আমরা কিসে বেশি ছাড় দিচ্ছি?
- মীযানুল করীম
- ১১ মে ২০১৯, ১৮:১৩
গত ২ মে, বৃহস্পতিবার। বৈশাখের তপ্ত দুপুর। দুপুর প্রায় ১২টায় রাজধানীর মেরাদিয়া বাজারের এক গোশত দোকানে গিয়েছিলেন এক ক্রেতা। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত মূল্য ‘গরুর গোশত প্রতি কেজি ৫২৫ টাকা’ লেখা ব্যানার দোকানে ঝুলানো ছিল। তবু বিক্রেতা এর দাম চাইলেন সাড়ে ৫ শ’ টাকা। তা না হলে নাকি দোকানির ‘পোষাবে না’। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে আসে ভোক্তাঅধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিদর্শন টিম। তাদের অভিযানে ‘বিপদ’ ঘটার আঁচ পেয়ে ‘কবির মাংসবিতান’-এর সে দোকানি তার সব গোশত দোকানে রেখেই পগারপার।
এদিকে, পরিদর্শকরা বিভিন্ন দোকানে মূল্যতালিকা মানা হচ্ছে কিনা যাচাই করে দেখেন। জরিমানার ভয়ে পালানো দোকানির ৪০ কেজি গরুর গোশত জব্দ করে মাদরাসা ও এতিমখানায় দিয়ে দেয়া হয়েছে। মেরাদিয়া বাজারের আটটি গোশত দোকান আর একটি সুপারশপকে পরিদর্শকদের টিম মোট ৪১ হাজার টাকার মতো জরিমানা করেছে সেদিন।
রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র পবিত্র মাহে রমজানে নিত্যপণ্যের অকারণ মূল্যবৃদ্ধির অসৎ প্রবণতা অতীতের মতো এবারো পরিলক্ষিত হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন টিমের দমন অভিযান চালানোর দৃশ্যত তোড়জোড় চললেও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যও অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় একটি পত্রিকার রম্য ম্যাগাজিনের প্রধান শিরোনাম ‘দুঃখ বলি কারে, দামটা খালি বাড়ে।’ বাংলাদেশে ওপরে উঠে অনেক কিছুই আবার নেমে যায়। তবে এ দেশের বাজারে জিনিসপাতির দাম বিনা কারণে একবার ওপরে উঠলে, আর নামে না সাধারণত। সরকার যেন এসব দেখেও না দেখার ভান করে; আর সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চলতেই থাকে।
একটি পত্রিকা দুঃখের সাথে লিখেছে, “রমজান এলেই আমাদের দেশে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। জন্মের পর থেকে আমরা এই চিত্রের সঙ্গে পরিচিত। অথচ খবরে দেখলাম, রমজান উপলক্ষে আরব আমিরাতে চলছে দাম কমানোর প্রতিযোগিতা। মুসলিম দেশগুলো সাধারণত রমজান এলে দাম কমানোর চিন্তা করে; কিন্তু আমরা সবাই নিজেদের ‘সাচ্চা মুসলিম’ দাবি করলেও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে কোনো ডিসকাউন্ট দিতে রাজি হই না।”
আসলে আমাদের এই কপালপোড়া দেশেও ডিসকাউন্ট বা ছাড় দেয়া হয়। তবে এর লাভের হিসাব বুঝতে হলে একটু অঙ্ক কষতে হবে এবং ছাড়ের খেলায় সবার কপাল পুড়লেও কিছু অর্থগৃধনু কারবারির (এদের মধ্যে চোরাকারবারিও আছে) কপাল খুলে যায়। অঙ্কের ধরন হলো, ‘১০০ টাকার পণ্যের মূল্য ১৩০ টাকা করার কিছু দিন পর ১০ শতাংশ কমানো হলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকে কি কোনো লোকসান দিতে হবে?’ আসলে এই বিক্রেতার মুনাফা হবে ১০০ টাকায় ১৭ টাকা।
যা হোক, আরব আমিরাতে এবারো রোজার মাসে পণ্যবিক্রির বেলায় ছাড় দেয়া হচ্ছে এবং তার পরিমাণও কম নয়- একেবারে ৫০ শতাংশ। মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে প্রতি বছর রোজায় মূল্যহ্রাসের কথা জানা যায়। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশে মাহে রমজানে বিপরীত চিত্র। এ মাসকে মুমিন মুসলমানের পকেট খালি করার মোক্ষম মওকা হিসেবে অসৎ ব্যবসায়ীরা মনে করেন।
এবারো রোজা উপলক্ষে মজুতদার-চোরাচালানি-কালোবাজারি মার্কা দুই নম্বরী সওদাগরেরা তাদের মুনাফা লুণ্ঠনের অন্যায়-অনৈতিক প্রতিযোগিতায় কয়েক শ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে বলে একজন অর্থনীতিবিদ অভিযোগ করেছেন। পত্রিকার একটি লেখায় এক লেখক ক্ষোভের সাথে উল্লেখ করেছেন, ‘ব্যবসায়ীদের যারা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের অনেকে তারাবির জামাতে অংশ নিয়ে এরপর ফোনে নিজের লোকজনকে বলে দেয়, পরদিন জিনিসের দাম কত বাড়ানো হবে।’ এই মন্তব্যে অতিরঞ্জন আছে বলে যদি ধরেও নেয়া হয়, তবুও স্মরণ করিয়ে দিতে হয় কুরআনের সূরা মাউনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার সে সাবধানবাণী। তিনি এতে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন ওদের, যারা নামাজ পড়ে লোক দেখানো। এই শ্রেণীর মানুষেরা যতই টুপি দাড়ি আতর খেজাবের বাহ্যিকতার প্রদর্শনী করুক না কেন, ইসলামের সুমহান মানবিক চেতনা থেকে তারা বঞ্চিত। তাদের দেখে ইসলামের সাম্য ও ন্যায়নীতির আদর্শ সম্পর্কে বিভ্রান্ত বা হতাশ হওয়ার হেতু নেই। ইসলামকে নিজ সুবিধামতো ব্যবহার করে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণীর ফায়দা হাসিলের কায়দা যারা অবলম্বন করছে, তাদের ভূমিকা ও আচরণের জন্য ইসলাম একটুও দায়ী হতে পারে না। এজন্য ওরা নিজেরাই দায়ী এবং এর পরিণাম তাদের ভোগ করতে হবে অবশ্যই।
প্রতি বছর আমাদের বাংলাদেশে রোজার সময় ছাড়ের ধুম পড়ে যায় দৃশ্যত। সরলমনা ও সীমিত আয়ের মানুষ এতে বিভ্রান্ত হয়ে আকর্ষণ বা প্রলোভন বোধ করে। যে পণ্য বা পরিষেবার সাথে মাহে রমজানের কোনো সম্পর্ক নেই, তার ব্যবসায়ীরাও এ সময় ছাড় দিয়ে গ্রাহকদের মন পেতে উঠেপড়ে লেগে যান। পণ্যের বা পরিষেবার ওপর যতই ছাড় দেয়া হোক, সে তুলনায় কার্যত অনেক বেশি ‘ছাড়’ দেয়া হয়
শালীনতা-ঐতিহ্য-মূল্যবোধ-ধর্মের শিক্ষা-স্বকীয় কৃষ্টির ক্ষেত্রে। রমজান মওসুমে আধুনিকতা ও ফ্যাশনের ধুয়া তুলে এসব ব্যাপারে এত বেশি অবাঞ্ছিত ছাড় দেয়া হচ্ছে যে, বলা যায়- আমল প্রমাণ করছে ঈমান কতটা বাকি আছে। ইসলামের আদেশ-অনুশাসনের প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে তাকওয়া হাসিলে ব্রতী হওয়াই রমজান মাসে আমাদের সবার দায়িত্ব। কিন্তু এদিক দিয়ে আমরা সচেতনভাবে অথবা অজ্ঞতাবশত যে ফরংপড়ঁহঃ দিয়ে যাচ্ছি, তাতে আমাদের সত্যিকার মুসলিম হিসেবে পড়ঁহঃ হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে যাচ্ছে।
রমজান হলো সংযম সাধনা ও ত্যাগ তিতিক্ষার মাহিনা। বাস্তবে মনে হয়, একথা ‘কাজীর গরু’র পরিণতি বরণ করে গোয়াল থেকে উধাও হয়ে কেবল কেতাবের পাতায় সীমিত থাকবে। তা না হলে, রোজাকে যারা ‘বোঝা’ মনে করে, এ সময় তারা ত্যাগের বিপরীতে ভোগ এবং সংযমের বিপরীতে সম্পদের উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে কেমন করে? চার পাশের প্রচারণা আর মিডিয়ার মোচ্ছব দেখে এটা ভেবে ভুল হতে পারে যে- রমজান মাস শুধু ভোজন নয়, রাজসিক ভোজেরও মওসুম; শুধু দরকারি জিনিস কেনা নয়, লাখ লাখ টাকা ঢেলে ক্যালকাটা-ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর গিয়ে শপিংয়ের সিজন। এক দিকে, এই গরিব দেশে ‘মাত্র’ ৫৫০ টাকায় ইফতারি আর ‘মাত্র’ ১১৯৯ টাকায় ডিনারসহ ইফতারির ডাবল প্যাকেজ (তা-ও ‘বুফে’র বদলে ভুল ‘বাফেট’ লেখা) এর প্রপাগান্ডা। অন্য দিকে, কবি নজরুলের ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা,/ ক্ষুধায় আসেনি নিঁদ।’ শেষোক্ত শ্রেণীর সদস্য সংখ্যা এই ডিজিটাল তরক্কির ভারিক্কি চালের আমলেও এদেশে কয়েক কোটি! পানি খেয়ে সাহারি আর উচ্ছিষ্ট দিয়ে ইফতারি এবং রোজার শেষ দিকে লোক দেখানো জাকাতদাতাদের প্রাসাদের গেটে ভিড় চাপা পড়ে পটল তোলাই এই বনি আদমদের বরাত। ইংরেজিতে এদের নাম Teeming Millions.
মাহে রমজান ত্যাগ-তিতিক্ষা, ধৈর্য ও সংযমের মাস। এটা বিক্রেতা হয়ে ক্রেতার পকেট কাটা কিংবা হাল ফ্যাশনের জামা কাপড় কেনাকাটার মহোৎসবের মওসুম নয়। রমজান মাসে দিনভর অভুক্ত থেকে ভুখা-নাঙ্গা মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করে তাদের সাথে একাত্ম হতে হয়। বাস্তবে যত প্রপাগান্ডা আর তোড়জোড়, তাতে মনে হচ্ছে- রোজার মাসই ভূরিভোজের রকমারি রেসিপি দেয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। আজকাল রোজার মাস এলে বিত্তবানের চিত্ত সানন্দে নেচে ওঠে আর বিত্তহীনের কষ্ট যায় বেড়ে। সীমিত আয়ের চাকরিজীবীদের পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ।
ঈদ বোনাস পেলে তা হাতে আসে রোজার শেষে, কিন্তু রোজার মাসের আগেই বাড়তি দামের বোঝা ঘাড়ে চেপে বসে। রোজা আর ঈদ মিলে খরচ অনেক বেড়ে যায়; কিন্তু চাকুরেদের বেতন তো বাড়ে না!
যা হোক, বাংলাদেশে বিশেষ করে ইফতারি আইটেমসমেত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অনিবার্যভাবেই বেড়ে যায় রোজা উপলক্ষে। এবারো সরকারের হম্বিতম্বি আর বোশেখের গা-জ্বলা গরমের মাঝে বাজার আরো গরম। প্রশাসনের রেগুলার ফোর্স ও টাস্কফোর্সসহ নানা বাহিনী ও টিমের অভিযান, আটক, গ্রেফতার, জরিমানা, জেল ইত্যাদি চলছে। অপর দিকে চলছে মুনাফাখোরদের ব্যবসায়ের নামে গণমানুষের গলাকাটা দামে পণ্য বিক্রির ধুম। এ যেন ‘বকাউল্লাহ’রা বকে যাচ্ছেন আর ‘করাউল্লাহ’রা করে যাচ্ছেন।
কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়ার ‘কারণ’ তুলে ধরেছে একটি পত্রিকা। ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় খেজুর বলছে, এমন অনেক আমদানিকারক আছেন, যার সন্তানের চেয়ে আমার বয়স বেশি। বছরের পর বছর হিমাগারে থাকতে থাকতে আমি আইনত এ দেশের নাগরিক। তাই আমদানি মূল্যের সাথে ৮-১০ বছরের হিমাগার ভাড়া যুক্ত হয়ে আমার দাম বেড়ে যায়।
পাদটীকা : প্রখ্যাত ছড়াকার রফিকুল হক দাদুভাই এবার লিখেছেন, মহাজনরা আছেন জোশে/ গরিব চাষী আঙুল চোষে।/মজুতদারের পোয়াবারো,/ মুনাফা তার চাই যে আরো।/ কার লগে কে পারে,/ দামটা খালি বাড়ে!/ কাঁদছে কারা নাকি কান্না,/ রমজানেতেও কম যান না,/ মওকা তো একটাই,/ লাভের জন্য ব্যবসা করি, ভাই!’। বলছে শুনুন কারা,/ এটাই নাকি তেজারতির ধারা!/
সংযমের মাসকে মুনাফা লোটার মওকা বানাবার এ ধারা কি বন্ধ করা হবে না? লাভের লোভে পড়ে পবিত্র মাহে রমজানকে অপবিত্র করার পাঁয়তারা বন্ধ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
পুনশ্চ : প্রতিবার রোজার মাসে অহেতুক দাম বাড়ে- এমন কিছু নিত্যপণ্যের সংলাপ শুনুন : চাল বলছে- ‘হে হে হে, দাম তো বাড়বোই। গরমটা ক্যামনে বাড়তাছে দেখতে হইবো না!’ এটা শুনে ছোলার উক্তি : ‘দাম বাড়ে, যাতে পাবলিক কম খায়। কম খাইলে শরীর স্লিম থাকে।’ ‘গুণহীন অপবাদের শিকার বেগুনের ‘যুক্তি’ : ‘দাম না বাড়লে তো পাত্তাই দিতে চান না। দাম বাড়ে বইলাই কিন্তু আমাগো মতো গরিবের উপর মিডিয়ার নজরটা পড়ে।’ এদের কথাবার্তা শুনে ‘অভিজাত’ গোমাংস কী চুপ থাকতে পারে? সে-ও মুখ খুলেছে- ‘আমার দাম হুজুগে বাড়ে। অনেক কিছুর দাম বাড়ে এ সময়ে। আমারটা না বাড়লে কি ইজ্জত থাকে?’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা