য আমাদের কর্তব্য মসজিদভিত্তিক শিক্ষার প্রোগ্রাম গ্রহণ করা। কুরআন শরিফ চর্চার সাথে সাথে বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিদ্যা সবাইকে শিখতে হবে। মহিলাদের শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ওপরে হাদিস উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে পুরুষ ও মহিলাদের শিক্ষার মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। আমরাই বরং নারী-পুরুষের পার্থক্য করেছি। আল্লাহর রাসূল সা: পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপারে কোনো পার্থক্য করেননি। ইমাম সাহেবদের উদ্যোগে এ শিক্ষার ব্যবস্থা মসজিদে অথবা মসজিদের সাথে ঘর করে অথবা বারান্দায়ও করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা উঠতে পারে, মেয়েদের মসজিদে আসার অধিকার আছে কি? রাসূলুল্লাহ সা:-এর যুগে মহিলারা মসজিদে নামাজে শরিক হতেন (বুখারি শরিফ, হাদিস নং ৮১৬, ৮১৯, ৮২৪)। তাই প্রয়োজনে মসজিদে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা যাবে।
দ্বিতীয়ত, হত্যা, চুরি, ব্যভিচার, দাঙ্গা, ফ্যাসাদ এবং অন্যান্য ধরনের অপরাধ আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অনেকে মনে করেন, অপরাধের মূল কারণ দারিদ্র্য। আসলে অপরাধের মূল কারণ দারিদ্র্য কি না, তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। সমাজে হরহামেশা যেসব ধর্ষণ হচ্ছে, তা কি দারিদ্র্যের কারণে? অবশ্যই নয়। এ কথা নিঃসন্দেহে সত্য, অনেক অপরাধ দারিদ্র্যের কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে; কিন্তু সব অপরাধের কারণ দারিদ্র্য, আমরা তা মেনে নিতে পারি না। অপরাধের কারণগুলোর মধ্যে সুশিক্ষা ও নৈতিকতার অভাব এবং অশ্লীলতার ব্যাপক বিস্তার এসবও রয়েছে।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজে হত্যার পরিমাণ যে হারে বেড়ে যাচ্ছে, তাতে চিন্তিত না হয়ে পারা যায় না। ব্যাপক হত্যার এরূপ প্রবণতা থেকে মনে হচ্ছে, যেন জীবনের কোনো মূল্য নেই। জীবনের যে কী বিরাট মূল্য তা আল কুরআনের সূরা মায়েদা থেকে বোঝা যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘যদি কেউ খুনের পরিবর্তে কিংবা জমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে কাউকে হত্যা করে, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যদি কেউ কাউকে জীবন দান করে, তবে সে যেন সব মানুষকে জীবন দান করল’ (সূরা মায়েদা-৫:৩২)।
বিদায় হজে দেয়া নবী করিম সা:-এর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা আমরা ভুলে গেছি যে, ‘আজকের এই দিনের মতো তোমাদের জীবন, তোমাদের মান এবং তোমাদের ইজ্জত সংরক্ষিত। এই হাদিস, ইতিহাসের এই ঘটনা এবং কুরআন মাজিদের উপরোল্লিখিত আয়াতের ভিত্তিতে মসজিদের ইমাম সাহেবদের খুতবা দেয়া উচিত, যাতে অপরাধের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হয়। দারিদ্র্য ছাড়া অন্য যেসব কারণে মানুষের চরিত্র খারাপ হচ্ছে, সেসব পাপকাজ ও অশ্লীল সাহিত্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে হবে।
তৃতীয়ত, নারী নির্যাতন। পত্রপত্রিকার পাতা খুললে প্রতিদিন অন্তত পাঁচ-সাতটি নারী নির্যাতনের খবর চোখে পড়ে। দেশের সামগ্রিক চিত্রের একটি অংশ মাত্র। কেননা, নারী নির্যাতনের সব খবর তো পত্রিকায় আসে না। মেয়েদের ওপর আজ বিভিন্ন রকম অত্যাচার-নির্যাতন চলছে। তাদের কথায় কথায় তালাক দেয়া হচ্ছে, খোরপোষ দেয়া হচ্ছে না, সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাদের ওপর চালানো হচ্ছে যৌতুকের জন্য অত্যাচার।
মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার প্রসঙ্গে বলা যায়, কুরআনের সূরা নিসার যে আয়াতের বলে পুরুষরা সম্পত্তির অধিকার পায়, মেয়েরাও একই আয়াতের বলে সম্পত্তির অধিকার পায়। অথচ আমরা মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি। আমরা আয়াতের একটি অংশের ওপর আমল করছি; কিন্তু অন্য অংশের ওপর করছি না। এতে কুরআনের নাফরমানি করা হচ্ছে।
অন্য দিকে, মেয়েরা সম্পত্তির অধিকার না পাওয়াতেই তালাককে এত বেশি ভয় পায়। তারা জানে, তাদের কোনো আশ্রয় নেই। এর ফলে অনেক মেয়েকেই শেষ পর্যন্ত রাস্তায় আশ্রয় নিতে হয় এবং ব্যভিচারের শিকার হতে হয়। কেউ কেউ মনে করেন, সব সময় স্বামীদের আনুগত্য করতে হবে; কিন্তু ইসলামের সর্বাবস্থায় আনুগত্য নেই।
চতুর্থত, দারিদ্র্য ও ছিন্নমূলদের সমস্যা। নানা কারণে স্থানীয়ভাবে কোনো দুর্ভিক্ষ হলে অথবা নদীভাঙনের ফলে বহু লোক বিপন্ন হয়ে যায় এবং শহরের দিকে পাড়ি জমায়। এ বিষয়টির দিকে গুরুত্বসহকারে মনোযোগ দিতে হবে। সমবায় বা অন্যান্য পদ্ধতিতে কী করে এদের গ্রামে ধরে রাখা যায়, গ্রামেই পুনর্বাসিত করা যায়, এ জন্য নেতাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমাদের গ্রামাঞ্চলে একদল লোক আছে, যারা এসব বিপন্ন লোকের শেষ সম্বল একটি ঘর বা এককাঠা জমি হস্তগত করার জন্য, ঠেকায় ফেলে কিনে নেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এ ধরনের মানসিকতার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে হবে। কমপক্ষে মেয়েদের যেন শিশুসহ শহরের দিকে না আসতে হয়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা, রাস্তায় থাকলে একটা মেয়র যে বিপদ ঘটে, তা একটি পুরুষের হয় না। একসময় সব দরিদ্র ও বেকারের জন্য বেকার ভাতা চালু করতে হবে।
পঞ্চমত, আমাদের দেশে বখাটে ছেলেদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এদের যেভাবে হোক, বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে, এদের দূরে রাখলে চলবে না। এদের সাথে মিশে সৎ পথ দেখাতে হবে। সিনেমা ও অশ্লীল সাহিত্য কিশোর ও তরুণদের খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ। বখাটে ছেলেরা স্কুলগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। এর বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে হবে। মেয়েদেরও ইসলাম মোতাবেক চলাফেরা করতে বলতে হবে। পবিত্র কুরআনে বাইরে যাওয়ার সময় চাদর পরার জন্য মহিলাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ বলেন, ‘নবী! আপনার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও ঈমানদার লোকদের, মহিলাদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের ওপর নিজেদের চাদরের আঁচল ঝুলিয়ে দেয়। এটা অধিক উত্তম নিয়ম ও রীতি, যেন তাদের চিনতে পারা যায় ও তাদের উত্ত্যক্ত করা না হয়। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (সূরা আহযাব-৩৩:৫৯)।
মেয়েদের বাইরে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ নিশ্চয়ই মেয়েদের প্রয়োজন পূরণের জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন’ (বুখারি ও মুসলিম)।
বাংলাদেশের এসব সামাজিক সমস্যাকে যথাযোগ্যভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। সবাইকে বিশেষ করে গ্রামের ইমাম, স্থানীয় নেতা, আদর্শবাদী যুবক ও সৎ জনতাকে এসব সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা