২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিদেশে অর্থপাচার

-

অনুন্নত দেশগুলো বিদেশী ঋণ নিয়ে থাকে। কিছু বিদেশী ঋণ সরাসরি বিদেশী রাষ্ট্র থেকে নেয়া হয়, আবার কিছু বিদেশী ঋণ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং আইএমএফ থেকে নেয়া হয়। আইএমএফ কিংবা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যে ঋণ দেয়, সে অর্থ আসে উন্নত দেশ থেকে। এই ঋণ নেয়া গত ৫০-৬০ বছর ধরে চলছে। কিন্তু এর আগে এটা তেমন ছিল না।

এই ঋণ কোনো রাষ্ট্রের কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না; বরং এসব ঋণের বেশির ভাগের সুদ উচ্চ হারের হয়ে থাকে। কিছু ঋণের সুদহার নিম্নও হয়। এ সুদ দিতে হয় দেশের রাজস্ব থেকে। একসময়ে নতুন ঋণ নিয়ে যা পাওয়া যায়, তা পুরনো ঋণের সুদ পরিশোধ করতেই ব্যয় হয়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এ অবস্থায় পতিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, আজকের উন্নত দেশগুলো যখন উন্নতি শুরু করেছিল ১০০ বছর বা তারও আগে, তখন তারা কারো ঋণ নেয়নি। নিজেদের সম্পদ দিয়েই উন্নয়ন করেছে। ঋণ নিয়ে উন্নয়নের ধারা শুরু হয় পরে। সুতরাং সমাধান হচ্ছে, বিদেশী ঋণ না নেয়া। তাহলে কোনো দেশই সুদের চক্রের আবর্তে পড়বে না। নিজের অর্থ দিয়ে সব কাজ করা উচিত, উন্নয়নও করা উচিত। মেগা প্রজেক্ট কম করে বা না করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং রফতানির ওপর বেশি জোর দেয়া উচিত। আমাদের যেসব কৃষিপণ্য রফতানি করা যায়, সেগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি করা উচিত। যেমন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চা ও পাট; এ ছাড়া তৈরী পোশাক ও সামুদ্রিক মাছ। এতে উন্নয়ন ধীরে ধীরে হলেও ভালো হবে। কারণ, সুদ দিয়ে ঋণ নিলেও তা একপর্যায়ে সুদ দিতেই ব্যয় হয়ে যায়। বিদেশী ঋণ নিয়ে কিছুটা উন্নয়ন করে রাজনৈতিক বাহবা পাওয়া দেশের জন্য কল্যাণকর হয় না। এ জন্য কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।

এখন বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করছি। বিদেশী বিনিয়োগ বিদেশী ঋণের মতো ক্ষতিকর নয়। তবে বিদেশী বিনিয়োগ নিতে হবে সেসব ক্ষেত্রে, যেসব ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়ন প্রয়োজন। কোন বিদেশী বিনিয়োগ নেব, কোনটা নেব না তা নির্ধারণ করবে যে দেশ বিদেশী বিনিয়োগ নিচ্ছে, সেই দেশ। উপযুক্ত বিদেশী বিনিয়োগে দেশের কল্যাণ হয়ে থাকে। কারণ, এতে বিভিন্ন শিল্প গড়ে ওঠে এবং সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থান। এসব বিনিয়োগ থেকেই স্থানীয় পণ্য ক্রয় করা হয় এবং শ্রমিক ও অফিসারদের বেতন দেয়া হয়।

বিদেশীদের লাভ হচ্ছে কেবল তারা যদি ব্যবসায়ে মুনাফা করে, তবে এর একটা অংশ তারা নিজেদের দেশে নিয়ে যেতে পারে। এটাই তাদের লাভ। এতে আমাদের কোনো ক্ষতি হয় না। তাদের উৎপাদিত পণ্য অনেকসময় রফতানিপণ্যও হতে পারে। তাহলে আমাদের দেশের রফতানি বাড়ে। সার্বিক বিবেচনায়, বৈদেশিক বিনিয়োগ গ্রহণযোগ্য।

এরপর দেশের অর্থ বিদেশে পাচারের বিষয়ে বলব। একে ‘মানিলন্ডারিং’ বলা হয়। এই মানিলন্ডারিং বন্ধ হলে বিদেশী ঋণের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জাতিসঙ্ঘে প্রদত্ত ভাষণে এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, অনুন্নত দেশ থেকে অর্থ পাচার করা হলে তাতে কিছু শিল্পোন্নত দেশ ‘ট্যাক্স হেভেন’ দেয়। এ ছাড়া ইমরান খান আরো প্রশ্ন তুলেছেন, যেসব দেশ থেকে এসব সম্পদ পাচার হয় ওই সব পাচারকারীর নাম, তথ্য ও অর্থের পরিমাণ জানতে চাইলেও তাদেরকে জানানো হয় না; বরং আইনগতভাবে বিধান করা হয়েছে এসব তথ্য গোপন করার জন্য। অর্থপাচার সহজ করার জন্য এসব আইন করা হয়েছে। এটা হচ্ছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ভয়াবহ অন্যায়। তারা অন্য দেশকে শোষণের রাস্তা খুলে দিয়েছে। তা বন্ধ করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। ইমরান খান দাবি তুলেছেন এগুলো বন্ধ করার জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রই উদ্যোগ নেয়ার। এটা সঠিক দাবি। যদি মানিলন্ডারিং না থাকে তাহলে ঋণের প্রয়োজন পড়বে না। পাশ্চাতের কিছু দেশ শোষণের জন্যই মানিলন্ডারিংয়ের পথ খোলা রেখেছে, যাতে অনুন্নত দেশগুলো বিদেশী ঋণ নিতে বাধ্য হয় এবং তারা নিজেরা সুদ খেয়ে মোটা হয়। এটা একটা বিরাট বিষয়। আমি মনে করি, এ ব্যাপারে ব্যাপক লেখালেখি ও আন্দোলন হওয়া দরকার।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement