ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় জোরালো ভূমিকা কই?
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ২০ আগস্ট ২০১৯, ১৭:০৫
মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু এবার বাংলাদেশে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এর দাপট কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। দেশের প্রায় সব জেলায় একযোগে ছড়িয়ে পড়েছে ক্রমেই অধিকতর তীব্রতা নিয়ে বিস্তৃত হচ্ছে প্রাণঘাতী রোগটি। বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রথম দেখা দেয় ২০০০ সালে। সে সময় এই রোগে মারা যান ৯৩ জন। তিন বছর পর থেকে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার কমতে থাকে এবং কয়েক বছরে এতে মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। সম্প্রতি সেটা আবার বাড়ছে।
চলতি বছর দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে সর্বমোট ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫৩ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৪৫ হাজার ৯৭৪ জন। গত শনিবার পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন সাত হাজার ১৬৮ জন। ঈদের পরবর্তী তিন দিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমেছিল বলে সরকারি হিসাবে জানানো হয়। কিন্তু তা আবারো বেড়েছে। গত রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৭০৬ জন মানুষ ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশনস অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম জানায়।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীতে সয়লাব। প্রতিদিনই আসছে নতুন নতুন রোগী। তাদের জায়গা দিতে অন্য রোগীদের সরিয়ে নিতে হচ্ছে ওয়ার্ডের বাইরে, বারান্দায় ও করিডোরে। কিন্তু একটি জরুরি পরিস্থিতি সামাল দিতে যে ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ আয়োজন ও সক্রিয়তা দরকার, তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। রাজধানীতে দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমে অনেকটাই ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। তারা নতুন ওষুধ এনেছেন, সেগুলো ইচ্ছামতো ছিটাচ্ছেন, কখনো কোনো নাগরিকের বাড়িতে হানা দিয়ে ডেঙ্গুর লার্ভা পেয়ে জরিমানা করছেন এবং আত্মতৃপ্তিতে ভুগছেন এ কথা ভেবে যে, ‘অনেক কাজ করা হলো।’ কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে গত শনিবারের চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনের ভাষ্য ছিল এ রকম : ‘সরেজমিন ঢাকা সিটির বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশন যা বলছে, মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন নেই বললেই চলে। মাঠপর্যায়ে মশা নিধন কার্যক্রম একেবারেই দুর্বল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকঢোল পিটিয়ে শুধু সচেতনতা সৃষ্টি করলে হবে না, মশা নিধন কার্যক্রম জোরালোভাবে চালাতে হবে। কারণ মশা না কামড়ালে ডেঙ্গু হবে না। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, মশা মারার কোনো বিকল্প নেই। প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ জানান, এডিস মশার প্রজনন ধ্বংস না হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ থামবে না।’ মাঠপর্যায়ে মশা নিধন কার্যক্রম কতটা সফল হচ্ছে তা নিয়মিত সমীক্ষা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এডিস মশার ব্যাপারে জনগণ যতটা সচেতন, সিটি করপোরেশন ততটা নয়। এ কারণে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। মশা নিধনের কর্মসূচি ভালোভাবে না চালালে আমরা যতই স্লোগান বা বাহ্বা দিই না কেন, কাজের কাজ কিছুই হবে না। মশা নিধন না হলে সার্বিক ফলাফল হবে শূন্য।’
একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘উড়ন্ত মশা মারতে হলে ফজরের ওয়াক্ত থেকে কাজ শুরু করতে হবে। কারণ, মশা ওড়ে সূর্যোদয়ের পরপরই আর ঠিক গোধূলিলগ্নে সূর্যাস্তের আগে আগে। অন্য সময় ওষুধ ছিটালে কাজ হবে না।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রধান কীটতত্ত্ববিদ ডা: ভূপেন্দর নাগপালের বরাত দিয়ে একটি সহযোগী দৈনিকে বলা হয়েছে, দুই সিটি করপোরেশন এযাবৎ এডিস মশার প্রজননপ্রবণ এলাকা হিসেবে যেসব স্থান চিহ্নিত করে এসেছে, ৪০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ওই আন্তর্জাতিক কীটতত্ত্ববিদের তথ্যের সাথে তা মেলেনি। তিনি এডিস মশার বৈশিষ্ট্য নিয়েও বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। এত দিন ধারণা করা হতো, এডিস মশা বাসাবাড়ি ও আশপাশে জমে থাকা পানিতে বেশি থাকে। কিন্তু ভূপেন্দর নাগপাল জানালেন, এডিস মশা সবচেয়ে বেশি থাকে সরকারি পরিবহন পুলে। থানায় থানায় জব্দ করা গাড়ির স্তূপে। এসব জায়গায় সারি সারি গাড়ি, টায়ার ও পরিত্যক্ত টিউবসহ যন্ত্রপাতিতে এডিসের লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। এর পরপরই এডিস থাকে হাসপাতালের নিচে খোলা জায়গায়, ছাদে, পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রে। এ ছাড়া বিমানবন্দরের চৌবাচ্চা ও রানওয়ের আশপাশ, পার্ক, নার্সারি, ফোয়ারা, সরকারি-বেসরকারি নির্মাণাধীন ভবনে। সরকারি অফিসগুলোর ছাদও এডিসের বিস্তার ঘটানোর ‘উৎকৃষ্ট’ জায়গা। এ ছাড়া বাসাবাড়ির গ্যারেজ, বাড়ির মূল ফটকের লোহার গেটের ফাঁক, পরিত্যক্ত কমোড, বিদ্যুতের তার আটকানোর সরঞ্জামাদিতে মশা ডিম পাড়ে। ভূপেন্দর নাগপাল বলেছেন, মশা মারার সাথে সাথে লার্ভা ধ্বংসে মন দিতে হবে। কিন্তু আমাদের মশক নিধন কার্যক্রমে এসব পরামর্শ কতটা গ্রহণ করা এবং সে অনুযায়ী বাস্তব কর্মকৌশল নেয়া হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, গত ১০ আগস্ট থেকে মশা মারার নতুন ওষুধ দেয়া শুরু হয়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মশা নিধন এই দুটো বিষয়কে সমন্বিত করেই সিটি করপোরেশন কাজ করছে।
সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা বলেন, জুন-জুলাই-আগস্ট এ তিন মাস ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। অক্টোবরে কমে যায়। তিনি বলেন, ডেঙ্গু থেকে রেহাই পেতে মশা নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে। তিনি বলেন, আগামী সাতটা দিন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। আবহাওয়া আমাদের অনুকূলে নয়। আমরা যদি এডিসের দুর্গে আঘাত হানতে না পারি, তাহলে পরিস্থিতি কী হবে, বলা মুশকিল। স্পষ্টতই ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে আমাদের জাতীয় কার্যক্রম যে আশাব্যঞ্জক নয়, তারই প্রতিফলন ঘটেছে তার বক্তব্যে। সুতরাং ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগামী সপ্তাহের পর আরো তীব্রতা পেলে হয়তো অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এরই মধ্যে এই রোগে সারা দেশে সরকারি হিসাবে ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যদিও বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটা ১০০ ছুঁই ছুঁই।
এবারের ডেঙ্গুর বৈশিষ্ট্যও আগের চেয়ে ভয়াবহ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) জানাচ্ছে, এবার ডেঙ্গুর শক সিনড্রোমে বেশি মৃত্যু হচ্ছে। এ পর্যন্ত যে ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের ২৭ জনেরই শক সিনড্রোম ছিল। শক সিনড্রোমের লক্ষণ হলো রক্তক্ষরণ ও শরীরে পানিশূন্যতার কারণে রোগী অচেতন হয়ে পড়া। মৃতদের মধ্যে ছয়জনের ছিল ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর। এতে রোগীর শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়।
কেন রোগীদের মধ্যে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যাচ্ছে, তা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন বা সেরোটাইপ আছে : ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪। আইইডিসিআর বলছে, এবার ডেঙ্গু ভাইরাস ডেনভি-৩এর প্রকোপ বেশি। এর উপসর্গ ও জটিলতা অনেক বেশি মারাত্মক। চিকিৎসকেরা বলছেন, জ্বর না কমা বা অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকা, বমি হওয়া, পেটে তীব্র ব্যথা, রক্তক্ষরণ, মাথা ধরা, চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া, ৪-৬ ঘণ্টা প্রস্রাব না হওয়া বা কম হওয়া, খুব বেশি দুর্বল হয়ে পড়া, নিদ্রাহীনতা ও আচরণের আকস্মিক পরিবর্তন ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ। ডেঙ্গু জ্বরে বুকে-পেটে পানি জমে, ফুসফুসে পানি জমে শ্বাসকষ্ট হয়। প্রথম থেকে ঠিকমতো চিকিৎসা করালে এবং সঠিক পরিমাপে তরল পদার্থ দিতে পারলে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করে না।
অন্তঃসত্ত্বা, বৃদ্ধ, শিশু, সদ্যোজাত এবং ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, লিভার ও কিডনির রোগীরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাদের চিকিৎসায় বিশেষ নজর দিতে হবে বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ একটি দৈনিককে বলেন, এবার কিছু রোগীর অবস্থা খুব দ্রুতই খারাপ হতে দেখা যাচ্ছে। এর একটা কারণ হয়তো এই যে, এবার সম্ভবত ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি।
গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও গত ছয় মাসে সরকার তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে পারেনি।
ক্ষমতাসীন দল ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক স্বীকার করে গত জুলাই মাসে তিন দিনের পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। ওই তিন দিন দৈনিক এক ঘণ্টা করে কর্মীদের পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়। তারা ঝাঁটা হাতে ক্যামেরায় পোজ দিয়ে জাতিকে ধন্য করেছেন।
এখন সামনের একটি মাস এভাবে পেরিয়ে গেলে সম্ভবত ডেঙ্গুর মওসুম আপনাআপনিই শেষ হয়ে আসবে। তখন কারোই আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ থাকবে না। তবে এটি সরকারের নিষ্ক্রিয়তার একটি বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা