মেয়েটির অবিশ্বাস্য স্বীকারোক্তি ও এনজিওর নিষ্ক্রিয়তা
- মইনুল হোসেন
- ২৪ জুলাই ২০১৯, ২০:১৮
তদন্তাধীন মামলার বিচারপ্রক্রিয়া পুরোপুরি পুলিশি বিষয় নয় যে, পুলিশকে সংবাদ সম্মেলন ডেকে মামলাবিশেষের গুণাগুণ তুলে ধরতে হবে। অভিযুক্তদের কাকে কাকে গ্রেফতার করা হলো, ফৌজদারি মামলায় সেটি জানার আগ্রহ থাকতে পারে সাধারণ মানুষের। কিন্তু সুবিচারের স্বার্থে অপরাধ সম্পর্কে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী সংবাদ সম্মেলন ডেকে ফাঁস করে উৎসাহ দেয়াটা মোটেই সমীচীন হতে পারে না। পুলিশের হেফাজতে আটক থাকা অবস্থায় আসামির আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায় করাটা কেবল বিপজ্জনকই নয়, সংবিধান বা শাসনতন্ত্রেরও লঙ্ঘন। দেখা যাচ্ছে, আমাদের আদালতগুলো বিচারপ্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে যতটা উদার, অভিযুক্তের স্বাধীনতা ও সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় ততটাই সঙ্কীর্ণ।
আমাদের পুলিশের কাছ থেকে এখনো আমরা প্রত্যাশা করি যে, তারা আইন ও সুবিচারের দাবিকে বিবেচনায় রেখে দায়িত্ব পালন করবেন। কারণ এখনো তারা একটা গণতান্ত্রিক সংবিধানের অধীনে থেকেই কাজ করছেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর সত্যতা বিচারিক আদালতের মাধ্যমেই কেবল প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আদায় করা স্বীকারোক্তি প্রদান করা, যদিও একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী লেখা হয়, বিষয়টি এ দেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিবেচ্য বিষয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তারা নীরবতা অবলম্বন করে চলেছেন। একজন নারীকে অসহায়ভাবে পুলিশের হেফাজতে পাঠানো এবং পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করানোর বিষয়টি নারী অধিকার নিয়ে বড় বড় কথা বলতে অভ্যস্ত সংস্থাগুলোর কাছে ঘোরতর আপত্তির বিষয় হওয়ার দাবি রাখে।
এ ব্যাপারে সত্য হচ্ছে, আমাদের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বেশির ভাগের কার্যক্রম পরিচালিত হয় বিদেশী অর্থ ও উৎসাহে। মনে হচ্ছে, তারা আগে দেখেন তাদের নিজেদের নিরাপত্তা। সরকারের মতিগতি বুঝে তারা মানবাধিকার কিংবা নারী অধিকার নিয়ে লম্বা লম্বা কথা বলে থাকেন। এ রকম অনেক মানবাধিকার সংস্থা কার্যত মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথকে সহজ করে দিয়েছে। ভোটাধিকার নিয়ে এসব সংস্থার বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই। অথচ ভোটাধিকার না থাকলে মানবাধিকারও নিরাপদ থাকে না। আমাদের এমন এক সঙ্কটজনক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে, যেখানে রাজনীতিই কেবল ভালো ব্যবসা নয়, অনেক মানবাধিকার সংগঠনও চমৎকার ব্যবসা করে যাচ্ছে।
আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় বরগুনার একটি আদালত তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে পাঁচ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। মিন্নি বরগুনা সরকারি ডিগ্রি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালতে এই রিমান্ড প্রার্থনা করেন।
গত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সঙ্ঘটিত রিফাত হত্যা মামলার প্রধান প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হচ্ছে মিন্নি। রিফাত শরীফ ২৫ বছর বয়সী একজন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, যাকে একদল যুবক সঙ্ঘবদ্ধভাবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে। ঘটনার একটা ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে দেখা যায় মিন্নি তার স্বামীকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। অন্যেরা ভয়ে মেয়েটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। তারা যে অসহায় দর্শকের ভূমিকায় ছিল, তা-ও টেলিভিশনের পর্দায় পরিস্ফুট হয়েছে। দুর্বৃত্তদের কর্মকাণ্ড সমাজকে কত অসহায় করেছে, ভাবতেও কষ্ট হয়।
মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, তার মেয়ে পুলিশের একটানা ১১ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তিনি আদালতে তার মেয়ের জামিন প্রার্থনা করে বৃহস্পতিবার আবেদন করেন। কিন্তু তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা হুমায়ুন তার দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেন, মিন্নিকে গ্রেফতার করা হয়েছে; কারণ, এই হত্যা মামলায় পুলিশ তার সম্পৃক্ততা পেয়েছে। এত সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকতে পুলিশের তত্ত্বাবধানে নিয়ে মিন্নির কাছ থেকে একাকী অবিশ^াস্য ও বিতর্কিত স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রয়োজন ছিল না। এখনো আমাদের পাবলিক সার্ভেন্টরা মনে করেন, তারা সরকারের অনুগত চাকর। নিজেদের ব্যক্তিত্বহীন, অস্তিত্বহীন করতে অসুবিধা হয় না। উপর থেকে যা বলা হবে, তাই করতে হবে। আইন প্রয়োগকারীদের এ ধরনের ভাবমর্যাদা সুবিচারের ক্ষেত্রে মোটেও কাম্য নয়।
প্রকৃত ঘটনা যা-ই হোক না কেন, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে মিন্নির সম্পৃক্ততা আছে কি নেই, সে দোষী না নির্দোষ, সে বিতর্ক বিচারের জন্য তোলা থাক। কোর্ট তাকে জামিনে মুক্তি দিয়ে কিছুটা সমবেদনা দেখাতে পারতেন। জামিনের ব্যাপারে মেয়েদের প্রতি সদয় হতে আইনেরও বাধ্যবাধকতা আছে। সবাই মিলে নিষ্ঠুরতাকে প্রশ্রয় দেবো... তা সভ্য লোকদের আচরণ হতে পারে না। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, পুলিশের ‘রিমান্ড সংস্কৃতি’ বন্ধ হতে হবে। আইনজীবীদের এড়িয়ে নাগরিকদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায় করার এই অমানবিক পদ্ধতির অবশ্যই অবসান হওয়া দরকার।
মামলার বাদি এবং নিহত রিফাতের পিতা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ অবিলম্বে মিন্নিকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, এই হত্যাকাণ্ডে মিন্নির হাত আছে। তিনি আরো দাবি করেন, মিন্নি তার ছেলেকে বিয়ে করার আগে তার ছেলের অন্যতম হত্যাকারী সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডের সাথে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তার পরিবার এ বিষয়টি গোপন রাখে। জনাব হালিম এসব কথা সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেছেন।
বিয়ের ইতি টানার জন্য স্থানীয় খুনি চক্রের সাথে হাত মিলিয়ে মিন্নি খুন-খারাবির মতো ভয়ঙ্কর খেলায় অংশ নিয়েছিলÑ এমন কথা বলার মধ্যে কোনো বিচার-বিবেচনার গন্ধ মেলে না। শান্তিপূর্ণভাবেই সে তার স্বামীকে দিয়েই বিয়ের বিচ্ছেদের জন্য চাপ দিতে পারত। তাই অনুগ্রহ করে গোটা সমাজকে বোকা বানাবেন না, এভাবে সভ্য সমাজের বিনাশ ঘটাবেন না। আমাদের নিবেদন, রাজনীতির কারণে বিচারব্যবস্থাকে ক্ষমতাসীনদের কুক্ষিগত কোনো প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন না। বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা সর্বতোভাবে ধ্বংস করবেন না।
রিফাত শরীফের হত্যাকাণ্ডের সাথে শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তির সম্পৃক্ততা রয়েছে, এ কথা অনস্বীকার্য। আমরা এটাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে আজ যারা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তাদেরও আইনের আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন হবে, কিন্তু তখন পরিচ্ছন্ন বিচারব্যবস্থার অস্তিত্ব হয়তো থাকবে না। ক্ষমতার অন্ধত্ব অনেককেই বুঝতে দিচ্ছে না যে, আইনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির ভয়াবহ পরিণাম তাদেরও মোকাবেলা করতে হবে। অশুভ শক্তির প্রশ্রয় দান সবার জন্যই বিপজ্জনক।
সরকারদলীয় ‘বাহিনী’র লোকেরা এমন সন্ত্রাসী অবস্থার সৃষ্টি করছে যে, স্বামীহারা মিন্নির পক্ষে স্থানীয় আইনজীবীরা দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছেন না। শেষ পর্যন্ত ঢাকা থেকে আইনজীবীরা মিন্নির পক্ষে তাকে আইনি সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছেন। তাদের মোবারকবাদ জানাই।
আইনি সাহায্য পাওয়া যেকোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির শাসনতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার। স্বাধীন দেশের সরকার পর্যন্ত এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। মানুষের জীবনের মূল্য বেশি, না দুর্বৃত্তদের রক্ষা করা বেশি জরুরি, সরকারকে এটাও ভাবতে হবে।
বহু দিন ধরেই আমরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে আসছি হত্যা, খুন ও গুমের রাজনীতি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নেতৃত্বের দূরদর্শিতা থাকলে জনগণকে অসহায় রাখার কথা ভাবা যেত না। স্থানীয় ক্ষমতাসীন নেতারা ও পুলিশ মিলে একে অপরের যোগসাজশে নিজেদের এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। এরকম অবস্থায় অসহায় নারী ও শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। শিশুদের গলাকাটা লাশ পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশও সত্য-মিথ্যা মামলা দিয়ে যাচ্ছে। আইন ও বিচারব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা অক্ষুণœ না থাকায় পুলিশও জনগণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। জনগণ আইন হাতে নিয়ে গণপিটুনির ‘বিচার’ করতে নেমে গেছে।
কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি গা বাঁচিয়ে, সরকারের ভ্রান্ত রাজনীতিকে দোষারোপ না করে সমাজকেই দোষ দিচ্ছেন। সমাজে মূল্যবোধের অভাব, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি ঘটেছে বলছেন। আসলে স্বৈরশাসনে নীতি-মূল্যবোধের রাজনীতি না থাকায় রাজনীতির কারণেই সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে।
মানুষের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হলে নীতি-আদর্শহীন বা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের রাজনীতির অবসান ঘটাতে হবে। সঙ্কটের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া জনবিচ্ছিন্ন সরকারের পক্ষে বিপন্ন জাতিকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। সে পথ তাদের জানাও নেই। বাংলাদেশকে রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীর সুবিধাবাদী বিশ্বাসঘাতক চরিত্রের কথা ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত। তবুও দেশকে বিপন্মুক্ত করতে এগিয়ে আসতে হবে দেশপ্রেমিক শিক্ষিত সমাজকেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা