মোদি সরকারের ঘৃণার অর্থনীতি
- প্রফেসর ড. এম এ মান্নান
- ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ২০:৩৭
অর্থনীতি খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সাথে অর্থনীতি জড়িত। শুধু পড়ালেখা করে অর্থনীতিবিদ হওয়া যায় না, অর্থনীতির সাধারণ বোধবুদ্ধি বা কমন সেন্স থাকতে হয়। অর্থনীতি হলো সাধারণ বোধবুদ্ধির নির্যাস (economy is the essence of common sense)। তুমি বিনিয়োগ করবে; কিন্তু যখন তুমি দেখছ যে, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে তখন তুমি তা করতে ভয় পাবে। শুধু ভারত নয়, সব দেশের জন্যই ‘জেনারেল রুল অব থাম্ব’ সমানভাবে প্রযোজ্য। ফলে কোনো অসুস্থ পরিবেশে কেউ সুস্থভাবে বিনিয়োগ করতে চাইবে না। কারণ, সে তার বিনিয়োগ থেকে মুনাফা চাইবে। যখন দিব্যদৃষ্টিতে নিজের লোকসান দেখতে পাবে, তখন সে বিনিয়োগ করবে না। এরই প্রেক্ষাপটে আমরা যদি ভারতের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, সেখানে একটি ভীতিকর আর্থ-সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ২১ কোটি মানুষের মনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সেখানে মুসলমানদের মধ্যেও বিলিয়নিয়ার রয়েছে। শিল্পপতি, বিনিয়োগকারী রয়েছে। ভারতীয় সব মুসলমানকে খুবই গরিব ভাবার কারণ নেই। ভারতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী বা ১০ দশমিক ৯ শতাংশ মুসলমানের বাস। দেশটির বর্তমান শাসনামলে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে ভারতে যারা এখন ক্ষমতায় আছেন তারা ঘৃণার রাজনীতি চর্চা করছেন। ঘৃণার এই রাজনীতি সস্তা স্লোগান হতে পারে। এটা করে কিছুদূর হাঁটা যাবে, কিন্তু বেশিদূর যাওয়া যাবে না। এখন দেশটির অর্থনীতিতে যে ধীর অবস্থা তৈরি হয়েছে এটা তারই ইঙ্গিত। পরিস্থিতি গণবিস্ফোরণের জায়গায় চলে যেতে পারে। ক্যারিশমা দিয়ে মানুষকে স্বল্প সময়ের জন্য প্রভাবিত করা যায়, কিন্তু দীর্ঘকাল বোকা বানিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু মৌলিক কোন পরিবর্তন আনার জন্য অর্থনৈতিক জ্ঞান থাকতে হবে।
দুঃখজনক হলো মোদি সরকারের নীতিতে সেই মৌলিক জ্ঞানের অভাব দেখা যাচ্ছে। ভারত ১২০ কোটি মানুষের একটি দেশ, যাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র বলা হয়। পশ্চিমা সমাজ ভারতকে গুরুত্ব দিচ্ছে এটি বড় বাজার হওয়ার কারণে। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারাও ভীত হয়ে পড়ছে বলে আমার মনে হয়। তারা হয়তো পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়া বা স্থবির হওয়ার পেছনে মনস্তত্ত্বও কাজ করে। কেউ নির্বাচিত হলে যেমন শেয়ারের দাম বেড়ে যায়, আবার কেউ নির্বাচিত হলে দাম পড়ে যায়। ভারতে এটাই হচ্ছে। যখন বিনিয়োগকারীরা দেখছে, এই সরকার বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারছে না তখন তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির সরকার বরং ২১ কোটি মানুষের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধক শক্তি তৈরি করেছে। পাশাপাশি বাইরের শক্তিগুলো অপেক্ষায় আছে বিনিয়োগ করা ঠিক হবে কি না তা বোঝার জন্য।
কাশ্মিরের দিকে তাকাই। সেখানে ৮০ লাখ মানুষকে একটি উন্মুক্ত কারাগারের মতো অবস্থা রাখা হয়েছে। তাদের দমিয়ে রাখার জন্য নিরাপত্তাবাহিনীর আট লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এসব অনুৎপাদনশীল খাতে সরকারকে বিপুল ব্যয় করতে হচ্ছে। কাশ্মিরের জনগণকে এই অবস্থায় রাখার পেছনে ‘রাজনৈতিক ইগো’ ছাড়া আর কোনো কারণ ছিল না। কিছু দিন আগে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) তৈরির পেছনে যে বিপুল ব্যয় করা হয়েছে, তা-ও অনুৎপাদনশীল খাতে। সারা দেশে এনআরসি করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এতে যে বিপুল ব্যয় হবে তার রীতিমতো আতঙ্কজনক। কিছু দিন আগে খবর প্রকাশিত হয়েছে, অর্থ সঙ্কটের কারণে ভারতের সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সেও রেশন, ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদন না থাকলে হাইপার ইনফ্লেশন সৃষ্টি হবে। ভারতের জন্য এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। কারণ বিশাল দেশ ও জনসংখ্যার আধিক্য হওয়ায় তার এক শতাংশ বা আধা শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া মানে বিশাল ক্ষতি।
পাশাপাশি এর জন্য নেতিবাচক সামাজিক মূল্যও দিতে হবে। সমাজের প্রতিটি মানুষকে এর ধকল পোহাতে হবে। তখন ভারতের অর্থনীতি আরো ধীর হয়ে পড়বে স্বাভাবিকভাবেই। এটা অর্থনীতির স্বাভাবিক দৃশ্যপট। এটা হলো সোস্যাল সাইকোলজি অব দ্য ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্পের সামাজিক মনোবিজ্ঞান। অর্থনীতি কিন্তু মানুষের মনোগত বিষয়গুলো নিয়ে কারবার করে।
অবশ্য এখানে অর্থনীতি ধীর হয়ে পড়ার বিষয়টি যেভাবে হিসাব করা হচ্ছে বা জিএনপি হিসাব করার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা অর্থনীতির পশ্চিমা মডেল অনুসরণ করছি। ভারতের অর্থনীতি আরো করুণ অবস্থায় পড়তে পারত। সেটা না হওয়ার কারণ হলো এই অঞ্চলের পারিবারিক ব্যবস্থা, যা দেশটির বেকারত্বের প্রকৃত চিত্রকে লুকিয়ে রেখেছে। পশ্চিমা অর্থনীতি আত্মস্বার্থের চিন্তা করে, আত্মস্বার্থ এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায়। তারা যেন ‘বাবা-মায়ের হাড়’ দিয়েও ব্যবসা করতে চায়। আমেরিকাতে মারা যাওয়াও বেশ গুরুতর ব্যাপার। সেখানে কেউ মারা গেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পেছনে বেশ কয়েক হাজার ডলার ব্যয় করতে হয়। এই খরচটিও জিএনপির হিসাবে চলে আসে। আমাদের সমাজে কিন্তু বিষয়টি সেরকম নয়। এখানে কেউ মারা গেলে দেখা যাবে, প্রতিবেশীরা তার দাফন-কাফনের ভার নেন। মৃত ব্যক্তির পরিবারের তেমন কোনো আর্থিক ব্যয় ছাড়াই দাফনের কাজ হয়ে যায়। বড়জোর একটি দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আমাদের জিএনপির হিসাবে এটা আসে না। এমন আরো অনেক কিছুই আমাদের জিএনপির হিসাবে আসে না। আমাদের বহু বেকার ভাইবোন রয়েছে, তাদের আমরা সুরক্ষা দিয়ে রাখছি। সেগুলোরও কোনো হিসাব নেই।
এখানে এমন আরো অনেক বিষয় আছে, যা ‘বাজার অর্থনীতি’র তত্ত্বের সাথে মেলে না। আমাদের সমাজে অতিথিদের সমাদর করা হয়, আপ্যায়ন করা হয়; কিন্তু এর জন্য কোনো বিনিময় নেয়া হয় না। এ দেশের গ্রামে অপরিচিত কারো বাড়িতে গেলেও গাছ থেকে ডাব পেড়ে খাওয়ানো হয়। গ্রামের মানুষ দল বেঁধে কারো জমির ফসল তুলে দিচ্ছে। এরকম আরো অনেক উপায়ে পরস্পরকে সাহায্য করছে। এই যে শ্রমদান বা আরো অনেক কিছু, সেগুলোর তো আর্থিক মূল্য রয়েছে। অথচ এই মূল্য আর্থিক হিসাবে আসছে না। এসব হিসাব জিএনপিতে যুক্ত হলে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ পশ্চিমাদের চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ হতে পারত।
জিএনপি হলো গ্রস ন্যাশনাল প্রডাক্ট। অর্থাৎ যা উৎপাদন হচ্ছে তাকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ দাও। এই হিসাব কিন্তু একান্তভাবেই বিভ্রান্তিকর। তৃতীয় বিশ্বের সামজের কিন্তু এখনো বেকারত্বকে আত্মীভূত করার সামর্থ্য রয়েছে। আমাদের অর্থনীতিতে প্রকৃত বেকারত্ব ২০-২৫ শতাংশের কম হবে না। এটা যদি পশ্চিমা অর্থনীতি হতো তাহলে অনেক আগেই অর্থনীতি ধসে পড়ত। তাই ভারতে সাংঘাতিক কিছু ঘটার জন্য আমি জিএনপি কমে যাওয়াকে দায়ী করব না। পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে নন-জিডিপি বা সোস্যাল ফ্যাক্টরগুলোর কারণে। দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব ফেলবে মনোগত বিষয়গুলো, যা বিনিয়োগের পরিবেশকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এটাই বড় রোগের লক্ষণ। বিনিয়োগ না হলে, গণঅসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকলে তখন সিস্টেমই ভেঙে পড়বে। আর ভারত সে পথেই এগিয়ে চলেছে।
অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ফ্যাক্টরগুলোর পাশাপাশি মোদি সরকারের ভ্রান্ত ঘৃণার অর্থনীতি পরিস্থিতিকে সে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাতে ভারত সরকার যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে তা উপমহাদেশের অন্যা দেশগুলোকেও প্রভাবিত করবে। পেঁয়াজের বিষয়টিকেই আমরা দেখি না কেন। বিনিয়োগ না হলে বেকারত্ব বাড়তে থাকবে। কত সময় পর্যন্ত এটা আত্মীভূত করা যাবে তারও একটি সীমা রয়েছে। কারণ, ভারতীয় অর্থনীতি এরই মধ্যে বাজার অর্থনীতির অনেক কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সনাতন অর্থনীতি তার আর নেই।
মোদি সরকার বিষয়গুলো কতটা অনুধাবন করতে পারছে তা জানি না, কিন্তু বড় রোগের সব লক্ষণ দেশটির অর্থনীতির মধ্যে ফুটে উঠেছে। একটি ভ্রান্ত দর্শনের ওপর ভিত্তি করে মোদি সরকার দেশটির অর্থনীতিকে পরিচালিত করছে। কারণ হিন্দুবাদ কোনো জীবনব্যবস্থার মতবাদ (ডকট্রিন অব লাইফ) নয়। অন্য দিকে ইসলাম একটি ‘টোটাল ডকট্রিন’। অনেকে যখন রাজনীতিকে ধর্মনিরপেক্ষ করার কথা বলেন তখন আমার হাসি পায়। এতে ধর্ম সম্পর্কে, বিশেষ করে ইসলাম সম্পর্কে তার অজ্ঞতাই ফুটে ওঠে। ডকট্রিনই তোমাকে নির্দেশ দেবে এই কাজগুলো তুমি করো। হিন্দু ধর্ম হলো ইলিউশন অব লাইফ। তারা বলে পার্থিব জীবনের অংশটি হলো অনন্তকালের যাত্রাপথে একটি ‘মায়া’ মাত্র। আর ইসলামের ডকট্রিন একজন মানুষ তার জীবনকালে পৃথিবীতে যেসব কাজ করবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়। ইসলামিক ব্যবহারশাস্ত্রে ইসলামিক ল অব জুরিসপ্রুডেন্স যেভাবে জীবন পরিচালনার দিকনির্দেশনা দেয়া আছে অন্য কোনো ধর্মে সেভাবে দেয়া নেই। খ্রিষ্টবাদে কিছুটা আছে।
ডকট্রিন না থাকার জন্য একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সামনে অনুসরণ করার কিছু নেই। তাই হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও ভারতের অর্থনীতিকে মন্দার পথেই নিয়ে যেতে পারে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা