তিনি একাত্তরে কী চিন্তা করলেন
- সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
- ০৩ অক্টোবর ২০১৯, ১৯:৫৮
আমার সাপ্তাহিক বা নিয়মিত কলামটি নয়া দিগন্তে শুক্রবার ৪ অক্টোবর প্রকাশিত হলো। কারণ, আজকের নিবেদনের সাথে আজকের তারিখটির আছে আবেগের সম্পর্ক। এ কলামের অন্যতম উদ্দেশ্য, দেশবাসীর কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধার মনের আকুতি ও প্রত্যয় প্রকাশ; সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা নিবেদন এবং সহকর্মীদের কাছে সহযোগিতার জন্য আবেদন করা। আজকের স্মরণীয় মুহূর্তে, আমার আত্মার নিকটতম অস্তিত্ব যিনি, পরম করুণাময় সেই সৃষ্টিকর্তা, বিশ্বজগতের প্রতিপালক তথা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে প্রথমেই স্মরণ করছি; অতঃপর দরূদ ও সালাম বিনীতভাবে নিবেদন করছি আমার সৃষ্টিকর্তার পরম বন্ধুর প্রতি। ওলি-আল্লাহগণ তথা আউলিয়ারা রাসূল সা:-এর জ্ঞানের ও আধ্যাত্মিকতার উত্তরসূরি; তাই সেই চেতনার সুবাদে স্মরণ করছি মহৎ ও শ্রদ্ধেয় আউলিয়াদেরকেও।
১৯৪৯ সালের ৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের হালদা নদীর তীরে একটি নিভৃত পল্লীর ‘সৈয়দ পরিবারে’ যে শিশুটি জন্ম নিয়েছিল এবং নাম পেয়েছিল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, আজ ৪ অক্টোবর তার জন্মদিন। এবার হলো ইবরাহিমের ৭১তম জন্মদিন বা ৭০তম জন্মবার্ষিকী এবং তিনি আজ ৭১ বছরে পা দিচ্ছেন। এ জীবনের সাতটি দশক পার হয়ে গেছে। মাঝখানে, সেই ১৯৭১ সালের স্মৃতি, মাহাত্ম্য ও মহত্ত্ব আজো তার চেতনাকে সমৃদ্ধ রেখেছে। তাই আজকের প্রবীণ ইবরাহিম আনন্দে উদ্বেলিত যে, ‘একাত্তর’ শব্দটি তার জীবনে আরেকবার এলো। কলামের পাঠকগণের সাথে সে আনন্দই উদযাপন করতে চাই।
মুক্তিযুদ্ধ : কী, কেন, কারা?
‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যে মহাকাব্যিক ইতিহাস, সেটা এই প্রবাদবাক্যের বাস্তবতার উজ্জ্বলতম সাক্ষী। সময় যত পার হবে, প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ততই কমবে এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি ততই দুর্বল হবে। কেনই বা ৩০ লাখ বাঙালি প্রাণ দিলো, কেনই বা লাখ লাখ মা-বোন শুধু দেশের দিকে তাকিয়ে নিজেদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিল, এটি গবেষণার বিষয় অবশ্যই। কিন্তু সেই গবেষণা যদি বইয়ের পৃষ্ঠায় সীমিত থাকে, তাহলে লাভ কী? কেনই বা লাখো তরুণ বুকটা পেতে দিয়েছিল সম্মুখশত্রুর গুলির সামনে, এই প্রশ্নের উত্তরও অবশ্যই রূপকথার মতো, নিরস সাহিত্যের ভাষায়, বা নির্মম বা অপ্রিয় কথার মাধ্যমেও দেয়া যায়। সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে, ততই বলিষ্ঠ সত্যগুলো মিথ্যার আবরণে ঢাকা পড়ছে। তাই আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, আমাদের মনটা মাঝে মধ্যেই বিচলিত হয়ে ওঠে; মনকে শান্ত করার জন্য চেষ্টা করতে হবে, সফল হই বা না হই! যেহেতু অনুচ্ছেদটির শিরোনাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’, তাই প্রারম্ভেই আজকের স্মরণীয় মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি, শহীদ জিয়ার প্রতি এবং রণাঙ্গনের সব মুক্তিযোদ্ধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
সচেতনতা, সম্পৃক্ততা এবং কথা বলা বা না বলা
ওপরের অনুচ্ছেদে বলেছি : ‘সেই মনকে শান্ত করার জন্য চেষ্টা করতে হবে, সফল হই বা না হই!’ সেই চেষ্টার অংশ হলো জনগণকে সচেতন রাখা তথা সচেতন জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত থাকা। এই প্রক্রিয়ার অংশ হলো, কথা বলা। কথা বলা মানে শুধু রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে দেয়া ভাষণ নয়, বরং টেলিভিশনে ও সভা-সমিতিতে বলা, মঞ্চে বলা, পত্রিকায় কলাম লেখা ইত্যাদি। এই কলামের মাধ্যমেই আপনার সাথে, আপনাদের সাথে কথা বলছি। কথা বললে কেউ না কেউ কথককে পছন্দ করবে, আবার কেউ না কেউ করবে অপছন্দ। আপনি বা আমি যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের কথা বলি, তাহলে স্বার্থান্বেষী গ্রুপের মানুষেরা আমাদেরকে দারুণভাবে অপছন্দ করবে। আমরা যদি দেশের স্বার্থের কথা বলি, সাধারণ মানুষ আমাদেরকে পছন্দ করবে, কিন্তু ক্ষমতার বারান্দায় যারা পদচারণা করেন, তারা আমাদেরকে পছন্দ করবেন না এবং চরম সত্য হলো, আপনি বা আমি যদি আল্লাহকে ভয় করি তাহলে আমাদেরকে সত্য কথাটাই বলতে হবে, চাটুকারিতা থেকে থাকতে হবে দূরে।
কিন্তু চরম বাস্তবতা হলো, তৃতীয় বিশ্বের বা দক্ষিণ এশিয়ার তথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে মিথ্যা বলা ও চাটুকারিতা, দু’টি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য এবং রাজনীতিতে অগ্রগতির জন্য এই কর্ম দু’টিতে ‘দক্ষতা’ প্রয়োজন! তৃতীয় বিশ্বের তথা বাংলাদেশের রাজনীতির উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা, নগ্ন-সত্য পছন্দ করেন না। অথচ আপনি-আমি কথা বলার সময়, নগ্ন-সত্য না বললেও পরিশীলিত সত্য কথা বলতেই হবে; তা না হলে মানুষ আমাদেরকে মন্দ বলবে। অতএব উপসংহার হচ্ছে, আপনাকে বা আমাকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে; যথা : আপনি বা আমি কী কথা বলব, নাকি আপনি কথা বলবেন না, আর আমিও কথা বলব না? আপনি বা আমি কথা না বললে কেউ আমাদের সমালোচনা করবে না। বাংলায় একটি প্রবাদবাক্য আছে, ‘বোবার কোনো শত্রু নেই’। আপনি কথা না বললে, কেউ টের পাবে না যে : ‘আপনি ভরা না খালি কলসি’! আপনি কপট গাম্ভীর্য নিয়ে ভরা কলসির ভাব প্রদর্শন করতে পারবেন।
রাজনীতি করতে গেলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে চাটুকারিতার সাথে যে বৈশিষ্ট্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং নিবিড়ভাবে অভ্যাস করা হয়, এর নাম ‘কপটতা’। কিন্তু আমি (ইবরাহিম) কথা বলতাম, এখনো বলছি। কথা বলাটা যদি দোষের হয়েই থাকে, তাহলে নিজে সেই দোষ অনেক দিন ধরেই করে যাচ্ছি; অন্ততপক্ষে ১৯৯৭ সালের জুলাই মাস থেকে তা করে যাচ্ছি। একাধিক রাস্তার সংযোগস্থলে দাঁড়ালে যেমন একটি সুযোগ আসে, কোন রাস্তা দিয়ে হাঁটব সে সিদ্ধান্ত নেয়ার; তেমনি জীবনের সাতটি দশকের শেষ এবং অষ্টম দশকের শুরুর বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আমার জন্যও এখন গভীর চিন্তার সময়; মূল্যায়ন করতে হবে, কোন পথে হেঁটে এসেছি, কোন পথে আগামীতে হাঁটব; কতটুকু সাথে পেলাম, কতটুকু সাথে নিলাম? মূল্যায়ন করার আত্মার শক্তি ও চরিত্রের শক্তি কতটুকু খরচ করে ফেললাম, কতটুকু জমা আছে?
বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্য
যেকোনো রাষ্ট্রের সচেতন নাগরিক মাত্রই যেকোনো প্রয়োজনীয় মুহূর্তে দ্বিধাহীনভাবে স্মরণ করে, তাদের প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষেরা তথা ফাউন্ডিং ফাদার্স কী চেয়েছিলেন এবং কী বলেছিলেন। আমরাও স্মরণ করতে পারি, আমাদের ফাউন্ডিং ফাদার্স বা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষেরা কী বলেছিলেন? বঙ্গবন্ধু কী বলেছিলেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম কী বলেছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদ কী বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান কী বলেছিলেন, এম এ জি ওসমানী কী বলেছিলেন- এগুলো নিশ্চয়ই প্রণিধানযোগ্য। জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা কী বলেছিলেন, সেটা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। আজ সবগুলো কথা বলতে পারব না।
কারণ, কলামের দৈর্ঘ্য সীমিত এবং পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানো উচিত হবে না। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে, তদানীন্তন পাকিস্তানের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত বাঙালি জনপ্রতিনিধিরা সম্মিলিত হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (প্রোক্লামেশন অব ইনডিপেনডেন্স) গ্রহণ করেছিলেন। সেই ঘোষণাপত্রটি বর্তমানে বাংলাদেশের মুদ্রিত সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঘোষণাটির মাঝামাঝি অংশ থেকে একটি অনুচ্ছেদ হুবহু উদ্ধৃত করছি। ‘সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং।’ এ অনুচ্ছেদে উদ্ধৃত অংশের মধ্যে তিনটি শব্দের প্রতি পাঠক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি : সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। মুক্তিযোদ্ধা ইবরাহিম যেমন দেশবাসীকে সাথে নিয়ে ওই তিনটি শব্দ স্মরণ করছেন, তেমনি আর মাত্র দুই মাস পর যখন ডিসেম্বর মাস আসবে, তখনো একই প্রশ্ন দেশবাসী নিজেরাই স্মরণ করতে পারবেন। কারণ, এ তিনটি শব্দ বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রত্যেকের জীবনকে স্পর্শ করে।
কোন স্বার্থ এবং কার স্বার্থ প্রাধান্য পায়?
এখন আমরা একসাথে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের প্রসঙ্গটি আলোচনা করছি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কয়েকটি বাধা বা সীমাবদ্ধতা উল্লেখযোগ্য। আমাদের মতে, বাংলাদেশের গত ৪৮ বছরের সরকারগুলোর মধ্যে প্রতিটি সরকার সমানভাবে বা সমানুপাতিকভাবে এ তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেননি। অনেক ক্ষেত্রেই সরকার জনগণের স্বার্থের ওপর দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছিল। সে জন্যই এ বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি। জনগণের স্বার্থ মানে দেশের স্বার্থ কিংবা দেশের স্বার্থ মানে জনগণের স্বার্থ। এই স্বার্থ দুই প্রকার হতে পারে; যথা : তাৎক্ষণিক বা স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। আমার মূল্যায়নে ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল, দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে স্বল্পমেয়াদি স্বার্থকে গুরুত্ব বেশি দেয় অথবা দলের স্বার্থকে বড় করে দেখে, সে জন্য এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। যেহেতু সততা ও দেশপ্রেমকে শ্রেণিকক্ষে আলোচনার বিষয় ছাড়া আর কিছুই মনে করা হচ্ছে না, সেহেতু সমাজে এর প্রতিফলন ঘটানোর উদ্যোগ কোনো সময় দেখিনি। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসের ২৪ তারিখের নাটকীয়তায় তথা সামরিক শাসন জারির সময় একবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা শুনেছিলাম।
‘ওয়ান-ইলেভেন’ নামক রাজনৈতিক নাটক মঞ্চায়নের সময়েও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একই রকম যুদ্ধের কথা শুনেছি। আবার অতি সাম্প্রতিককালেও (প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে) দুর্নীতিবিরোধী এরূপ অভিযানের কথা আমাদের সামনে আসছে। বাংলাদেশের শাসকেরা, বেশির ভাগ সময়েই বেশির ভাগ বিষয়ে সিরিয়াস হননি। কারণ, দেশের স্বার্থ শাসকদের নিকট গৌণ, দলের স্বার্থ এবং নিজের ব্যক্তিস্বার্থ মুখ্য ছিল বা আছে। আমরা এর আশু পরিবর্তন চাই। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির নীতিবাক্য হলো : ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’। কল্যাণ পার্টি জনবলের আঙ্গিকে ছোট, কিন্তু চিন্তায় এবং চেতনায় বড়। আমরা ২০ দলীয় জোটে ছিলাম এবং আছি। এরই আওতায় আমরা ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ নামক একটি রাজনৈতিক প্রবাহ সৃষ্টি করেছি। নিকটতম পার্লামেন্ট নির্বাচনে আমরা ৫০টি আসনে প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিএনপির কোটি কোটি নিপীড়িত-নির্যাতিত কর্মী আমাদের আত্মার আত্মীয়। আমরা একা পরিবর্তন আনতে পারব না, তাই সর্বদাই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ওপর অতীতেও আমরা গুরুত্ব আরোপ করেছি, বর্তমানেও করছি।
ধন্যবাদ জানাই
সরকার তথা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে ধন্যবাদ জানাই কিছু বিষয়ে। সীমিত দৈর্ঘ্যরে কলামে সব কিছু বিস্তারিত উল্লেখ করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ : (ক) জিডিপি বা দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, (খ) ১৯৯৬ সালে ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা পানিচুক্তি স্বাক্ষর, (গ) পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, (ঘ) সমুদ্রসীমা বৃদ্ধি, (ঙ) রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান, (চ) প্রসূতি-মা ও শিশু মৃত্যু হ্রাস ও (ছ) দুর্নীতিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি ইত্যাদি।
ধন্যবাদ জানাতে পারলাম না
দেশে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ হচ্ছে, যুগের পর যুগ ধরে যেহেতু দুর্নীতি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান ছিল, গত এক দশকে বহুলাংশেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সে দুর্নীতির জ্যামিতিক হারে বিশালত্ব লাভ। শুধু আর্থিক দুর্নীতি নয়, বাংলাদেশের সামাজিক নৈতিকতা, শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈতিকতা এমনকি ধর্মীয় অঙ্গনের নৈতিকতাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার জন্য গত ১২ বছরের শাসনই মূলত দায়ী। ভৌত কাঠামোমূলক উন্নয়ন বা ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট হলেও অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে এবং শেয়ার মার্কেটের কর্মকাণ্ড, ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করলে এটি বোঝা যায়। ধর্ষণ-প্রবণতা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, নারীর প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে সহিংসতা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একধরনের ভারসাম্যহীনতা গত ১২ বছরে সৃষ্টি হয়েছে। মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ভারসাম্যহীনভাবে বেড়েছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনগুলো যেহেতু চরম অনৈতিকতার ওপর দণ্ডায়মান এবং সাধারণ জনগণের অনুভূতির প্রতি চরম বিদ্রƒপস্বরূপ, তাই বিদ্যমান রাজনৈতিক সরকার কোনো কিছুই নৈতিক সাহস নিয়ে করতে পারেনি। এর ব্যতিক্রম ঘটাতে, একটি উদ্যোগ নিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী; উদ্যোগ কতটুকু গভীরে যাবে ও টিকবে; সে বিষয়ে আজ মন্তব্য করতে পারছি না। এবার সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে দেশের পরিস্থিতি সবার জানা। দুর্নীতি, লাম্পট্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধভাবে টাকা কামানো ও সম্পদ বাড়ানো এবং বিদেশে অর্থপাচারের কাহিনীগুলো সব উঠে আসছে এবং এসব খলনায়ক ক্ষমতাসীন দলেরই দাপুটে ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ যে, তিনি কাজটিতে হাত দিয়েছেন।
কিন্তু এটাও সত্য, তিনি কাজটিতে অনেক দেরিতে হাত দিয়েছেন। নিউ ইয়র্কে সংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত ভাষণে তিনি স্বীকার করেছেন, এসব দুর্নীতির কারণে দেশের উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজটি, শিলাখণ্ডের সর্বোচ্চ ভাগে হাত দেয়ার চেয়েও কম। কারণ ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও আলোচিত কোনো দুর্নীতির বিচার করার প্রবণতা এই সরকার আজ অবধি দেখায়নি। এরূপ চটকদার কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যগুলোর মাধ্যমে ১২ বছর ধরে নিপীড়িত ও নির্যাতিত সাধারণ মানুষের মনে, প্রধানমন্ত্রী ও শাসক দলের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজনীতির অঙ্গনে ১০ বছর ধরে এ দল কঠোর সংগ্রাম করছে প্রধান বিরোধী শিবিরকে রাজনৈতিকভাবে ‘মার্জিনালাইজ’ করতে। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বেগম জিয়াকে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। অন্য লাখ লাখ কারাবন্দী বা মামলার আসামিদের কথা না-ই বা বললাম। যতটুকু লিখলাম বা বললাম, তার বহু গুণ বেশি না বলা বা অলিখিত থেকেই গেল।
নবজন্ম বা পুনর্গঠন প্রয়োজন
সম্মানিত পাঠক, ওপরের দু’টি অনুচ্ছেদ পুনরায় লক্ষ করুন। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে, একাত্তরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ইবরাহিম মনে করেন যে, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক নবজন্ম প্রয়োজন। বলা যায় নতুন স্বচ্ছতা নিয়ে, নতুন প্রত্যয় নিয়ে, নতুন উদারতা আর নতুন সহনশীলতা নিয়ে, সমঝোতার পরিবেশে আমাদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির বয়স এক যুগ পূর্ণ হতে আজ থেকে দুই মাস বাকি। ১২ বছরের অভিজ্ঞতায়, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক ইবরাহিম কয়েকটি অভিমত উপস্থাপন করছি।
এক. সহনশীল ও নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বেগম খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া প্রয়োজন; অতএব মুক্তি দেয়া হোক; দুই. সহনশীল ও নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পরিবেশে ও নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করা হোক; তিন. মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং দেশ পরিচালনাকারী যেকোনো সরকারের বিভিন্ন স্তরে জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ করা হোক; চার. প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ও বিচার বিভাগের উচ্চ অঙ্গকে ভৌগোলিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করা হোক এবং দায়িত্ব বণ্টন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ করা হোক; পাঁচ. চট্টগ্রামকে দেশের কার্যকর বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার নিমিত্তে, প্রাইভেট সেক্টরের ব্যাংক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু এবং আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর
কিছু সদর দফতর চট্টগ্রামে বিকেন্দ্রীকরণ করা হোক; ছয়. সরকারি চাকরি তথা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডকে প্রথমত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দ্বিতীয়ত দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য এবং তৃতীয়ত শুধু মেধাভিত্তিক করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক; সাত. সরকারি চাকরিতে ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে গত এক দশকে যতটুকু দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে, সেটা ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণ ও সংশোধন করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক; আট. শিক্ষাঙ্গনের প্রশাসনে মেধাশূন্যতা এবং দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হোক; নয়. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেক্টরে প্রতি বছর এক শতাংশ হারে আগামী পাঁচ বছরে পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ ও বিনিয়োগ বাড়ানো হোক; দশ. মাদরাসা শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক; এগারো. সার্বিক জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা আরো প্রত্যক্ষ ও বলিষ্ঠ করা হোক;
বারো. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে গার্মেন্ট শিল্পের ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে অন্য তিনটি সেক্টরে যথা তথ্যপ্রযুক্তি, দক্ষ মানবসম্পদ রফতানি ও পর্যটন শিল্পে, বিনিয়োগ ও বিনির্মাণ প্রচেষ্টা অধিকতর জোরদার করা হোক; তেরো. তরুণ সম্প্রদায়কে ব্যবসা-উদ্যোগমুখী এবং উদ্ভাবনী শক্তিতে শক্তিশালী করার নিমিত্তে, সাধারণ শিক্ষার প্রাধান্য কমিয়ে কারিগরি শিক্ষার প্রাধান্য বৃদ্ধি করা হোক; চৌদ্দ. পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরের বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত বা মনোনীত যথাক্রমে পাঁচটি ও দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে মনিটরিং প্রণোদনা এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হোক; সেই সাথে প্রশাসন কঠোরতর করা হোক যেন পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো-না-কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে স্থান পায়; পনেরো. ত্রিশ লাখ শহীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্তে, উপজেলা ভিত্তিক শহীদদের তালিকা তৈরি এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক; ষোলো. কৃষক ও মেহনতি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার লক্ষ্যে, দেশব্যাপী যত প্রকারের শ্রম ও শ্রমিক আছে, সেগুলোকে একটি প্রশাসনিক ছাতার নিচে আনা হোক এবং তাদের জন্য ন্যূনতম মজুরি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগের নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক;
সতেরো. সংবিধানের ৬৬ ধারার আলোকে, ‘লাভজনক’ পদে নিয়োগের প্রসঙ্গটি বাস্তবায়নের জন্য কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক; আঠারো. বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্যহীনতা দূর করার লক্ষ্যে প্রধান প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন করা হোক এবং বিগত দশ বছরে প্রতিবেশীদের সাথে স্বাক্ষরিত সব রকমের চুক্তি, সমঝোতা ও প্রটোকলের প্রেক্ষাপট ও ব্যাখ্যাসংবলিত শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক; উনিশ. দুর্নীতি হ্রাসকল্পে, জরুরি ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের যোগ্য জনবল, কাঠামো এবং দায়িত্বের পরিধি বৃদ্ধি করা হোক; বিশ. মহান মুক্তিযুদ্ধকালে গৃহীত ও চিহ্নিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে ধর্মীয় মূল্যবোধের সংমিশ্রণে, অগ্রসরমান বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক; একুশ. রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে যেন বাস্তবসম্মত নতুন রক্তপ্রবাহ চালু হয়, সেই লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও আইনানুগ পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ই-মেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা