২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কৃষকদের সাথে পরিহাস কেন?

-

আমাদের বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান। এ দেশে শতকরা ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। এ দেশের গ্রাম এলাকায় ৫৯.৮৪% লোকের এবং শহর এলাকায় ১০.৮১% লোকের কৃষি খামার রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৯.১% এবং এ খাতের মাধ্যমে ৪৮.১% মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। ধান, পাট, তুলা, আখ, ফুল ও রেশম গুটির চাষসহ বাগান সম্প্রসারণ, মাছ চাষ, সবজি আবাদ, পশুসম্পদ উন্নয়ন, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, বীজ উন্নয়ন ও বিতরণ ইত্যাদি বিষয় এ দেশের কৃষি মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রও এ বিষয়ে কাজ করছে। সার্বিক বিবেচনায় আমাদের দেশের কৃষি বেশ সমৃদ্ধ।

তবে অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশের মেরুদণ্ডতুল্য কৃষি নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জীবন-জীবিকার জন্য দেশের জনগণ ও অর্থনীতি মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এখনো শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ নাগরিক কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটলে বা কৃষকরা কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেলে জাতীয় অর্থনীতিই বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জনবহুল আমাদের মাতৃভূমির জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে সাত হাজার নতুন মুখ, বছরে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় ২৫ লাখ। অপর দিকে রাস্তাঘাট, কল-কারখানা, অপরিকল্পিত বাড়িঘর ইত্যাদি অবকাঠামো তৈরি করার জন্য চাষযোগ্য জমি থেকে প্রতিদিন ২২০ হেক্টর হিসেবে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার ৩০০ হেক্টর ভূমি। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য পাল্লা দিয়ে নিবিড়ভাবে চাষ করা হচ্ছে ধান। তবে এতে সাফল্যও এসেছে ব্যাপকভাবে। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ধানের সাথে আনুপাতিক হারে অন্যান্য ফসলের (ডাল, তেল, শাকসবজি, ফল-মূল) চাষও বাড়াতে হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি সচল থাকার ক্ষেত্রে কৃষক ও কৃষির অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কৃষকসমাজ বরাবরই উপেক্ষা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।

সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এ দেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাস করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে দুই স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং পার্কিনসন ‘বাংলাদেশ : এ টেস্ট কেস অব ডেভেলপমেন্ট’ নামক এক গবেষণাগ্রন্থে বলেন, ‘যদি বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়, তাহলে বিশ্বের কোথাও উন্নয়নে কোনো সমস্যা হবে না।’ এসব বক্তব্য ছিল বাংলাদেশে লাগামহীন দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এই দুষ্টক্ষতে প্রলেপ দিতে সক্ষম হয়েছে আমাদের দেশে কৃষি ও রেমিট্যান্স। কৃষি ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের কারণে আমরা খাদ্যে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ হয়েছি বলে দাবিও করা হচ্ছে সম্প্রতি। মিলেছে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতিও। এই অভাবনীয় অগ্রযাত্রায় কৃষি তথা কৃষকসমাজ রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। টেকসই উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা। কাজটি অত্যন্ত সফলতার সাথে করে চলেছে দেশের কৃষক সমাজ। তাদের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং দেশের কৃষকসমাজ বরাবরই অবহেলিত ও উপেক্ষিত।

১৯৭১ সালে দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আমাদের জনসংখ্যা ছিল ৭ দশমিক ৫ কোটি। ধান উৎপাদন ছিল প্রায় ১ কোটি মেট্রিক টন। বিগত প্রায় ৫ দশকে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এর সাথে পাল্লা দিয়ে এ দেশের চাষিরা ধান উৎপাদন বাড়িয়েছে তিন গুণেরও বেশি। ২০১৭-১৮ সালে দেশে উৎপন্ন হয়েছে প্রায় তিন কোটি ৬০ লাখ মেট্রিক টন চাল। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, নগরায়ন, শিল্পায়ন ইত্যাদি নানা কারণে কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস, সেচের পানির স্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন অভিঘাত যেমন বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার মতো বৈরী প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগোতে হয়েছে বাংলাদেশের কৃষক সমাজকে। এসব মোকাবেলা করার পরও আমাদের দেশের কৃষক সমাজ জাতীয় অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে।

জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধান উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষে। ২০১৮ সালে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্য দিকে, বিশ্বের অন্যান্য শীর্ষ ধান উৎপাদনকারী দেশে এই হার ছিল অনেক কম। গণচীনে এই বৃদ্ধির হার দশমিক ৭৮ শতাংশ, ভারতের ২ শতাংশ। মার্কিন কৃষি বিভাগের পূর্বাভাস অনুসারে, ২০১৯-২০ সালেও আমাদের এই প্রবৃদ্ধি বজায় থাকবে। কিন্তু কৃষকদের এই অভাবনীয় সাফল্যকে আমরা মূল্যায়ন করতে বরাবরই ব্যর্থ।

কৃষক সমাজের এই সাফল্যে দেশের অর্থনীতির চাকা যখন ক্রমেই গতিশীল হয়ে উঠছে, তখনো কৃষকদের জন্য আমরা স্বস্তিকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারিনি। দেশে দ্রব্যমূল্য ক্রমবর্ধমান এবং কৃষিতে উৎপাদন খরচ বাড়লেও ধানসহ কৃষিপণ্যের মূল্য নিম্নমুখী। ধানের ক্ষেত্রে এই সঙ্কটটা তীব্র হয়ে উঠেছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এক কেজি ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ ২৪ টাকা। এই ধান বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১২-১৩ টাকা কেজি দরে! অথচ সরকার নির্ধারিত ধানের ক্রয়মূল্য কেজি ২৬ টাকা। সরকার যে পরিমাণ ধান বা চাল ক্রয় করে তা উৎপাদনের তুলনায় নগণ্য। গত বোরো মওসুমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু সরকার কিনেছে মাত্র দেড় লাখ টন ধান আর ৯ লাখ টন চাল! তাই বেশির ভাগ ধান কৃষককে বিক্রি করতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের কাছে, যেখানে মুনাফাই মুখ্য। ফলে কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে নিঃসন্দেহে বঞ্চিত।

২০১৬ সালে বোরো মওসুমে ধানের দামের ব্যাপক পতন ঘটে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতেই সরকার আমদানি নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নেয় এবং চাল আমদানির ওপর ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হয়। পরের বছর বোরো মওসুমে হাওর অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারি হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ ১০ লাখ টন। সম্ভাব্য ঘাটতি মোকাবেলায় চাল আমদানি করার সিদ্ধান্ত হয় এবং ২৮ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে শুরু হয় অবাধ চাল আমদানি। গত দেড় বছরে দেশে প্রায় ৬০ লাখ টন চাল আনা হয়েছে। এ দিকে দেশে ধান উৎপাদন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও চাল আমদানিতে ভাটা পড়েনি। এবার ধানের বাম্পার ফলন ও অব্যাহত দরপতনের পরও দেশে চাল আমদানির অপেক্ষায় আছে প্রায় চার লাখ টন। বিষয়টিকে অনেকে রহস্যজনক মনে করছেন।

গত তিন মওসুমে দেশে ধানের বাম্পার ফলন অব্যাহত থাকায় সরবরাহ পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। ‘চাহিদার তুলনায় দেশে মজুদ বৃদ্ধি পেয়েছে’ বলে সরকারের পক্ষে দাবি করা হচ্ছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে আমন মওসুমে বাম্পার ফলনের পর মজুদ ও বাজারে সরবরাহ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। বেশির ভাগ চালকলে তাদের ক্রয়কৃত মজুদ রয়ে গেছে। এ কারণে বেশির ভাগ চালকল মালিক ধান কিনে সংগ্রহ করেননি। সাধারণত বোরো ধান কাটা শুরু হওয়ার এই সময় কালে ১৬ হাজার চালকলের প্রায়ই চালু থাকে। কিন্তু বর্তমানে চালু রয়েছে মাত্র হাজার খানেক। তাই এবারে ধান কাটা পুরোপুরি সম্পন্ন হলে সরবরাহ পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে বলে মনে হচ্ছে। এর মধ্যে ধান ক্রয় কার্যক্রম যদি জোরদার না করা, হয় ধানের মূল্য আরো হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। তা দেশের কৃষির জন্য অশনিসঙ্কেত বলেই মনে করা যায়।

মূলত কৃষি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালনকারীদের উদাসীনতা ও উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবেই কৃষকরা পণ্যের মূল্য পাচ্ছে না বলে মনে করা হচ্ছে। ধানের অব্যাহত দরপতন রোধে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে সংশ্লিষ্টরা ধানের মূল্য নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাকে কৃষক ও কৃষিপণ্য সম্পর্কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল প্রদর্শন বলা যায়। বলা হয়েছে, ‘দেশে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি’ ধান উৎপন্ন হয়েছে বলেই ধানের দাম বাড়ানো সম্ভব নয়। দাবি করা হচ্ছে, ধানসহ খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতার কারণেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় অধিক ধান ক্রয় সম্ভব হচ্ছে না। এটিও কোনো দায়িত্বশীল কথা নয়। কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা দায়িত্ব সরকারের। ধান যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি উৎপন্ন হয়ে থাকে, তাহলে বহির্বিশ্বে তার বাজার অনুসন্ধান ও রফতানি করার দায়িত্বও সরকারের। ধান সংরক্ষণের জন্য দেশে প্রয়োজনীয় গুদাম নেই- এটি যৌক্তিক কোনো কথা হতে পারে না।

যেহেতু কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ ক্রমবর্ধমান, তাই কৃষিপণ্যে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করতে হরে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের উদাহরণ অনুসরণ করা যেতে পারে। কৃষকরা যাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় তা নিশ্চিত করতে ভারত সরকার তাদের প্রধান ফসল গম ও ধানসহ মোট ২৫টি ফসলের জন্য ন্যূনতম ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এই কাজটি করে কমিশন ফর অ্যাগ্রিকালচার কস্ট অ্যান্ড প্রাইসেস (সিএসিপি)। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কৃষকের উৎপাদন খরচ, ঝুঁকিসহ সব কিছু বিবেচনায় নেয়া হয়। এ বছর ভারতে গমের জন্য সরকার নির্ধারিত ক্রয়মূল্য প্রতি কুইন্টাল এক হাজার ৪৪০ রুপি। কৃষকের উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছে প্রতি কুইন্টাল ৮৬৬ রুপি। অর্থাৎ একজন কৃষক তার খরচের ওপর ১১২ দশমিক ৫ শতাংশ মুনাফা অর্জন করতে পারবে। বাজারে যাতে নির্ধারিত মূল্যে ফসল বিক্রি হয় সে লক্ষ্যে সরকার মোট উৎপাদনের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ক্রয় করে। ২০১৭-১৮ সালে ভারতে মোট গম উৎপাদন হয় ৯৮ দশমিক ৬১ মিলিয়ন টন। এ থেকে সরকার ক্রয় করে ৩৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন, যা শতকরা হিসাবে ৩৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অথচ এসব ক্ষেত্রে আমরা আজো উদাসীন।

কৃষি ও কৃষকরা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলেও ধানের অব্যাহত দরপতন ঘটেছে। তা দেশের পুরো কৃষি সেক্টরে হতাশার সৃষ্টি করেছে। ফলে কৃষক সমাজ কৃষিকাজে উৎসাহ হারাতে বসেছে। ন্যায্যমূল্য না থাকায় ধানক্ষেতে আগুন দিয়ে এবং রাস্তায় ধান ছিটিয়ে অভিনব প্রতিবাদের ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি। অথচ সরকার কৃষকের মূল সমস্যার সমাধান এবং ধান সহ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।

ধানের মূল্য নিয়ে কৃষিমন্ত্রীসহ সরকার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যও অনেকটাই দায়সারা গোছের। কৃষকসহ সচেতন মানুষের দাবি হলো কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। কিন্তু একটি ছাত্র সংগঠন ও পুলিশ কর্তৃক কৃষকদের ধান কেটে দেয়ার নামে ফটোসেশনের যে মহড়া প্রদর্শন করা হচ্ছে, তা কৃষক সমাজের প্রতি নির্মম পরিহাস ছাড়া কিছু নয়। কৃষকদের ন্যায্যমূল প্রাপ্তিই আসল সমস্যা। এ কথা সরকার যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই জাতির কল্যাণ।

smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement