দুর্নীতির দেশ-দেশান্তর
- সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
- ১০ মে ২০১৯, ২২:১০
আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে নানাবিধ বাধা থাকলেও প্রধান অন্তরায় হচ্ছে লাগামহীন দুর্নীতি। ‘দুর্নীতিমুক্ত’ বলা যাবে রাষ্ট্রের এমন কোনো খাত বা বিভাগ নেই। সঙ্গত কারণেই আমাদের দেশে দুর্নীতির বিস্তৃতি এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে, যা আমাদের জাতিসত্তাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ক্রমবর্ধমান ও নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা গেলে প্রতি বছর জিডিপি ২ শতাংশ বাড়ানো যাবে।
দুদক সূত্রও বলছে, দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৮ হাজার কোটি টাকা মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যোগ হতে পারছে না। এই হিসাব অবশ্য রক্ষণশীলভাবে করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। তারা মনে করেন, জিডিপির চলতি মূল্যকে ভিত্তি ধরে হিসাব করলে বছরে অঙ্কটা দাঁড়াবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
দুর্নীতি শুধু আমাদের জাতীয় সমস্যা নয় বরং এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যাও। যদিও আমাদের দেশের দুর্নীতির বৃত্ত ও পরিসর অন্যদের চেয়ে ভিন্নতর। দুর্নীতি প্রত্যেক জাতি-রাষ্ট্রেই কমবেশি রয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিশ্বে প্রতি বছর দুই লাখ কোটি ডলার গচ্ছা যাচ্ছে। অথচ এই অর্থ দিয়ে বিশ্বের চারটি বড় সমস্যার সমাধান সম্ভব। সমস্যাগুলো হচ্ছে ক্ষুধা নিবারণ, ম্যালেরিয়া দূর, অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন এবং শিশুদের মৌলিক শিক্ষা দেয়া।
২০১৭ সালে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) এক প্রতিবেদনে এমন ভয়াবহ চিত্রই উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে ক্ষুধা নিবারণ নিয়ে বলা হয়েছে, ইয়েমেন থেকে মাদাগাস্কার পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং দুর্ভোগের শিকার বিশ্বের অগণিত মানুষ। সব মিলিয়ে বিশ্বের ৮০ কোটি মানুষ ঠিকমতো খেতে পায় না। জাতিসঙ্ঘের হিসাব মতে, বছরে ১১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার ব্যয় করলে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
দুর্নীতি দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো আদর্শের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অসাধুতা বা বিচ্যুতিকে নির্দেশ করে। বৃহৎ পরিসরে ঘুষ দেয়া, সম্পত্তি আত্মসাৎ, সরকারি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করাও দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত সুনীতির বিপরীত শব্দই হচ্ছে দুর্নীতি। রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক মরিস লিখেছেন, ‘দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার’।
দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা হলেও এর পরিসর ও প্রকোপ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তুলনামূলক বেশি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব রাষ্ট্রে গণসচেতনা ও দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার ক্রমেই বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরাও ঢাকঢোল কম পেটাচ্ছি না। তবে আমাদের ক্ষেত্রে খাজনার চেয়ে বাজনাটা বেশ বেশি বলেই মনে হয়। বাস্তবতার সাথে তার যে তেমন একটা সামঞ্জস্য নেই, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার গবেষণায়।
বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০১৮ অনুযায়ী ২০১৭ সালের তুলনায় আমাদের দেশের স্কোর ২ পয়েন্ট কমেছে এবং নিম্নক্রম অনুযায়ী অবস্থানের চার ধাপ অবনতি হয়েছে। বৈশ্বিক গড় স্কোরের তুলনায় বাংলাদেশের ২০১৮ সালের স্কোর যেমন অনেক কম, তেমনি গতবারের চেয়ে ২ পয়েন্ট কমে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোর ও অবস্থানে থাকায় দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
২০১৮ সালে ০-১০০ স্কেলে ২৬ স্কোর পেয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার নিম্নক্রম অনুযায়ী আমাদের অবস্থান ১৩তম, যা ২০১৭ এর তুলনায় ৪ ধাপ নিম্নে এবং ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী ১৪৯তম এবং ২০১৭ এর তুলনায় ৬ ধাপ অবনতি। এ ছাড়া ২০১৭ সালের তুলনায় বাংলাদেশের স্কোর ২ পয়েন্ট কমেছে। এক বছরেই দুই পয়েন্ট স্কোর কমে যাওয়াটা উদ্বেগজনকই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, সূচকে অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে এবারো বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। আর এশিয়া প্যাসিফিকের ৩১টি দেশের মধ্যে অবস্থান চতুর্থ সর্বনিম্ন।
২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মতো আমরা এখন সর্বনিম্ন অবস্থানে না থাকলেও আত্মতুষ্টির কোনো কারণ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান এখনো অত্যন্ত ভঙ্গুর এবং বৈশি^ক গড়ের তুলনায় অত্যন্ত নিচে। আমাদের দুর্নীতিবিরোধী রাজনৈতিক ঘোষণা থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগটা চোখে পড়ার মতো নয়। দেশে উচ্চপর্যায়ে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেসব বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
আমাদের জনপ্রশাসন ও রাজনীতিতে স্বার্থের দ্বন্দ্বটাও উপেক্ষা করার মতো নয়। এ ছাড়াও ব্যাংক ও অর্থনৈতিক খাতে লাগামহীন দুর্নীতি ও বিচারহীনতা; সারা দেশে ভূমি, নদী, জলাশয় দখলের প্রবণতা, রাষ্ট্রীয় ক্রয় খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, ক্রমবর্ধমান এবং আশঙ্কাজনকভাবে দেশ থেকে অবৈধ অর্থপাচার এবং রাষ্ট্রীয় নিয়োগের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা আমাদের ভালো স্কোর না হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয়।
সরকারের পক্ষে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা দেয়া হয়েছে বা প্রতিনিয়তই দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এই ঘোষণার কার্যকর প্রয়োগ এবং কোনো ক্ষেত্রেই ভয় বা অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে এর যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত হওয়া দরকার। এ জন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে একটি জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কৌশল প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বহুমুখী ও সময়াবদ্ধ এমন একটি কৌশল স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠুভাবে পরিবীক্ষণসহ বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা অবশ্যই এ সূচকে ভালো ফল করতে পারব বলে আশা করা যায়। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা ও নির্লিপ্ততার কারণে তা বাস্তবরূপ পাচ্ছে না।
প্রাপ্ত তথ্যমতে দুর্নীতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এ হিসাব করা হয়েছে ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে। যে দেশ যত দুর্নীতিমুক্ত সে দেশের তত পয়েন্ট। হিসাবে দেখা যায় যে, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সোমালিয়া। দেশটির পয়েন্ট ১০০তে মাত্র ১০। এরপর কয়েকটি দেশের পরে আছে সিরিয়া। দেশটির পয়েন্ট মাত্র ১৩।
এরপর ১৪ পয়েন্ট নিয়ে অবস্থান করছে লিবিয়া, সুদান ও ইয়েমেন। এরপর ইরাকের আছে ১৭, লেবাননের আছে ২৮। মূলত আরব বিশ্বের নয়টি দেশ ও ভূখণ্ডে (ফিলিস্তিন) গত বছর পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে বলে মনে করে সেসব দেশের সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে গভীর সঙ্কটে পড়া লেবানন ও যুদ্ধবিধস্ত ইয়েমেনের অবস্থা বেশি উদ্বেগজনক।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে, প্রায় ১১ হাজার অংশগ্রহণকারী মতামতের ভিত্তিতে পাওয়া জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, এ অঞ্চলের দুর্নীতি বেড়ে যাওয়া দেশগুলো হলো আলজেরিয়া, মিসর, জর্দান, মরক্কো, ফিলিস্তিন, সুদান ও তিউনিসিয়া। দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, আরব দেশগুলোর বেশির ভাগ নাগরিক মনে করেন, সম্প্রতি এসব দেশে দুর্নীতি বেড়েছে।
আবার অনেকে মনে করেন, সরকারি কর্মকর্তা ও পার্লামেন্ট সদস্যরা ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে লেবাননের ৯২ শতাংশ, ইয়েমেনের ৮৪ শতাংশ, জর্দানের ৭৫ শতাংশ মনে করেন দেশগুলোতে দুর্নীতি বেড়েছে। বিপরীতে মিসরের ২৮ শতাংশ ও আলজেরিয়ার ২৬ শতাংশ মনে করেন তাদের দেশে দুর্নীতি বেড়েছে।
জরিপে যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ ইয়েমেনি ও প্রায় অর্ধেক মিসরীয় বলেন, সরকারি সেবা পেতে তাদের ঘুষ দিতে হয়েছে। একই কথা বলেন তিউনিসিয়ার ৯ শতাংশ ও জর্দানের ৪ শতাংশ সাক্ষাৎকার প্রদানকারী। দুর্নীতি কোনো প্রয়োজনের তাগিদ নয় বরং একটি মানসিক বিকারগ্রস্ততা মাত্র। অবৈধ অর্থ লিপ্সাই এর অন্যতম কারণ।
আমাদের দেশের দুর্নীতি একটি চলমান সমস্যা। যদিও এই সূচক মাঝে মধ্যে ওঠানামা করে। সে ধারাবাহিকতায় আমরা ২০০৫ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত তালিকায় পৃথিবীর তৎকালীন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে স্থান লাভ করেছিলাম। ২০১১ এবং ২০১২ সালে আমরা তালিকার অবস্থানে যথাক্রমে ১২০ এবং ১৪৪তম স্থান লাভ করি, যেখানে কোনো দেশ নম্বরের দিক থেকে যত উপরের দিকে যাবে ততই বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে গণ্য হবে।
বস্তুত, ভোগবাদী মানসিকতাই লাগামহীন দুর্নীতির ক্ষেত্রে প্রধানত দায়ী। আমাদের দেশে প্রায় সব শ্রেণীর মানুষ ঘুষ গ্রহণ করে বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগের সত্যতা মেলে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর আত্মস্বীকৃতি থেকে। তার ভাষায়, যেহেতু দুর্নীতি সবাই করে তাই তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের সহনশীল মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বেশ আলোচনায় এসেছিলেন।
সাবেক অর্থমন্ত্রীও এ ক্ষেত্রে কম যাননি। তিনি ঘুষকে ‘স্পিড মানি’ আখ্যা দিয়ে দুর্নীতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন বলে কেউ কেউ মনে করেন। উচ্চপর্যায়ের কর্তারা মূলত অনৈতিকভাবে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে গিয়ে ঘুষ গ্রহণকে তাদের অভ্যাস ও অবিচেছদ্য অংশে পরিণত করেছেন। মধ্যবিত্তরা ও নিম্নবিত্তরাও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ঘুষ গ্রহণ করে থাকে। তাই আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি এখন অপ্রতিরোধ্যই বলা যায়।
আমাদের দেশে দুর্নীতি ছিল এবং এখনো আছে বলেই অতীতে দুর্নীতি দমন ব্যুরো ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটির উপর্যুপরি ব্যর্থতার কারণেই তা এখন কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। স্থলাভিষিক্ত হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের আহামরি কোনো সাফল্য নেই। মূলত সরকারের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে দুর্নীতিবিরোধী কোনো কার্যক্রমই সফলতা পাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য না হলে সব প্রচেষ্টাই যে নিষ্ফল হবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
smmjoy@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা