১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩ মাঘ ১৪৩১, ১৬ রজব ১৪৪৬
`

সরকারের বিরাট পরীক্ষা প্রিয়া সাহা ইস্যু

-

প্রিয়া সাহা অন্তত একটা ভালো কাজ করেছেন যে, বাংলাদেশের হিন্দু রাজনীতিতে প্রমাণিত-অপ্রমাণিত যেসব উদ্ভট তথ্যের ওপর এত দিন দাঁড়ানো ছিল, আর যা নিজেকে ভিকটিম হিসেবে দাঁড় করিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ থাকত- এমন যেসব বয়ান দীর্ঘ যুগ ধরে চালু আছে, তা এবার সরাসরি পাবলিক ডোমেনে সবার নজরে চলে এসেছে। আর তাতে সেসব বয়ান এক বিরাট সামাজিক আতশি কাচের নিচে এসে পড়েছে। ফলে এবার আম-পাবলিকের সামনে আসল যাচাই-বাছাইয়ে তাকে নিজেকে প্রমাণ করতে পারতেই হবে, না হলে চিরতরে এসব বয়ানসহ বিদায় হওয়ার অবস্থা এসে গেছে।

প্রিয়া সাহা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সামনে যা বলেছিলেন তা তিনি আরো অন্তত ৭২ ঘণ্টা পরে ঠাণ্ডা মাথায় আবার হাজির করার সুযোগ পেয়েছেন ও নিয়েছেন। বিডিনিউজ২৪ সেই ভিডিও বয়ান সংগ্রহ করে ট্রান্সস্ক্রিপ্ট ছাপিয়েছে, আমি সেই ছাপানো রিপোর্ট ধরে কথা বলছি। বিডিনিউজ২৪ লিখেছে, ‘প্রিয়া সাহা বলেন, সরকারের আদমশুমারি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী- দেশভাগের সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যার ২৯.৭ শতাংশ ছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিক। ওই হার এখন নেমে এসেছে ৯.৭ শতাংশে।’ এ ছাড়া আরো বলেন, ‘এখন দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৮০ মিলিয়ন। সংখ্যালঘু জনসংখ্যা যদি একই হারে বৃদ্ধি পেত, তাহলে অবশ্যই যে জনসংখ্যা আছে, এবং যে জনসংখ্যার কথা আমি বলেছি ‘ক্রমাগত হারিয়ে গেছে’, সেই তথ্যটা মিলে যায়।’

এখানে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ‘দেশভাগের সময়’ আর ‘যদি’ একই হারে বৃদ্ধি পেত। এককথায় বললে, প্রিয়া সাহা ‘যদি’ এর কথা বলছেন। মানে বাস্তবের জনসংখ্যা না, হাইপথিটিক্যাল ধরে নেয়া। অনেকটা দেশের এক একর জমিতে যদি ১০টা গরু গুনে পাওয়া যায় তাহলে দেশের মোট ১৪৭ হাজার বর্গকিমি ভূমিতে ঐকিক নিয়মে ফেলে গরুর সংখ্যা বের করে ফেলার মতো।

যে বই থেকে প্রিয়া এই তথ্য নিয়েছেন সে বইয়ের লেখক আবুল বারাকাত প্রিয়ার বক্তব্যের দায় না নিতে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন প্রিয়া ‘তথ্য-উপাত্ত বিকৃতভাবে উপস্থাপন’ করেছেন। হ্যাঁ, তথ্যের দিক থেকে তিনি তা বলতেই পারেন। যেমন- প্রিয়া দাবি করেছেন, ওই ২৯.৭ শতাংশ নাকি দেশভাগের সময়ের হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত। বারাকাত বলছেন, তার বইয়ে সেটা বলা আছে আসলে ১৯৬৪ সালের, প্রায় ১৭ বছর পরের। এটা বিরাট ভুল রেফারেন্স অবশ্যই। কিন্তু বারাকাত যে পদ্ধতিতে হিসাব করে কথা বলেছেন, প্রিয়া কিন্তু আসলে সে পদ্ধতিটাই অনুসরণ করেছেন।

এক স্বামী বাজারের ভেতর দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বড় বড় কৈ মাছ দেখে এসেছেন। বাড়ি ফিরে তা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আদুরে গলায় গল্প আলাপ শুরু হয়েছিল, এক ‘যদি’র ওপরে। ‘যদি’ স্বামী বড় কৈ মাছ বাসায় আনতেন, সেখান থেকে স্ত্রী কত পদে কিভাবে তা রান্না করতেন সে আলাপ করতে যেয়ে স্ত্রীর আরো আহ্লাদ করতে ইচ্ছা করাতে তিনি বলে বসেন, ‘আমি ওই মাছ খেতাম না’। এতে স্বামী অগ্নিমূর্তি হয়ে বউ পেটানো শুরু করেছিলেন। তো মাছ বাজার থেকে বাসায় ঢোকার ব্যাপারটাই হাইপথিটিক্যাল থেকে গেলেও বাসায় বউ পিটানি ছিল কিন্তু জেনুইন। প্রিয়া-বারাকাতদের কাণ্ডটা প্রায় সেরকম।

এই তথ্যের গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক দিক হলো, সরকারের পরিসংখ্যান দেখিয়েছে- হিন্দু জনসংখ্যাও নয়, বরং হিন্দু জনসংখ্যার (অন্যান্য ধর্মের তুলনায়) অনুপাত কমেছে। সরকারি পরিসংখ্যান থেকে ড. আবুল বারাকাত এতটুকুই জানছেন যে, অনুপাতে ‘কমেছে’, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু এ থেকে তিনি সিদ্ধান্তে গিয়ে ‘কমেছে’ আর না লিখে এর বদলে লিখছেন, যদি একই অনুপাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ধরা হয়, তাহলে ‘আনুমানিক ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ নিরুদিষ্ট হয়েছেন।’

এটা কোনো একাডেমিকের কাজ হতে পারে না। যেহেতু বাক্যটা ‘যদি’র ওপর দাঁড়ানো, তাই তাকে লিখতে হতো- নিরুদিষ্ট ‘হয়েছেন’ না, নিরুদিষ্ট ‘হতো’। পরিসংখ্যানে জনসংখ্যা কম দেখতে পাওয়া মানেই কি তাদের ‘নিরুদ্দিষ্ট’ হওয়া? কিসের ভিত্তিতে বারাকাত এই দাবি করছেন? আমাদের সরকারি পরিসংখ্যান ব্যাখ্যা করে বিবিসি বাংলায় ছাপা রিপোর্টে দেখেছি, ব্রিটিশ আমলেও হিন্দু জন্মহারের অনুপাত কখনো কখনো কমে গিয়েছিল। ফলে ড. আবুল বারাকাতের এই ‘নিরুদ্দিষ্ট’ শব্দ ব্যবহার খুবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

বারাকাতের ‘নিরুদ্দিষ্ট’ শব্দটিকে প্রিয়া ইংরেজি করেছেন ‘ডিজঅ্যাপিয়ার’, মানে যাকে আমরা ‘গুম হওয়া’ বলি। কিন্তু গুম শব্দটি হিউম্যান রাইটস্-এ খুব সিরিয়াস শব্দ। নিজেকে মানবাধিকার কর্মী দাবি করা প্রিয়া সাহার এই ‘ডিজঅ্যাপিয়ার’ শব্দ ব্যবহার করা একটা ক্রিমিনাল কাজ হয়েছে। মানে তিনি বলতে চাইছেন, হাসিনা সরকারসহ বাংলাদেশের সরকারগুলো ৩.৭ কোটি হিন্দু লোককে গুম করে ফেলেছে! অথচ কথাটা সিম্পলি তিনি বলতে পারতেন, তারা দেশ ছেড়ে গেছে, ‘ভারতে’ যদি নাও বলতে চান!

ড. আবুল বারাকাতও এই অভিযোগের বাইরে নন। তিনি সরকারি পরিসংখ্যান বইয়ে জনসংখ্যা কম দেখতে পেয়েছেন, এর মানে কি তিনি একে ‘নিরুদ্দিষ্ট’ হওয়া বলে দাবি করতে পারেন? ফলে শব্দের আসল ‘উসকানি’ তো তিনিই দিয়েছেন। বাংলাদেশের হিন্দু রাজনীতিতে প্রমাণিত-অপ্রমাণিত যেসব তথ্যের বয়ান আছে, এই বয়ানদাতারা যেন তার কথাটা লুফে নেন, সে কাজই তিনি করেছেন। হাতে হাতে ফলও পেয়েছেন। নিশ্চয়ই বিজেপি-আরএসএস এমন বই ও তথ্য হাজার হাজার কপি বিলির জন্য ছেপে নিয়েছে। তাই ড. আবুল বারাকাত খুবই সফল বিরাট ‘অর্থনীতিবিদ’ বলতেই হয়।

আজকের বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান তিন দেশের জন্যই ১৯৪৭ সালের দেশভাগ-পরবর্তী সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সবাইকে এক উথালপাথাল সময়ের ভেতরে যেতে হয়েছে। কেন?

মূল কারণ, ব্যাপক মাইগ্রেশন বা পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশান্তর ঘটেছিল এ তিন দেশেই, যা কোনো সুখকর স্মৃতি নয়। আর এটা কেবল যে বাংলাদেশ থেকেই হিন্দুরা দেশত্যাগ করে ভারতে গেছে তা একেবারেই নয়; বরং তিনটি দেশ থেকেই কোথাও একমুখী নয়, উভয়মুখী দেশান্তর ঘটেছিল। কেবল বাংলাদেশের কথাই যদি তুলি, তবে বলা যায়- হিন্দুদের দেশান্তর হয়ে ভারতে যাওয়ার পাশাপাশি সেখান থেকে বিপুলসংখ্যক মুসলমান জনগোষ্ঠী নিরাপদ জীবনযাপনের আশায় বাংলাদেশে চলে এসেছিল। সাধারণভাবে সমগ্র সীমান্ত এলাকাজুড়েই এটা ঘটেছিল। বিশেষ করে এখনকার সাতক্ষীরা, বাগেরহাট আর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাগুলোতে অনেক বেশি করে। এ ছাড়া আরো আছে। বিহার থেকে আমাদের দিনাজপুর কাছে বলে ব্যাপকসংখ্যক মুসলমান-বিহারি এসেছিল, যাদেরকে পুনর্বাসিত করতেই আমাদের সৈয়দপুরের জন্ম। তবে যেসব বিহারি অনেক আগেই বিহার ছেড়ে রাজধানী কলকাতায় কাজ করত, ১৯৪৭ সালে এদের অনেকে আবার সেখান থেকে সরাসরি ঢাকায় চলে এসেছিল।

এখন প্রিয়া-বারাকাতদের মতে, ভারতের এই মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ভারতের পরিসংখ্যানে কি নিরুদ্দিষ্ট বা ডিজঅ্যাপিয়ার্ড বলা হচ্ছে? না, এটা বলবে? ভারতের কেউ কি তাদেরকে ‘নিরুদ্দিষ্ট’ বলে দাবি করবে আর কোনো এক প্রিয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে গিয়ে আরো ৩.৭ কোটি মুসলমান ডিজঅ্যাপিয়ার্ড বলে নালিশ দেবে? আর এতে নিশ্চয়ই প্রিয়া, বারাকাত এমনকি খোদ মোদি বা আরএসএস খুবই খুশি হবে!

অনেকে প্রায়ই লুজ-টকের মতো করে বলে থাকেন, ১৯৪৭ সালের ‘দেশভাগ ভুল’। বিশেষত এটা নাকি ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে করা হয়েছে, তাই। মূলত এগুলো হলো জমিদারদের স্বার্থের কথা। আর জমিদার মানে, ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশরা যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারি ভূমি মালিকানা ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। অবিভক্ত সেই বাংলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলতে জমিদারি মালিকানা ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাকেই বুঝাত, যা আবার ছিল কলোনি শাসকের স্বার্থের অধীনে। এই জমিদারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল বর্ণহিন্দু জমিদার। এতে অবিভক্ত সারা বাংলা মানে হয়ে যায় একচেটিয়াভাবে এই জমিদার শ্রেণীর রাজত্ব ও কর্তৃত্ব। এ ছাড়া বাংলা ভাষা, বাঙালি বলে ‘জাতি’ ও সংস্কৃতিগত ধারণা, বাঙালির শহর, বাঙালির আধুনিকতা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ওই সময়েই এবং তা জমিদার শ্রেণীর ঔরসে, পৃষ্ঠপোষকতায় ও স্বার্থে। বলা বাহুল্য, বাঙালি বিষয়ক এসব ধারণা তৈরি হয়েছিল ও আকার পেয়েছিল এই অনুমানে যে, বাংলার মুসলমানেরা বাঙালিই নয়, সুতরাং ‘এক্সক্লুডেড’। তাই জমিদারদের ‘বাঙালি’ ধারণায় কোথাও মুসলমানদের গোনায় ধরার দরকারই মনে করা হয়নি।

এসবেরই সার ফলাফল হলো, সারা বাংলাতেই সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ইত্যাদি সব কিছুতে ছিল জমিদার হিন্দুর আধিপত্য। এতে সমাজে যে মুসলমান, তাকে মার্জিনাল করে কোণায় ফেলে রাখাই রেওয়াজ হয়ে যায়। আবার মুসলমান প্রজার জায়গায় হিন্দু প্রজার বেলায় দেখা যেত ট্রিটমেন্ট আলাদা এবং তুলনায় ভালো। যেমন জমিদারের বাড়িতে জায়গা থাকত আলাদা। বসার জায়গায় পাটি পাতা থাকত তাদের জন্য; মুসলমানদের মতো খোলা মাটিতে তাদের বসতে হতো না। আর এর ফলে হিন্দু প্রজারা মুসলমান প্রজার চেয়ে উন্নত সামাজিকভাবে, ওপরে এই ভাবটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এই স্ট্যাটাসের কারণ তারা অন্তত সাংস্কৃতিকভাবে বর্ণহিন্দু জমিদারদের সাথে এক ছাঁচে লীন হয়ে যাওয়া অনুভব করত। আবার যেমন, এমনকি বিশ শতকে এসেও ‘শেখ মুজিবের আত্মজীবনী’ বইতে যে সামাজিক বৈষম্য দেখি, সেটা তখনো খুবই প্রখর, মার্জিনালাইজড মুসলমানের এক মফস্বল শহরের। তবে একটা কাউন্টার ফ্যাক্ট ছিল সব সময় যে, পূর্ববঙ্গে মুসলমানরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।

পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের দৃষ্টিতে দেখলে, এ কারণেই ১৯০৫ কিংবা ১৯৪৭ সালে তাদের কাছে বাংলার বিভক্তি জাত আলাদা প্রদেশ, তা খুবই কাম্য ছিল। এর ঠিক উল্টোটা হলো, ১৯০৫ সালের বিভক্তি থেকেই জমিদার হিন্দুদের চরম নাখোশ হওয়া। এর মূল কারণ পূর্ববঙ্গের ওপর কর্তৃত্ব হাতছাড়া হওয়ার ভয়। ব্রিটিশরা মুসলমানদের একটু স্বস্তি দেয়ার জন্য পূর্ববঙ্গকে আলাদা প্রদেশ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েছিল। জমিদারের কায়েমি স্বার্থের কাছে এটা অসহ্য লেগেছিল। কারণ, মুসলমানরা হাতছুট হয়ে যায় কি না। তার মানে এটা উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন নয়। এটা মূলত জমিদার কায়েমি স্বার্থের বাইরে মুসলমানদের একটু হাতছুট হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন। অথচ এটাই নাকি ‘স্বদেশী আন্দোলন’। বাংলাদেশের আম মুসলমানদের কাছে এখনো এর কোনো আবেদন নেই। অবশ্য এডুকেটেড মুসলমান ‘প্রগতিবাদী বুঝ’ থেকে অনেক সময়ে একে খুব বিরাট ঘটনা মনে করতে চায়।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, পূর্ববঙ্গের মুসলমান প্রজাদের কাছে ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ ছিল সেই টুলস, যা দিয়ে সে জমিদার উচ্ছেদ করে জমি পাওয়ার আন্দোলন বাস্তব করতে পারে। এটাই পাকিস্তান আন্দোলনের গূঢ়ার্থ। বাইরে থেকে এটাকে ইসলাম কায়েম, মুসলমানরা দেশ পেয়েছে, ‘এটা মুসলিম জাতীয়তাবাদ কিংবা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়ে ফলে এটা নষ্ট, ইত্যাদি যাই বলা হোক না কেন, সারকথা ছিল জমিদারি উচ্ছেদ করে দেয়ার বাস্তব ক্ষমতা তারা হাতে পেয়ে যায়। তাই, ‘এস্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনেন্সি অ্যাক্ট ১৯৫০’- যেটা পাস হয়েছিল ১৬ মে ১৯৫১ তারিখে, এটাই পাকিস্তান আন্দোলনের ফলস্বরূপ সবচেয়ে সেই ‘বিপ্লবী ঘটনা’।

এই আইনের বলে জমিদারি পূর্ববঙ্গ থেকে উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। এতে অ্যাকুইজিশন মানে হলো বাংলাদেশের সব জমি রাষ্ট্র অধিকার করে নিলো। তাই এটাই জমিদারি উচ্ছেদ। এরপর যে যে জমি আগে চাষাবাদ করত এখন সরকারকে নির্ধারিত খাজনা দেয়া সাপেক্ষে সে সেই জমির মালিক। এটাই ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ‘ক্যাপিটাল ফর্মেশনের’ দিক থেকে প্রথম সুদূরপ্রসারী কালজয়ী ঘটনা। নিপীড়ন নিষ্পেষণের মধ্যে যুগ যুগ নিরন্তর ফেলে রাখা চাষা-প্রজার আত্মমুক্তির প্রথম পদক্ষেপ। বাংলাদেশের ফাউন্ডেশন, আমাদের অর্থনীতির প্রথম ভিত্তি এই আইন। সেটা হয়েছিল বলেই আজ ৩৫ বিলিয়ন ডলারের এক্সপোর্ট গ্লোবাল বিজনেস সামলাতে পারে মাথা তুলে সেই চাষার সন্তানরাই।

বিপ্লব ঘটেছে বলে কোনো কিছুকে চেনার নির্ণায়ক যদি হয় নতুন রাষ্ট্র, মালিকানার ধরনে বদল, ক্ষমতায় বদল ইত্যাদি, তাহলে অন্তত এ তিন কারণে ‘পাকিস্তান আন্দোলন’ ছিল একটা বিপ্লব। অনেকে বলবেন এর ধর্মীয় পরিচয়ের দিকটার কথা [এই আপত্তির অসারতার দিক নিয়ে আরেক সময় বলা যাবে]। কিন্তু এই জমিদারি উচ্ছেদের কাজটা খারাপ হয়েছে- এ কথা কেউ বলুক দেখি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের কলোনি শাসক যত দেশ ত্যাগ করে চলে গেছে, এর সাধারণ ধারা ছিল, সম্পত্তি রেখে যাওয়া। যেমন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার রেলওয়ে, আমরা কেউ ব্রিটিশদেরকে এর মালিকানা শেয়ারও দেইনি। মিসরের নাসের সুয়েজ খালের জন্য যুদ্ধ করে জিতে এসেছিলেন। একাত্তর সালের পরে আমরাও দেইনি। পাকিস্তানের ভুট্টো ১৯৭২ সালে পুরনো ব্যাংক বীমা কোম্পানির মালিকদের সম্পত্তি জাতীয়করণ করেছিলেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে, মালিকানা সরকারের হাতে রাখা, ব্যক্তি নয়। তবে একটাই না দেয়ার উদাহরণ আছে, ওবামার প্রিয়জন সাউথ আফ্রিকার ম্যান্ডেলা। শ্বেতাঙ্গদের সম্পত্তি যেমন ছিল তাতে তিনি হাত দিতে দেননি। ফলাফল হলো, এখন সে দেশে খনি শ্রমিকের বেতন এক হাজার ৬০০ ডলার, কিন্তু তারা বস্তির জীবনযাপন করে।

কারণ, জীবনযাপন লন্ডনের মতো খুবই ব্যয়বহুল। আর ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষমতা আগের মতোই সাদাদের আধিপত্যে। কাজেই কাকে কী ফেরত দেয়া যাবে, এর নির্ণায়ক এগুলো। ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথ ফেরত এসেছেন বলে কিংবা প্রমথ চৌধুরী যশোরের জমিদারি ফেরত চান বা নীরদ চন্দ্র চৌধুরী কিশোরগঞ্জ ফেরত চান বললে ফেরত দিতে পারব না, তাই না। আমাদেরকে বুঝতে হবে কী দেয়া যায়, কী যায় না। আমাদের এক মুরব্বি বদরুদ্দিন উমর, সেই ১৯৭০ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে কোথায় রাখব, এর একটা নির্ণায়ক দিয়েছেন। সেটা হলো, উনিশ শতক থেকে একালেও এসব লোকের জমিদারির প্রতি মনোভাব কেমন, মানে জমিদারিতে যার আপত্তি নেই। এ ছাড়া উচ্ছিষ্টভোগী কি না- এসব দেখতে হবে। এসবের কথা বলে দিয়েছেন তিনি।

প্রিয়া সাহা কোন প্লাটফর্ম থেকে কথা তুললেন?
ঘটনার শুরু ২০০১ সালে আমেরিকায় ৯/১১, মানে ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ তারিখে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার পর থেকে। এর এক মাসেরও কম সময় পর ৭ অক্টোবরে তখনকার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সাথে মূল সাগরেদ তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে নিয়ে আফগানিস্তানের ওপর যুদ্ধবিমান হামলা শুরু করেছিলেন। আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি কমন প্র্যাকটিস হলো, এসব ক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু বা বিমান হামলার সাথে সাথেই আর একটা কাজ তারা শুরু করে- তা হলো, দুনিয়ার প্রায় সব দেশেই দূত পাঠানো। এর উদ্দেশ্য আমেরিকান ওই হামলার সিদ্ধান্তের পক্ষে বিশ্বজনমতকে নিজের পক্ষে জড়ো করা। কারণ, যুদ্ধ শুধু অস্ত্র দিয়ে চলে না, যদি না সাথে এর পক্ষে বয়ান ও জনমত তৈরি করে নেয়া যায়। অবশ্য এর আগে এই যুদ্ধ ও হামলার এক খুবসুরত ছোট নাম তিনি দিয়েছিলেন- ‘ওয়্যার অন টেরর’। ফলে তৈরি হয় ‘ওয়্যার অন টেরর’-এর বয়ান। গ্লোবাল নেতা হিসেবে আমেরিকা দুনিয়ার ছোট-বড় বিভিন্ন রাষ্ট্রের ওপর যতটুকু প্রভাব অথবা চাপ তৈরিতে সক্ষমতা, তা দুনিয়ার প্রায় সব রাষ্ট্রের ওপর এর সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রয়োগ করতে আমেরিকান কূটনীতিক পাঠিয়ে বুশ এই পুরো কাজটা সম্পন্ন করেছিলেন।

তবে এর অন্য একটা দিক আছে। আমেরিকান কূটনীতিকদের এই সফরের মধ্য দিয়ে আসলে যা ঘটে তা হলো, স্থানীয় নানান দ্বন্দ্বগুলোর সাথে গ্লোবাল এ রকম ইস্যুর এলায়েন্স, মানে এতে নতুন করে এক পোলারাইজেশন বা মেরুকরণ শুরু হয়ে যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেমন কাশ্মির, পাকিস্তান বা একটু দূরে হলেও বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ আছে। একে সমর্থন দিতে আমেরিকা তা আমলে নিলে ভারত ‘ওয়ার অন টেরর’-এর নৌকায় উঠতে রাজি বলে জানায়। তাই রফাটা মোটামুটি এখানেই হয়েছিল। আসলে আমেরিকাই হিন্দুত্বের স্বার্থকে ‘ওয়্যার অন টেরর’-এর সাগরেদ বানিয়ে নিয়েছিল। আর সেখান থেকেই হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশনের জন্ম ২০০৩ সালে।

তারা মূলত পারিবারিকভাবে হিন্দু হলেও আমেরিকায় জন্ম নেয়া হিন্দু প্রজন্ম, নিজেদের পরিচয়ে এটাই তারা ফোকাস করে থাকেন। সাথে আছেন হাওয়াইয়ের এমপি তুলশি গাব্বার্ড, আমেরিকার ইসকনসহ যত হিন্দু প্রতিষ্ঠান আছে ইত্যাদি সব মিলিয়ে ওরা এক প্রেসার ও লবি গ্রুপ, যারা হাউজে বা সিনেট লবিতে তৎপর থাকে কথিত হিন্দুস্বার্থের পক্ষে। শেষ বিচারে এর ‘মাখন’টা যায় ভারতের বিদেশনীতির পক্ষেই। তাই এই গ্রুপ বা ব্যক্তিগুলোর সমন্বয় করে থাকে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা। আর হোয়াইট হাউজ পর্যন্ত তা হাজির করে আমেরিকার ‘ফ্রিডম হাউজ’-এর মতো পুরোপুরি সরকারি ফান্ডে চলা এনজিও।

‘ওয়্যার অন টেরর’ থেকে জন্ম নেয়া এই হিন্দুস্বার্থ গ্রুপ (শব্দগুলো ওদের, লিখেছেন হিন্দুইজম প্রমোট করেন তারা) এদের কিছু ভূমিকা ছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পেছনে। বাংলাদেশের হিন্দু রাজনীতি এখন যা মূলত বিজেপির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে; মূলত গত নির্বাচনের সময় থেকে। এ দিকটা সম্ভবত সরকার যথাযথ আমল না করায় এখন ‘সেম সাইডে গোল’ খেতে হলো। আবার বিএনপিরও, ভেতরে যারা এই হিন্দুস্বার্থকে পঞ্চাশ আসন দেয়ার জন্য লবি করেছিল, ওরা কোণঠাসা হওয়া আর শক্ত ওয়ার্নিং পাওয়ার যোগ্য।

প্রিয়া সাহার ঘটনা প্রমাণ করল, এ সরকারের জন্য বাংলাদেশের হিন্দুত্বের রাজনীতি আর নির্ভরযোগ্য নয়। ‘ফলে রি-অ্যাসেসমেন্ট’ দরকার বলে মনে করা হচ্ছে। আমরা সবার সাথে ভারসাম্য সম্পর্ক রাখব- এগুলো মুখে বলে কিছু হবে না। প্রিয়ার ঘটনা কেন গওহর রিজভী আগে বোঝেননি। বরং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনকে পাঠিয়েছেন।

আবার ক্ষমতার লোভে ভুল জায়গায় পা দেয়া হবে? আলামত বলছে- ভারত আমেরিকাকে হাসিনার বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারছে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারবে?

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
শনিবারে লালমনিরহাটে ড. আজহারীর মাহফিল, একদিন আগেই মাঠ পরিপূর্ণ ইলন মাস্কের ইউরোপীয় ফার-রাইটদের প্রতি সমর্থন ‘গণতন্ত্রের জন্য হুমকি’ : শোলৎজ কাল সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে বিএনপি ভবিষ্যতে যারা আসবেন, অতীত থেকে শিক্ষা নেবেন : উপদেষ্টা সাখাওয়াত ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেন চীনের প্রেসিডেন্ট, পাননি মোদি ভ্যাট ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ৫ অধিদফতরের স্বতন্ত্র অভ্যন্তরীণ অডিট বিভাগ স্থাপন কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা আগামী ১২ এপ্রিল অন্তর্বর্তী সরকারের মূল দায়িত্ব গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা : ড. মঈন খান সিলেট জেলা বার সমিতি নির্বাচনে আওয়ামীপন্থীদের জয় এখন আর স্বৈরাচারের সময় নেই, যা খুশি তা করবেন : নৌ উপদেষ্টা

সকল