ধর্ষণের মহামারী এবং সুশাসনে বিপর্যয়
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ১৫ মে ২০১৯, ১৭:৪৯
সম্প্রতি বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা এতই বেড়েছে যে, একে রীতিমতো মহামারী বলা যেতে পারে। এমন কোনো দিন নেই, সংবাদপত্রের পাতায় নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে না। এক শ্রেণীর মানুষরূপী পশু যেন উন্মাদ ও উন্মত্ত হয়ে পড়েছে। সামাজিক শাসন ও শৃঙ্খলার বিপর্যয় ঘটেছে। শাসক কর্তৃত্বের ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ এই বিপর্যয়ের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ন্যায়-অন্যায় যাচাই-বাছাই না করে সঙ্কীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি এই অপসংস্কৃতির সহায়ক বলে প্রমাণিত হয়েছে। অতি সম্প্রতি যেসব ঘটনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, শাসকদল প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে দুষ্টের লালন করছে।
এই বিপর্যয়ের যে মারাত্মক ব্যাপ্তি ঘটেছে, তা বোঝার জন্য মাত্র একদিনের সংবাদপত্র পর্যালোচনাই যথেষ্ট। তারিখটি ১২ মে ২০১৯। ১. নয় জেলায় ১২ ধর্ষণের ঘটনা, মাদরাসাছাত্রীকে বেঁধে নর্দমায় নিক্ষেপ, মরণাপন্ন স্কুলছাত্রী (কালের কণ্ঠ)। ২. পাঁচ শিশু-কিশোরীসহ ধর্ষণের শিকার সাত। ধর্ষণের পর মাথায় ভারী বস্তুর আঘাতে হত্যা- চলন্ত বাসে নার্সকে ধর্ষণ (প্রথম আলো)। ৩. ছাত্রলীগ নেতার মহিলা ডাক্তারের শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ। (ডেইলি স্টার)। ৪. চাঁদপুরে দু’টি ধর্ষণের ঘটনায় মেম্বারসহ আটক পাঁচ। বেগমগঞ্জে ধর্ষণের ২৪ দিন পরও ধর্ষক গ্রেফতার হয়নি (নয়া দিগন্ত )। ৫. হবিগঞ্জে প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ধর্ষিত, অবস্থা সঙ্কটজনক (ইত্তেফাক)। ৬. হবিগঞ্জে ধর্ষণে শিশুর জীবন বিপন্ন। ঝিনাইদহে মাদরাসাছাত্রীকে রাতভর ধর্ষণের পর হাত-পা বেঁধে ড্রেনে। বিভিন্ন স্থানে স্কুলছাত্রীসহ আরো সাতজন ধর্ষণের শিকার (যুগান্তর)। এটি হলো প্রধান ছয়টি পত্রিকায় প্রকাশিত এক দিনের ধর্ষণের খবর। অন্যান্য পত্রিকায় নিশ্চয়ই আরো আছে। এ ছাড়া বিশাল গ্রামবাংলার সব খবর প্রকাশ পায় না। ‘প্রতিদিন কত খবর রয়ে যায় অগোচরে।’ রক্ষণশীল বাংলাদেশের মানুষ এ ধরনের খবর প্রকাশ করতে চায় না সম্মানহানির ভয়ে। সুতরাং নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তা অনুমান করা যায়।
নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের প্রকাশিত ঘটনার পরিণতি, পুলিশি ব্যবস্থা ও পারিপাশির্^ক পর্যালোচনায় একটি নির্মম সত্য বেরিয়ে আসছে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, তথাকথিত নির্বাচনের পরপরই নোয়াখালীর সুবর্ণচরে একটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী একটি পরিবার ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে এই নির্লজ্জ ঘটনার শিকার হয়। ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা তাদের কথামতো ভোট না দেয়ার প্রতিশোধ এভাবেই নেয়। ঘটনাটি জাতীয়ভাবে ব্যাপক ক্ষোভ ও সমালোচনার সৃষ্টি করে। ক্ষমতাসীন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব থেকে সবাই তখন আস্ফালন করেছিলেন- ‘ধর্ষকদের ক্ষমা নেই’। কিন্তু অবশেষে আমরা কী দেখলাম? অতি সম্প্রতি এ সম্পর্কিত পুলিশি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে নির্বাচনের প্রসঙ্গটির কোনো উল্লেখ নেই। কী কারণে এবং কাদেরকে রক্ষা করার জন্য এ রকম সত্য গোপন করা হলো? প্রায় একই সময় নোয়াখালীর মওদুদ আহমদের নির্বাচনী এলাকা মোল্লার হাটে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। পরে তা ধামাচাপা দেয়া হয়। কারা এই ধামাচাপা দেয় এবং কাদের স্বার্থে?
সর্বশেষ নারী নির্যাতনের ঘটনাটি সবাইকে আবেগাপ্লুত করে- তা হচ্ছে ফেনীর সোনাগাজী থানার নুসরাত জাহান রাফির নির্মম হত্যাকাণ্ড। তদন্ত প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে, ওই লম্পট মাদরাসা অধ্যক্ষের প্রতিটি অপকর্মের সহায়তা জোগাতেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। মেয়েটিকে পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্রে স্থানীয় নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। জনমতের চাপে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চূড়ান্ত বিচারে এদের আদৌ কোনো শাস্তি হবে কি না, এ ব্যাপারে জনমনে সন্দেহ রয়েছে। আর খোদ পুলিশের কী ভূমিকা ছিল? আমাদের দেশের কালচারই এ রকম যে, ক্ষমতা নামের আলাদিনের চেরাগের মালিক যারা, দেও-দানব ও দৈত্যরা তাদের হুকুমের গোলাম হয়ে কাজ করে। ক্ষমতার রদবদলের সাথে সাথে ওসি-ডিসি এবং পরিপার্শ্বের কুশীলবদের চরিত্র পাল্টে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাসকদলের হুকুমের অপেক্ষাও তাদের করতে হয় না। সতত স্বাভাবিকভাবে শাসকগোষ্ঠীর সব অপকর্মের সাথী হয়ে যায় তারা।
নুসরাতের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন পুড়িয়ে মারার ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন ফেনীর পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলমের সম্মতি ছিল ওসির পদক্ষেপে। ওসির পক্ষে সদর দফতরে সাফাই চিঠি পাঠিয়েছিলেন তিনি। পুলিশ সদর দফতরের গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কী সেই ব্যবস্থা? শুধু দূরবর্তী নন-অপারেশনাল ইউনিটে সংযুক্তি। বলা হয়েছে, আরো ব্যবস্থা নেয়া প্রক্রিয়াধীন আছে। উত্তাপ কমে গেলে তারা যে আবার যথাযথ ক্ষমতায় ফিরে আসবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, ক্ষমতাসীন সরকারের কাছে অপরাধ গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার রাজনৈতিক আনুগত্য। যে সরকার বিরোধীদলীয় তৎকালীন চিফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুককে পেটানো পুলিশ কর্মকর্তাকে পুরস্কৃত করতে পারে, তাদের কাছে আর কী আশা করা যেতে পারে? চলতি আরেকটি নির্মম ঘটনা হচ্ছে, কিশোরগঞ্জে চলন্ত বাসে নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়াকে গণধর্ষণের পর মাথায় আঘাত করে হত্যা করা। যথারীতি প্রতিবাদ ও পুলিশি ব্যবস্থা চলছে। আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থায় এর সুবিচার হবে কি না, সংশ্লিষ্ট অপরাধীরা রাজনৈতিক প্রশ্রয় যে পাবে না তার নিশ্চয়তা কই? অতীতের উদাহরণ সুখকর নয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে সেঞ্চুরি করেছিল যে ‘সোনার ছেলেটি’, সে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিল। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি সহযোগিতায় তার বিদেশ গমন ঘটে ছিল। সাম্প্রতিক বিচারহীনতার উদাহরণ হচ্ছে সাগর-রুনি হত্যা, কুমিল্লা সেনানিবাসে তনু হত্যা এবং সিলেটে খাদিজার প্রতি নগ্ন-নির্মম আক্রমণ। এই আক্রমণের আসামিও আরেক ‘সোনার ছেলে’। বিগত এক যুগ শাসনামলে ক্ষমতাসীনেরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট ‘পারঙ্গমতা!’-এর পরিচয় দিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের কোনো বিচার হয়নি।
মানুষের আদিম প্রবৃত্তির তাড়না ইতিহাসের মতোই পুরনো। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য মানুষের স্বভাবজাত। মানবসভ্যতার ধারক-বাহকেরা মানুষের এই সহজাত প্রবৃত্তিকে সুশৃঙ্খল ও আইনানুগ করার জন্য বিয়ে নামক প্রাতিষ্ঠানিকতার জন্ম দিয়েছেন। প্রতিটি ধর্ম এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান দিয়েছে। আধুনিক সভ্যতা সম্পর্ককে অবাধ ও স্বাধীন করে দেয়ার ফলে পাশ্চাত্যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। সব ধর্মের বিধান ও চিরায়ত সংস্কৃতি আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধ রক্ষার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু পাশ্চাত্যকে মডেল ধরে আগানো শিক্ষিত শ্রেণী এবং কিছু বিকৃত বুদ্ধিজীবী আমাদের সমাজেও ‘অবাধ স্বাধীনতা’র আমদানি করতে চায়। এরা সংক্রামক ব্যাধির মতো সমাজদেহে রোগ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এখন তা মহামারী আকার ধারণ করেছে। ইতঃপূর্বের এক কলামে উল্লেখ করেছিলাম, দেশের নৈতিকতার অভিভাবক- রক্ষণশীল সমাজপতি এবং আলেম সমাজকে কিভাবে অপাঙ্ক্তেয় ও অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। আলেম সমাজ ফতুয়া দিতে পারবেন না বলে দেয়া উচ্চ আদালতের রায় এ রকম একটি উদাহরণ।
সমাজতত্ত্ববিদেরা এই মহামারী নিরোধের প্রতিকার ব্যাখ্যা করেছেন। তারা সমাজ-রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে নীতি ও আদর্শের পুনরুত্থান কামনা করেছেন। সমাজবিদ তাদের কেউ কেউ সুশাসনের অভাবকে এ অস্বাভাবিক অবস্থার জন্য দায়ী করেছেন। কারণ, সুশাসন হলো সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যম। রাষ্ট্রের সার্বিক নেতৃত্ব যদি সুশাসন নিশ্চিত করার বাহন না হয়, তাহলে সমাজদেহে দুর্নীতি, দুরাচার ও দুষ্কৃতি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ক্ষমতা যদি অবাধ হয়, তাহলে অন্যায়ও অবাধ হবে। মুখে মুখে কথার ফুলঝুরি আর কার্যত বিপরীত ব্যবস্থা অবস্থার কোনো উন্নতি করতে পারে না। কথায় বলে ‘সার্বিক ক্ষমতা নেতৃত্বকে সার্বিকভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে’। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন তথা ধর্ষণের মতো মহামারীর মূলোৎপাটনের জন্য একটি নৈতিক বিপ্লব প্রয়োজন। সমাজ-রাষ্ট্রের পরিবর্তনের প্রয়োজনে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের অদল-বদল প্রয়োজন। তেঁতুলগাছ থেকে মিষ্টি আম খাওয়ার আবদার বৃথাই প্রয়াস।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা