‘ক্যাসিনো’ অভিযানের নেপথ্যে
- সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
- ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২০:০৬
দশরিক দেশে অবক্ষয় ও অনৈতিকতা প্রান্তিকতায় এসে ঠেকেছে। দুর্বৃত্তায়ন ও অপরাধপ্রবণতাও বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। শেয়ারবাজার, ব্যাংক, কয়লা, পাথর, পর্দা, বালিশ, টিন, বই, চা, চেয়ার, টেবিলসহ কোনো কিছুই এই অশুভ প্রবণতা থেকে মুক্ত নয়। সুশাসনের বিচ্যুতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার কারণে এর আওতা বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানে আবিষ্কার হয়েছে শত শত কোটি অবৈধ টাকা, ক্যাসিনো, মদ ও জুয়ার আসর। মূলত সারা দেশেই নির্বিঘেœ চলছে লুটপাট, খুন, ধর্ষণ, মদ, জুয়া, ক্যাসিনো, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধপ্রবণতা।
সঙ্গত কারণেই দুর্নীতি, অবক্ষয় ও দুর্বৃত্তায়ন রোধে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার বিষয়টি যখন আলোচনার এসেছে এবং এসব প্রতিরোধের দাবি যখন ক্রমেই জোরদার হচ্ছে, তখনই রাজধানী ঢাকার কিছু ক্যাসিনো ও ম্যাসেজ পার্লারে অভিযান চালানোর ঘটনা জনমনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আর এই অভিযান শুধুই আইওয়াশ কি না- তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। অভিযানের নেপথ্যে অন্য কিছু আড়াল করা হচ্ছে কি না- তা নিয়েও কথা উঠেছে।
সম্প্রতি অবৈধভাবে ‘ক্যাসিনো’ চালানোর অভিযোগে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানো এবং চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তার নিয়ন্ত্রিত একটি টর্চার সেলেরও নাকি সন্ধান পেয়েছে এবং সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের পীড়নযন্ত্রসহ বিভিন্ন আলামতও উদ্ধার করা হয়েছে। এমনকি তার নিয়ন্ত্রণাধীন ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়ে নারী-পুরুষসহ ১৪২ জনকে আটক করা হয়েছে। একই অভিযোগে আরো যারা গ্রেফতার হয়েছেন তারাও সরকারি ঘরানার বলেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে। এমনকি মহাজোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পাটির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেননের ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আলোচনায় এসেছে। কারণ, তিনি ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবের সদ্য বিদায়ী সভাপতি। আর তার তত্ত্বাবধানেই দীর্ঘ দিন ক্যাসিনোসহ জুয়া চলেছে এই ক্লাবে; এমনই অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। বিষয়টি সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ছিলেন না বলে দাবি করা হলেও তার দাবি কোনো মহলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না।
ক্যাসিনো সম্পর্কে এ দেশের মানুষের অতীতের ধারণা খুবই কম। মূলত এটি প্রমোদমহল বলেই পরিচিত। সেখানে চলে মৌজ-মাস্তি আর জুয়ার আড্ডা। মধুমক্ষীকার মতো ভিড় জমায় জুয়াড়িরা। প্রমোদবালাদেরও রয়েছে সরব পদচারণা। অভাব নেই খদ্দেরেরও। তারা মেতে ওঠে লাল পানির নেশায় ও উদ্দাম নৃত্যে। নেশার ঘোরে ওড়ায় কোটি কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই গড়ে উঠেছে টাকা ওড়ানোর এই নিশিপুরীর আসর। খেলার ছলে মন মজাতে ক্যাসিনোতে ভিড় করে দেশ-বিদেশের নিশিকুটুমরা।
পশ্চিমা বিশ্বেই ক্যাসিনোর প্রচলন বেশি। বিশ্বের ক্যাসিনোর তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাসভেগাসের ‘বেল্লাজিও’-এখানে সর্বোচ্চ চার হাজার থেকে আট হাজার ডলার পর্যন্ত জুয়ার বাজি ধরার সুযোগ রয়েছে। মাঝে মধ্যে বাজি ১০ লাখ ডলারও ছাড়িয়ে যায়। এ ছাড়াও চীনের ভ্যানেতিয়ানের ‘ম্যাকাও’, মোনাকোর ‘মন্টি কার্লো’, দক্ষিণ আফ্রিকার রুসতেনবার্গের ‘সান সিটি রিসোর্ট’, যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরের ‘এম্পায়ার’, জার্মানির ব্যাডেন শহরে অবস্থিত ‘ব্যাডেন ব্যাডেন’, যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমার ‘উইন স্টার ওয়ার্ল্ড’, যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটের ‘ফক্সউডস’, যুক্তরাজ্যের ‘হিপ্রোড্রোম’ ক্যাসিনো উল্লেখযোগ্য।
অতীতে ক্যাসিনোসহ জুয়া খেলা আমাদের দেশে সীমিত পরিসরে থাকলেও এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর ইউরোপ-আমেরিকা বা উন্নত বিশে^র গণ্ডিতে নয়, বরং খোদ রাজধানী ঢাকার কমপক্ষে ৬০টি স্পটে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে বলে জানা গেছে। সঙ্গত কারণেই মসজিদের নগরী ঢাকা মহানগরীকে কেউ কেউ ক্যাসিনোর নগরী হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করেছে, যা আমাদের জন্য গৌরবের নয় বরং লজ্জার। ক্যাসিনো নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলে পরস্পরবিরোধী কথা থাকলেও এ পর্যন্ত যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথেই সম্পৃক্ত। এমনকি অবৈধভাবে চালানো এসব জুয়ার আসরে ক্ষমতাসীন দলের কমপক্ষে ছয় নেতা মাঝে মধ্যে অংশগ্রহণ করতেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে, যা অস্বীকার করতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরাও।
মূলত পুরো ঢাকা মহানগরীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নামে-বেনামে অসংখ্য ক্যাসিনো। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আটটি স্থানে যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের এক শীর্ষ নেতার তত্ত্বাবধানে ক্যাসিনো ব্যবসা এত দিন চলে এসেছে। রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকায় তিনটি ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এক সাংগঠনিক সম্পাদক। মতিঝিলের ক্লাবপাড়া ছাড়াও দিলকুশা, ব্যাংক কলোনি, আরামবাগ, ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, কাকরাইল, গুলিস্তান, ওসমানী উদ্যান ও বঙ্গবাজার এলাকায় নিয়মিত জুয়ার আসর বসে। মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় অবস্থিত ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে অনানুষ্ঠানিক ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই অভিযোগ রয়েছে গুলশান লিংক রোডের ফু-ওয়াং ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, নিউ মার্কেট এলাকার এজাজ ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, পল্টনের জামাল টাওয়ারের ১৪ তলাসহ বেশ কয়েকটি নামীদামি রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে।
আমাদের দেশে ক্যাসিনো বা যেকোনো ধরনের জুয়া কখনো বৈধ ছিল না বা এখনো নয়। তারপরও তা চলে আসছে আবহমানকাল থেকেই। ১৮৬৭ সালে প্রণীত ‘বঙ্গীয় জুয়া আইন’ বাংলাদেশে এখনো প্রযোজ্য হলেও এই অপকর্মটি বন্ধ করা যায়নি। সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী, যেকোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এ রকম কোনো ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে ক্রীড়ারত (জুয়ারত) বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। পুলিশ জুয়ার সামগ্রীর খোঁজে যেকোনো সময় (বল প্রয়োগ করে হলেও) তল্লাশি চালাতে পারবে বলেও আইনে উল্লেখ রয়েছে।
সম্প্রতি নানা ইস্যুতে সরকার অনেকটাই ব্যাকফুটে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডেঙ্গু মোকাবেলায় সরকারের উপর্যুপরি ব্যর্থতা, প্রিয়া সাহার ঘটনা ইত্যাদি নানা বিষয়ে সরকার যখন কোণঠাসা, তখন রাজপথের বিরোধী দলগুলো নতুন করে আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনা করছে, ঠিক সে সময়ই ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির ঘটনা সার্বিক পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে অপসারণ, যুবলীগের নেতাকে গ্রেফতার, ক্যাসিনো বন্ধের জন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানে দৃশ্যত ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি সৃষ্টি করলেও এর নেপথ্যে বৃহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যেমন জনগণের সাথে নিজেদের দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করছে, ঠিক তেমনি বিরোধী দলের আন্দোলন পরিকল্পনাও মাঠে মারা পড়ছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনেরা অনেকটাই সফল।
ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ক্যাসিনো ও জুয়ার সাথে জড়িতদের আগের রাজনৈতিক পরিচয়ের কথা বলে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে থলের বিড়াল ততই বেরিয়ে পড়ছে। শীর্ষ সাত যুবলীগ নেতাসহ ঢাকায় ৬০টি ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক ২৫ জনের নাম বলেছেন রিমান্ডে থাকা ঢাকা মহানগর যুবলীগের (দক্ষিণ) সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁঁইয়া। এদের মধ্যে কেউ কেউ ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে জড়িত বলে জানা গেছে। জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। সুতরাং সরকারের ক্যাসিনো অভিযানের নেপথ্যকথা যে ভিন্নতর সে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয় বরং ক্রমেই তা জোরালো ভিত্তি পাচ্ছে।
smmjoy@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা