আইন এবং এর প্রয়োগ
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ২০ অক্টোবর ২০১৯, ১৮:৩৫
যেসব দুর্বলতার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো জাতির এগিয়ে যাওয়া স্থবির হয়ে যেতে পারে তার অনেক লক্ষণই এখন আমাদের এখানে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে দিকনির্দেশিকা রয়েছে, তা হচ্ছে সংবিধান। প্রতিটি দেশের মতো এই জনপদের মানুষের চরম অভিপ্রায়, অভিব্যক্তি ঘটেছে তার সংবিধানে। একগুচ্ছ বিধানসংবলিত সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। অথচ এই বিধানাবলির কল্যাণময়ী যে নির্দেশনাগুলো রয়েছে তা অনুসরণ করার ক্ষেত্রে রয়েছে যত অবহেলা।
এর অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে অনিয়ম, অব্যবস্থা, অরাজকতা যা মানুষ এখন ভোগ করছে। তাই কোথাও আর স্বস্তি নেই। যেখানেই দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে সেখানে নানা ব্যত্যয়ের ঘটনা লক্ষ করা যায়। এই বিষয়গুলো নিরসন নিয়ে প্রশাসনের যত ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠার কথা ছিল, তা কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে না। সবাই যেন গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলছে। এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনায় যে পথ পন্থা অনুসরণ করা উচিত, তাও নেই। কোনো জীবন্ত প্রশাসনের নজির এমন নিষ্ক্রিয়তা নয়। এর পরিণতি যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সমাজের প্রতিটি স্তর ক্রমাগত জরাজীর্ণ হয়ে উঠছে। যে নিয়মশৃঙ্খলা অনুসৃত হওয়ার কথা, তার বালাই নেই। রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে এমন শৃঙ্খলা যদি হারিয়ে যায় তবে তার অশুভ প্রভাব বাছবিচার করে পড়বে না। সবাইকে অনিবার্যভাবে এর শিকার হতে হবে।
উপরে যে আপেক্ষের কথা বলা হলো, তাকে দূর করতে হলে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ছিল অপরিহার্য। একটি পরিশুদ্ধ সমাজ নির্মাণের জন্য আমাদের আইনের কোনো কমতি নেই। অথচ তার প্রয়োগ নিয়েই যত কথা। তাছাড়া আরো সমস্যা হচ্ছে, এসব আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। কিন্তু তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োগকারীরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখে না। অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হয়ে পড়ে। ফলে আইন তার স্বাভাবিক সরল পথে চলতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই যে কল্যাণের উদ্দেশ্যে আইন তৈরির লক্ষ্য সেটা ভেস্তে গেছে। এই নীতিহীনতার কারণে সমাজে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই হচ্ছে বেশি। এতে আইনের সুরক্ষা নেই বরং ভোগান্তি বাড়ছে। যেমন বাংলাদেশে নেশা ও জুয়া সর্বোচ্চ আইনে নিষিদ্ধ। অথচ দেশবাসী এবার দেখতে পেয়েছে আইনকানুন নীতি-নৈতিকতা সব কিছু দুমড়ে মুচড়ে ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে কি দুর্দান্ত প্রতাপে নেশা ও জুয়া রাজধানীসহ সারা দেশে চলেছে।
যারা আইন প্রয়োগ করবেন এবং যারা সংরক্ষণের শপথ নিয়েছেন তাদের দৃষ্টির সামনেই কিভাবে এসব পল্লবিত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের সহযোগীদের সহায়তায় এসব বিস্তার লাভ করেছে। তাই এ কথাই বলতে হয়, আইনের এমন লঙ্ঘন ঘটে অর্থ বিত্ত ও প্রভাবশালীদের মদদে। এমনো অসংখ্য নজির রয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কারসাজিতে বহু নিরপরাধ মানুষ দণ্ডিত হয়েছে আর অপরাধী মুক্ত থেকে সমাজে আরো দাপটে দশটা অপরাধ করে বেড়ায়। এ দেশের দুর্নীতি নিয়ে এখন নানা কথা হচ্ছে। এর মূল কারণ যদি অনুসন্ধান করা হয় তবে দেখা যাবে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েই এসব বিস্তার লাভ করেছে। আর দুর্নীতিই হচ্ছে আইনের শাসনের সবচেয়ে বড় বাধা। এটা অবাক হওয়ার বিষয়, এখন দুর্নীতি যে তত্ত্ব তালাশ হচ্ছে সে ক্ষেত্রে যে ভূতের সন্ধান পাওয়া গেছে তাতে সেটা তাড়ানো কঠিন।
কেননা যে সরিষা দিয়ে ভূত ছাড়াতে হবে সেই সরিষাতেই এখন ভূত আছর করে আছে। অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান চলেছিল, তাতে এটাই বেরিয়ে এসেছে যে এর সাথে জড়িত ক্ষমতাসীনদের সব নিকটজন। সর্বস্তরের মানুষ আশা করেছিল, এই অভিযান চলবে এবং শুধু চুনোপুঁটি নয় রাঘববোয়াল জালে আটকা পড়বে। কিন্তু এই অভিযানের এখন যে গতিবেগ তাতে এই অভিযান সহসাই মরুপথে হারিয়ে যাবে এমন আশঙ্কাই সবার। তবে এই অভিযান একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, এই অভিযান নিয়ে যারা অনেক আশা আশ্বাস দিয়েছিলেন, তার ভিত্তিমূল ফাঁপা বলেই মনে নয়। তাই তাকে শুধু শিশু ভোলানোর ছড়া মনে করতে হবে, এর বেশি কিছু নয়। জাতীয় নেতাদের কাছ থেকে যদি এমন ফাঁপা আশ্বাস আসে, তবে সমাজের মানুষ শুদ্ধ আচরণ কাদের থেকে পাবে। আজ সমাজে যে দুরাচার অবক্ষয় নীতিহীনতা প্রসার ঘটেছে তার ইতি ঘটাবে কে!
আইনের শাসনের এই অধোগতি নিয়ে প্রতিকারের কোনো ভাবনা দেশের উপরের মহলে রয়েছে তা তাদের আচার আচরণ থেকে উপলব্ধি করা যায় না। এই অধোগতির অনেক কারণের মধ্যে রাষ্ট্রের যারা নির্বাহী তাদের বোধ বিবেচনা যোগ্যতা দক্ষতা এবং প্রতিশ্রুতি থাকায় বিষয়টি অপরিহার্য। তারা এসবের অধিকারী কতটা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। একই সাথে এটা ভাবতে হবে দেশের রাষ্ট্রাচারে জবাবদিহিতার অনুশীলন কতটুকু।
প্রশাসনে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার পাশাপাশি আমলাদের একইভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত হলে আইনের শাসন কার্যকর হতে পারে। কিন্তু এখন এমন ব্যবস্থা বহাল নেই। রাজনৈতিক নির্বাহীদের জবাবদিহির জায়গাটা হলো আইনসভা, অথচ সেই সভা এই দায়িত্ব পালনে এখন সে ভূমিকা রাখছে না। ফলে রাজনৈতিক নির্বাহীরা এখন এতটাই স্বাধীন যে, তাদের বেপরোয়া হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো লাগাম নেই। এর ফলে এখন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হওয়ার পথে। এমন পরিস্থিতিতে তো আর দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রকাশ ও অধিকার ভোগ করা সম্ভব হওয়ার নয়। অথচ এসব রাজনৈতিক নির্বাহীদের আইনসম্মত দায়িত্ব হচ্ছে আইন মানার বিষয়টি তদারকি করা। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে আইনের মান্যতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কোনো নজির দেখা যায় না।
ফলে চার দিকে কেবলই নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না হওয়ার কারণে বহু ক্ষেত্রে সমাজবিরোধীরা আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। দেশে বিচারব্যবস্থার প্রতি চরম অবজ্ঞা দেখিয়ে তারা নির্দোষকে দোয়ী সাব্যস্ত করে শাস্তি বিধান দেয়া এবং তা কার্যকর করছে। সমাজের এমন ‘ল লেসনেস’ অবস্থা কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বৃত্তরা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে করে থাকে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এদের পেছনে যেমন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা লক্ষ করা যায়; সেই সাথে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে থেকে যারা এসবের শিকার তাদের পাশে দাঁড়ানোর কোনো প্রয়াস লক্ষ করা যায় না।
এমন সব ঘটনা বিচারে সোপর্দ হলে, সে বিচার সব সময়ই দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়ে। আর এমন বিলম্ব বস্তুত বিচারহীনতারই নামান্তর। আর এমন সমালোচনা রয়েছে যে, বিচার বিভাগের পক্ষে স্বাধীনভাবে তার কাজ সম্পাদন করার ক্ষমতা নেই। কেননা মহলবিশেষ তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। এসব কথা শুধু ভুক্তভোগীরাই বলছে না, খোদ বিচার বিভাগ থেকে উঠছে। বাংলাদেশ বিশ্বের পশ্চাৎপদ দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার এখনো নিছক কথার কথা হয়ে আছে। অথচ আইনগত বিচার বিভাগ স্বাধীন বটে কিন্তু নি¤œ আদালতের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য নয়। সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে প্রশাসনের একটি ভূমিকা রয়েছে। যেমন অপরাধটি আদালতে কিভাবে পেশ করা হবে সেটার ওপর নির্ভর করে দোষী সাব্যস্ত করতে আদালত কতটা সক্ষম হবে। একই সাথে বলতে হয়, এ দেশে বিচার পাওয়া নিয়ে অর্থকড়ির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
আইনজীবীরা বিচারপ্রার্থীর কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থকড়ি নিয়ে থাকেন, সেটাও একটা বিষয়। বিচার দীর্ঘদিন ধরে চললে বিচারপ্রার্থীর পক্ষে অর্থ জোগান দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে বিচারে সিদ্ধান্ত না পেয়েই অনেককে ফিরে আসতে হয় আদালত থেকে। আর সে কারণে বিচারের বাণী নিভৃতে কেদে সারা হয়। এর প্রমাণ প্রতিদিনই নানা ঘটনার মধ্যে লক্ষ করা যায়। সমাজে শাসনব্যবস্থা কোনোভাবে বহাল রাখার জন্য শাসকবর্গ নিজেদের গোষ্ঠীর স্বার্থে রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানকে যতটুকু প্রয়োগ করা প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই কার্যকর করে। এভাবে নিজেদের সুবিধামতো আইনকে কাটছাঁট করা হলে তাতে কোনোভাবে আইনানুযায়ী প্রশাসন পরিচালনা সম্ভব নয়। এভাবে হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য পার পাওয়া যেতে পারে কিন্তু দীর্ঘ সময় এভাবে চলতে পারে না। নিয়মনীতি ব্যতিরেকে সমাজ চলতে গেলে নানা সমস্যার সব উপসর্গ দেখা দিতে বাধ্য। সুনীতি অনুসরণ করে এর শুশ্রƒষা নাহলে সমাজের সর্বাঙ্গে ব্যাধি ছড়িয়ে যাবে, তা থেকে কারো পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো সুযোগ আর থাকবে না। আমাদের নেতৃত্ব স্বয়ং এসব অনিয়মের সাথে জড়িত বলে এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভ নিছক দুরাশা বটে।
আইনের শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানবাধিকার সংরক্ষণ। বাংলাদেশে সংবিধানে মৌলিক অধিকারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মৌলিক অধিকার নিয়ে সংবিধানে একটি পৃথক অধ্যায় রয়েছে। এই অধ্যায়ে ২৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকারের সুরক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে যাবতীয় বিধিবিধান থাকা সত্ত্বেও এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু নজির রয়েছে। আর বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। মানুষ স্বাধীনভাবে তার মতপ্রকাশ করতে পারবে কোনো বাধা বিপত্তি ব্যতিরেকে, এটাই নীতি।
কিন্তু এই অধিকার এখানে কতটা সঙ্কুচিত তার সর্বশেষ জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের জীবনদান। তার স্বাধীন মত প্রকাশ করতে গিয়ে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। এই নিমর্মতা সর্বশেষ হলেও সর্বপ্রথম নয়। এমন বহু আবরার নিজ পথ বিশ্বাসের জন্য জীবন দিতে ও নির্যাচিত হয়েছে। অথচ যারা আইনের সংরক্ষণ ও মজলুমের প্রতি সহায়তা দেয়া শর্ত, এমন সব দুর্যোগের সময় তাদের নিষ্ক্রিয় এবং আইনকে সরল পথে চলতে দেয়নি। এমন অস্বচ্ছ পক্ষপাতপূর্ণ আচরণের কারণে নিগৃহীত মানুষ আজকে চরম দুঃখ হতাশায় ভুগছে। আরো পরিতাপের বিষয় হলো, এসব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কোনো জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয় না। মানুষের প্রতি সম আচরণ না করার এমন উদাহরণগুলো ন্যায়পরায়ণতার বরখেলাপ।
বেশুমার যত দুর্যোগের কথা বলা হলো ও তা থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজ না হলেও রাষ্ট্রতরীকে কূলে ভেড়াতে হলে অবশ্যই একটি শুদ্ধাচার অভিযান শুরু করার বিকল্প নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু হয়েছে তাকে থামিয়ে না দিয়ে বেগবান ও বহুমুখী করার দাবি দেশের সব মানুষের। এই দাবিগুলো পূরণ করলেই সমাজের আগাছা পরগাছা সব ঝরে যাবে। আর তাতে একধাপ এগিয়ে যাওয়া যাবে। এতে যারা পেছনে থেকে ছত্রছায়া দিয়ে আসছে, তারা যদি অধরা থেকে যায় তবে এই অভিযান সফল হবে না। অবশ্যই সেটা কঠিন কাজ হলেও পিছিয়ে যাওয়া যাবে না। এরা যত শক্তিশালী হোক কিন্তু দেশের মানুষের সম্মিলিত আকাক্সক্ষা রয়েছে অভিযানের সাথে। আর তাই এটা কোনো কম শক্তি নয়।
ndigantababor@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা