ঘৃণা শান্তি রাষ্ট্র ও উন্নয়ন
- প্রফেসর ড. এম এ মান্নান
- ২০ ডিসেম্বর ২০১৯, ২০:২৭
ধর্ম নিয়ে পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। ক্রুসেড হয়েছে। খ্রিষ্টানরা ক্রসেড শুরু করেছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে। আবার প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। ইসলাম ধমাবলম্বীদের মধ্যেও যুদ্ধ দেখা গেছে। ধর্মীয় বিধানের ব্যাখ্যা নিয়ে এই যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ভারতে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেয়ার আইনকে কেন্দ্র করে যে সঙ্ঘাত দেখা দিয়েছে তা মূলত এসেছে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা থেকে। গত এক শতাব্দী ধরে বিশ্বে যত বড় বড় সঙ্ঘাত হয়েছে তার মূলে আছে এই জাতিরাষ্ট্রের ধারণা। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে এই ধারণাকে কেন্দ্র করে। জাতিরাষ্ট্রের ধারণা হলো এটা আমাদের এলাকা, তুমি আমাদের জাতির নও, তাই তুমি এখানে থাকতে পারবে না। অথচ পৃথিবীর সব এলাকাই একসময় ছিল মানুষের, কোনো জাতিগোষ্ঠীর নয়। আমরা এখন আমাদের সম্পর্কের এই মৌলিক ভিত্তিটিই ভুলে বসে আছি। সভ্যতা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, আমরা যদি নিজেদের চরম অসভ্য বলি সেটাও ভুল বলা হবে না।
শিক্ষা ও কৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। শিক্ষা অর্জন করা যায়। কিন্তু কৃষ্টি হলো অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ। বহু বছর ধরে লালিত মূল্যবোধগুলো জমা হতে হতে কৃষ্টির জন্ম হয়। আমাদের চার পাশে এমন উদাহরণ বিরল নয়, যেখানে দেখা যাবে বিদ্যা অর্জন করে একজন পিএইচডি অর্জন করেছে কিন্তু কিভাবে রুচিসম্মতভাবে খাবার গ্রহণ করতে হয় সেই নিয়মই হয়তো সে জানে না। এটাই হলো কৃষ্টি। সেই মানবসভ্যতার গোড়াপত্তনের সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে এই কৃষ্টি তৈরি হয়েছে। সভ্যতার লিখিত ইতিহাসের দিকে নজর দিলে আমরা দেখব একসময় ছিল শিকারি সমাজ। তারপরে ধারাবাহিকভাবে প্রাক-কৃষি সমাজ, কৃষি সমাজ, শিল্প সমাজ ইত্যাদি এসেছে। সামাজিক পরিবর্তনের গতিশীলতা বোঝার জন্য এই শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে। আর ধারণার পরিবর্তন এভাবেই ঘটে। এভাবে সময়ের বিবর্তনে জাতিরাষ্ট্রের ধারণাও হাজির হয়েছিল। কিন্তু একবিংশ শতকে এসে এর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে বলে আমি মনে করি। এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে।
মানবরচিত সব আইনই পরিবর্তনশীল। গ্রিক সভ্যতার যুগে অলিম্পিক গেমসের যে আইন ছিল এখন সেগুলো আর নেই। বলতে গেলে পুরোটাই বদলে গেছে। আমরা ইংরেজি ভাষার কথা বিবেচনা করলে দেখব আজ শেক্সপিয়র থাকলে তাকে সবচেয়ে অজ্ঞ লোক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তখন ‘ডিজঅনেস্টি’ শব্দ ব্যবহার করা হতো ‘অনেস্টি’ হিসেবে। এভাবে সব কিছুর বিবর্তন হয়। জাতিরাষ্ট্র ধারণা ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের একটি চূড়ান্ত রূপ। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয় শক্তিগুলো যখন বিশ্বের বিভিন্ন অংশকে শাসন করছিল তখনই এই ধারণা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। দুঃখজনক হলো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো ভেঙে যাওয়ার পর তারা আবার উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করেছে, অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিকে যাচ্ছে। ফলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জন্ম হয়েছে। নতুন মুদ্রা ইউরো জন্ম নিয়েছে। ইসলাম কখনও জাতিরাষ্ট্রের কথা বলেনি, উম্মাহর কথা বলেছে। আজ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সমর্থনে আফ্রিকার ছোট্ট একটি দেশ গাম্বিয়ার এগিয়ে আসা মুসলিম উম্মাহর চেতনা থেকে। তারা যদি জাতিরাষ্ট্রের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতো তাহলে এমনটা হতো না।
আইডিবির বৈঠক উপলক্ষে একবার আমার গাম্বিয়া যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। খুবই সুন্দর একটি দেশ। মেইনল্যান্ড আফ্রিকার সবচেয়ে ছোট দেশ। নদীসমৃদ্ধ উর্বর একটি দেশ। এর তিন দিক ঘিরে আছে সেনেগাল। গাম্বিয়াকে দখল করা নিয়ে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর মধ্যে অনেক হানাহানি হয়েছে। বিখ্যাত গাম্বিয়া নদী প্রবাহিত হয়েছে দেশটির মধ্য দিয়ে। এই নদীর সাথে আফ্রিকার দাস ব্যবসায়ের ইতিহাস জড়িত। নদীটি আটলান্টিকে গিয়ে পড়েছে এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস ধরে নিয়ে গাম্বিয়া নদীপথে ভিন্ন দেশে পাচার করত। প্রথমে পর্তুগিজরা এই ভূখণ্ড দখল করে। পরে তাদের হটিয়ে দেয় ব্রিটিশরা এবং সেনেগাম্বিয়া নামে একটি প্রদেশ হিসেবে শাসন করে। ব্রিটেনের কাছ থেকে গাম্বিয়া স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৬৫ সালে। দেশটির জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ মুসলমান এবং ইসলামের সুন্নি মতাদর্শের অনুসারী। এরই প্রেক্ষাপটে বলতে হচ্ছে আজ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে যা হচ্ছে তা কারো জন্যই শুভ বার্তা নিয়ে আসবে না। নির্দিষ্ট তিনটি দেশ থেকে হিন্দুদের এনে জড়ো করার এই ধারণা ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও শুভ কিছু নয়।
১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয় তখন এর প্রতিষ্ঠাতা নেতারা এই বিশাল ভূখণ্ডের বৈচিত্র্যময় চরিত্রটি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। এখানে বহু জাতিগোষ্ঠীর বাস। ভারতের জনমিতিক এই বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ রেখেই মুসলিম শাসকরা প্রায় ৮০০ বছর ভূখণ্ডটি শাসন করেছেন। মুসলিম শাসকরা ধর্মের ভিত্তিতে দেশ শাসন করতে চাইলে আজ ভারতে অন্য কোনো ধর্মের মানুষ থাকত কিনা সন্দেহ রয়েছে। ‘সেকুলার ভারতে’ সেই রূপটিই ধরে রাখতে চেয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা। আজ ভারতের প্রতিষ্ঠাকালীন রূপটিই বদলে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যা দেশটি চিরন্তন বৈশিষ্ট্যের সাথে একেবারেই বেমানান। বর্তমান ভারতীয় নেতাদের এই প্রচেষ্টা আশপাশের দেশগুলো, বিশেষভাবে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে। ভাষাগত হিসেবে বাঙালি এবং ধর্মীয় হিসেবে মুসলমান- দুই দিক দিয়েই বাংলাদেশকে প্রভাবিত করবে ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন ও জাতীয় নাগরিক তালিকা।
জাতিরাষ্ট্রের ধারণার কারণেই আজ আমরা ভাগ করে দিচ্ছি- এই জায়গায় এরা থাকবে, কিন্তু ওরা থাকতে পারবে না। কিন্তু মানচিত্র তো পরিবর্তনশীল। মাত্র ৮০ বছর আগেও ভারত উপমহাদেশের মানচিত্র আজকের মতো ছিল না। ভবিষ্যতে যে এ রকম থাকবে তারইবা নিশ্চয়তা কে দেবে। ভারত উপমহাদেশ নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই অঞ্চল অনেক দেশের সমাহারের বিষয়টি। মুসলমান শাসকরা প্রথম এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে একক শাসনাধীনে আনার প্রচেষ্টা চালান। তখনও কোনো শাসক গোষ্ঠী একাধারে শাসন করতে পারেনি। মূল কথা হলো আজকে সারা বিশ্বে যে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তার মূল কারণ হলো জাতিরাষ্ট্র। অর্থাৎ বিদ্যমান আইন দিয়ে আর চলছে না।
জাতিরাষ্ট্রের ধারণার অনেক দেশে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করলেও ভারতের মতো ব্যাপক আকারে হয়নি। এর কারণ হলো ভারতের মতো এত বিপুল জাতিগোষ্ঠীর বাস আর কোনো দেশে নেই। ভারতে যত মুসলমান রয়েছে আর কোনো দেশে তা নেই। মুসলিম জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র হলো ভারত। ফলে ভারতের এই আচরণের ঢেউ শুধু পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা আফগানিস্তানে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই বিপুল মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে বৈষম্য করার মানে হলো বিশ্বের ১৯০ কোটি মানুষের সাথে বৈষম্য করা। ওআইসির ৫৭টি সদস্যরাষ্ট্রের গায়ে এই বৈষম্যের আঁচ লাগবে। সে কারণেই রোহিঙ্গা-সঙ্কট গাম্বিয়াকেও আঘাত করেছে। ভারতের এই সঙ্কট আরো অনেক গাম্বিয়া তৈরি করবে। ফলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া ভারতের জন্য কঠিন হবে।
তা ছাড়া ঘৃণার ওপর ভিত্তি করে শান্তি প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা কখনো টেকসই উন্নয়ন করা যায় না। ঘৃণার ওপর ভিত্তি করেই তো বিশ্বযুদ্ধগুলো হয়েছে। আরো অনেক যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু যারা এসব যুদ্ধ ডেকে এনেছিলেন তারা কেউ টিকতে পারেননি। তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তা ছাড়া আমি আগেও এই পত্রিকার কলামে লিখেছি যে হিন্দুবাদ কোনো মতবাদ বা ডকট্রিন নয়। এ থেকে দৈনন্দিন বা অর্থনৈতিক জীবনের কোনো দর্শন বা দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় না। মানবসমাজকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায় : সনাতন, বাজার, নিয়ন্ত্রিত ও ইসলামী ব্যবস্থা। এর কোনোটির সাথেই হিন্দুবাদের সংযোগ নেই। ধর্ম হিসেবে শুধু ইসলামেই একটি রাষ্ট্র কিভাবে চলবে, তার অর্থব্যবস্থা কিভাবে পরিচালিত হবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ‘ডিভাইন রিলিজিয়ন’ হিসেবে খ্রিষ্টবাদেও কিছুটা পাওয়া যায়। রাষ্ট্রে ইসলামের ভূমিকা অ্যাকটিভ, আর খ্রিষ্টবাদের ভূমিকা প্যাসিভ। ইসলাম প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রকে বলছে এভাবে পরিচালিত হতে হবে। আর খ্রিষ্টবাদে পরোক্ষভাবে নির্দেশনা দিচ্ছে। সে কারণেই অনেক খ্রিষ্টপ্রধান রাষ্ট্রের সংবিধান বা মুদ্রায় ঈশ্বরের ওপর আস্থা স্থাপনের কথা বলা আছে। কিন্তু হিন্দুবাদ দিয়ে কোনো রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না। কারণ তার ডকট্রিনের মধ্যেই এটা নেই। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী পৃথিবীর জীবন হলো মায়া বা ইল্যুশন। কিন্তু ইসলামের মৌলিক দর্শন হলো পৃথিবীর জীবন যেমন বাস্তব, তেমনি মৃত্যুর পরের জীবনও বাস্তব। এখানে কিন্তু জাতিরাষ্ট্র নেই। এটা হয়তো আজ আমরা ধরতে পারছি না।
প্রত্যেক সম্প্রদায় তার সামাজিক প্রথা-রীতিগুলো পালন করতে পারে, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু মানুষে মানুষে সম্পর্কের মৌলিক বিষয়টি আমরা আজ ভুলে যাচ্ছি। কেউ শক্তিশালী হলেই সে দুর্বলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এটা রোধ করার উপায় নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আমরা যদি অস্ত্রের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ না করে ‘কমনওয়েলথ অব হিউম্যান কমিউনিটিজ’ (সাধারণ মানুষের সমাজ সঙ্ঘ) গঠনের পেছনে অর্থ ব্যয় করতে পারতাম তাহলে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতো। আমরা মানুষের মৌলিক প্রয়োজনগুলো পূরণ করতে পারছি না কিন্তু অস্ত্র কিনতে অকাতরে অর্থ ব্যয় করছি। কে কত দক্ষ হন্তারক হতে পারি সে জন্য আমরা প্রতিযোগিতা করছি। কিছু ক্ষমতালোভী মানুষের অহংবোধের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ মানুষের শান্তির জন্যই ‘কমনওয়েলথ অব হিউম্যান কমিউনিটিজ’ গঠন করা জরুরি।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা