২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বিজেপির উত্থানে বিপন্ন ভারতের শুভবোধ

অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগ্রহ

আধুনিক ভারতের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। কট্টর হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি বিজেপি দ্বিতীয় মেয়াদে দিল্লির মসনদে সমাসীন হয়েছে। আর তারই প্রেক্ষাপটে এত দিনে যেন খানিকটা নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে ভারতের উদারনৈতিক প্রগতিশীল বাম বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী-সমর্থকেরা। বিজেপির এই বিজয় যে ভারতকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে না, বরং হিংসা আর বিদ্বেষের চোরাবালিতে আটকে ফেলে পুরনো অন্ধকারই যে পুরো দেশটিকে গিলে খাবে, দেরিতে হলেও সেই উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন কেউ কেউ বা কোনো কোনো গোষ্ঠী। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান, প্রবাদপ্রতিম গণতন্ত্র, শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো, বাক-ব্যক্তি-মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক ও মানবাধিকার সঙ্কুচিত হতে হতে যখন তলানিতে এসে ঠেকেছে তখন তারা চোখ মেলতে শুরু করেছেন। এতক্ষণ রোদে পিঠ পুড়ে যাচ্ছে টের পেয়েও আলস্যে গা এলিয়ে ছিলেন। পি পু, ফি শু ছাড়া কোনো বাক্য স্ফুরণ করেননি।

এমনই একটি গোষ্ঠী হলো পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম গণমাধ্যমের মালিক আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী। মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষভাবাপন্ন যেই গোষ্ঠীর সব পত্রিকায় মুসলিমদের নামসহ নিত্যব্যবহৃত শব্দগুলো বিকৃতি ছাড়া লেখা হয় না, যে পত্রিকা কেবল মুসলমানপ্রধান দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশকে ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ বলে উল্লেখ করে এবং মাঝে মধ্যেই এ দেশে হিন্দু নির্যাতনের গালগল্প ছাপে, তসলিমা নাসরিনের মতো ভুঁইফোড় লেখককে বাংলাদেশবিরোধী লেখা ‘লজ্জা’র জন্য পুরস্কৃত করে, মুসলমানদের জীবনাচারের পরিপন্থী অযৌক্তিক যৌনতায় আক্রান্ত বানোয়াট কাহিনী বলে ‘দেশ’ পত্রিকায় মুসলমান লেখকের অতিশয় নিম্নমানের লেখা ‘ফাইনাল গাজী’ ধারাবাহিকভাবে ছাপে, সেই গোষ্ঠীটি এবার চোখ মেলেছে।

১৭ মে ২০১৯ সংখ্যাটি তারা সাজিয়েছে ‘ভারতচেতনা’ শিরোনামে বেশ কয়েকটি নিবন্ধ দিয়ে। নিবন্ধগুলোর মূল সুর যতটুকু বুঝেছি, একটি উদার গণতান্ত্রিক ও আধুনিক ভারতের স্বপ্ন লালন। যেখানে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ সম-অধিকার নিয়ে সমভাবে স্বদেশের আলো-হাওয়া-জলে বেড়ে উঠতে এবং নির্বিবাদে জীবনযাপনের সুযোগ পাবে। নিবন্ধকারেরা বলতে চেয়েছেন, সুদূর অতীতকাল থেকেই ভারত ভূমি হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, মুসলিম, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের মানুষকে একসাথে একই কোলেপিঠে লালন করেছে। তাদের মধ্যকার নানা বিভেদ, বৈষম্য, দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাত সত্ত্বেও মহাভারতের পবিত্র ভূমিতে তারা হাজার বছর ধরে প্রতিবেশী হিসেবে পাশাপাশি বসবাস করেছে। একটি নিবন্ধে লেখক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় একটি বইয়ের ভূমিকায় একজন ইতিহাসবিদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তাতে ইতিহাসবিদ লিখেছেন, ‘আজ অনেকেই অজ্ঞতাবশত অথবা রাজনৈতিক মতবাদের কারণে এমন সব তত্ত্ব হাজির করেন, যাকে হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। যেমন তারা বলেন, হিন্দুরা মুসলিম শাসনের শিকার হয়েছে এবং হাজার বছর ধরে তারা পরের দাস হয়ে থেকেছে। এ ধরনের কথা কী বিপুল অজ্ঞতার পরিচয় দেয়, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। কারণ গত হাজার বছরে হিন্দুধর্মের (ও সংস্কৃতির) নানা দিকের যে কত রকমের সার্থক, সৃষ্টিশীল ও সমাদৃত বিকাশ ঘটেছে, এই (সর্বৈব ভুল) তত্ত্ব তাকেই সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে চায়।’

এর পরই অনির্বাণ চ্যাটার্জি লিখেছেন, ‘...যাকে এখন হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি বলা হয়, মধ্যযুগের ইসলামি শাসকদের রাজত্বে তার বিপুল স্ফূর্তি ও প্রসারের অজস্র দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় পাতায়।’ তিনি অমর্ত্য সেনের দেয়া রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন, যেখানে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘ভারতের ধারণা কতটা বিস্তৃত, তা বুঝতে চাইলে তার বহুত্বময় অতীতকে সম্পূর্ণ অনুধাবন না করলে চলে না।’

এভাবে ভারতের বহুত্বময় অতীতকে বোঝার এবং তাদের দেশবাসীকে বোঝানোর একটি প্রয়াস যেন পেয়েছে পাক্ষিক দেশ তথা আনন্দবাজার গোষ্ঠী। কিন্তু এই প্রয়াস বড় দেরিতে এসেছে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বিজেপি ভারতে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রাসাদটি যেদিন ধসিয়ে দিয়েছে সেদিন থেকেই দেশটি তার ধর্মনিরপেক্ষতার রঙিন মুখোশ ঝেড়ে ফেলেছে। হয়ে উঠেছে ধর্মনির্ভর প্রগতিশীলদের ভাষায় একটি সাম্প্রদায়িক ভারত। আর এই রূপান্তরের পথে শামিল হয়েছে তথাকথিত প্রগতিশীলসহ সর্বস্তরের ভারতবাসী। যে পশ্চিমবঙ্গ নিজের অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্য গর্ব করতে বেজায় উৎসাহী, সেই পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর দফতরে ওই সন্ধ্যায় (বাবরি মসজিদ ভাঙার) কত মণ মিষ্টান্ন সাবাড় হয়েছিল, সেই হিসাব আমাদের জানা নেই। কিন্তু পরদিন কলকাতার কোনো মিষ্টির দোকানে একটিও মিষ্টি অবশিষ্ট ছিল না, সেই ইতিহাসের সাক্ষী এই লেখক নিজে।

এই মসজিদ ভাঙার মধ্য দিয়ে দেশটিতে যে দানবের জন্ম হলো তা একদিন পুরো দেশটিকে বিভেদের দেয়ালে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে এবং সেই সম্ভাবনাই প্রবল বলে আমাদের ধারণা। আর সম্ভবত সমূহ সেই বিপদ আঁচ করতে পেরেই ভারতের বাম প্রগতিশীলদের পাশাপাশি আনন্দবাজার গোষ্ঠীর মতো একটি কট্টর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীও এখন ভারতচেতনার ধ্বজা উড়িয়েছে।

আসামে বসবাসকারী একজন বাঙালি বামপন্থী চিন্তাবিদ গত নির্বাচনের আগে দেশবাসীকে সচেতন করতে গিয়ে নিজের ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন- “এতে কোনো সন্দেহ নেই যে বিজেপিকে ভোট দেয়ার অর্থই নিজের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তোলা। পাঁচ হাজার বছর ধরে যে মতবাদ, আদর্শ, বোধ নিয়ে আজকের ভারত গড়ে উঠেছে, দ্বিধাহীনভাবে বলছি, তার চরম বিরুদ্ধে রয়েছে এ দলটি- বিজেপি।

‘গত পাঁচ বছরের দিকে একটু তাকান। দেশে গৌরব করার মতো যেসব স্বশাসিত সংস্থা ছিল সব ক’টার ওপর আঘাত নেমে এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছেন, সিবিআই ডিরেক্টরকে গভীর রাতে সরানো হয়েছে, সিএজি সাজানো রিপোর্ট দিয়েছে, নির্বাচন কমিশনার সরে দাঁড়িয়েছেন। যোজনা কমিশন বদলে সরকারের তল্পিবাহক নীতি আয়োগ তৈরি করা হয়েছে, ইদানীং যাদের একমাত্র কাজ প্রধানমন্ত্রী যেখানে ভাষণ পেশ করবেন দুই দিন আগে সেই জায়গার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক তথ্য প্রদান করা, ন্যাশনাল সার্ভিস অফিস বা এনএসএসও এবার উঠিয়ে দেয়া হবে, সরকারের গায়ে কালি লাগতে পারে এমন কোনো রিপোর্ট প্রকাশ পাচ্ছে না।
‘সাধারণ মানুষের জন্য সরকার কী করল সেসব না-হয় বাদই দিন, শুধু এটুকু খেয়াল করলেই চলে যে বিজেপি শাসিত ভারতে মুক্তমনে মতপ্রকাশের অধিকারও চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে ভাঁড়ের মতো বসে আছেন, সেটাও দেখতে হয়েছে ভারতবাসীকে।

‘...সব কিছুই একটা ছক ধরে চলছে। আর তা হলো, সংস্কৃতি-শিক্ষা-জ্ঞান-ঐতিহ্য সব কিছু দুমড়ে-মুচড়ে দাও। সবাইকে বাঁধো একটাই মতে- হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান।”
বিজেপির গত পাঁচ বছরের শাসন বৃহত্তর ভারতবাসীর কল্যাণ করতে পুরোই ব্যর্থ এটি এখন স্পষ্ট। তাই বিগত নির্বাচনে তারা তাদের গত পাঁচ বছরের সাফল্যের কোনো কাহিনী তুলে ধরেনি, বরং ভারতের কথিত শত্রুর মোকাবেলা করার ক্ষমতা কেবল মোদিরই আছে এই স্লোগান দিয়েই ক্ষমতার মসনদ পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতীয়দের এই আবেগ নিঃসন্দেহে থিতিয়ে যাবে। কারণ লোকরঞ্জনবাদী স্লোগানের চটক বেশিদিন থাকে না, সেটা সবাই জানে।

ভারতে বিজেপির এই উত্থান বাংলাদেশের জন্য কতটা বিপজ্জনক? বাংলাদেশের একজন কলামিস্ট মহিউদ্দিন আহমদ সম্প্রতি পত্রিকান্তরে এক নিবন্ধে মন্তব্য করেছেনÑ “আমরা, বাংলাদেশিরা ভারতের রাজনীতি নিয়ে যতই আগ্রহ কিংবা আশঙ্কা, উল্লাস কিংবা উষ্মা দেখাই না কেন, ওটার নিয়ন্ত্রণ ভারতীয়দের হাতে। আমাদের ভাববার বিষয় হলো, বাংলাদেশের সাথে ভারতের আচরণ কেমন হবে। দুই দেশের সরকারই দাবি করে, বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। আমরা এটা বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু আশঙ্কাও আছে।

নির্বাচনের আগে বিজেপি জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে আগ্রাসী প্রচারণা চালিয়েছে। আমাদের পূর্বে ও উত্তরে বিজেপি ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। পশ্চিমবঙ্গে ভালোভাবেই থাবা বসিয়েছে তারা। বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া ‘মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের’ তাড়াবে, এই ওয়াদা তাদের। এই তালিকায় আছে প্রায় ৫০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষ। তারা যদি সত্যি সত্যিই এই বোঝা বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়, তাহলে বাংলাদেশ চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে।”

আমাদের মনে হয়, এ বিপদটি বাংলাদেশের একার বিপদ হয়ে আসবে না; বরং এর একটি ধারাবাহিক অভিঘাতের সৃষ্টি হবে উপমহাদেশ জুড়ে। এরই মধ্যে ভারতের কোনো কোনো অংশে বিশেষত দক্ষিণে হিন্দি প্রতিহত করার আন্দোলন শুরু হয়েছে। বাঙালি ও মুসলমান তাড়ানোর প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট জোয়ারে সেই আন্দোলনেও জোয়ার আসবে। ঘৃণা কেবল ঘৃণারই জন্ম দেয় এবং এর একটি ছোঁয়াচে বৈশিষ্ট্য আছে। বিশ্বজুড়ে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিকদের যে জোয়ার আসছে তাতে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়লে অবাক হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। কারণ, বাংলাদেশে ভোটারবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন একটি অজনপ্রিয় সরকার বিদ্যমান। বিকল্প শক্তির উত্থান এখানে অবশ্যম্ভাবী। আর সম্ভাব্য সেই শক্তি ভারতের অনুকূলে থাকবে, এমনটি মনে করারও কোনো কারণ নেই।

সবশেষে একটি কথা বলার ইচ্ছা সংবরণ করতে পারছি না। রাষ্ট্র শাসন কাকে বলে সেই অভিজ্ঞতা ভারতের হিন্দুদের রক্তের ভেতরেই নেই। শাসক হিসেবে তারা যে ব্যর্থ হবে স্বাধীনতার পর গত ৭৫ বছরের ইতিহাসই তা স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছে। বিজেপির হাত ধরে সম্ভবত তাদের অগস্ত্যযাত্রার সূচনা হলো। ভবিষ্যতের কথা আপাতত তোলা থাক। আমরা আগামী পাঁচ বছরের মোদি শাসন দেখি।

 


আরো সংবাদ



premium cement