তারিখ-ই-ডিজিটাল শাহী!
- গোলাম মাওলা রনি
- ০৯ মে ২০১৯, ১৭:৪৮
মধ্যযুগের রাজদরবারগুলোতে নিয়মিত বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে অত্যন্ত উঁচু পদে বড় বড় ঐতিহাসিককে নিয়োগ দান করা হতো। তারা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, ধর্ম-কর্ম, বিয়েশাদি থেকে শুরু করে চুরি-ডাকাতি, যৌন নির্যাতন, পতিতা বৃত্তি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ইতিহাস রচনা করতেন। কালের বিবর্তনে সেসব ইতিহাসের অনেক কিছুই মহাকালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। মধ্যযুগের প্রায় পুরো সময়জুড়ে দুনিয়াব্যাপী মুসলিম শাসনের স্বর্ণযুগ চলছিল। ফলে প্রতিটি রাজদরবারে আরবি ও ফারসি ভাষার প্রচলনের পাশাপাশি জাজিরাতুল আরব, পারস্য ও মধ্যএশীয় পণ্ডিতদের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। ওই সময়ে ইতিহাসবিদ এবং মুসলিম পণ্ডিতবর্গ যেসব বই লিখেছেন, সেগুলোর মধ্যে প্রধানত দু’টি শ্রেণী ছিল। এক ধরনের বই ছিল, যেগুলো মূলত রাজা-বাদশাহদের রাজত্বের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি ধারণ করত। এ ধরনের বইয়ের শিরোনাম হতো তারিখ-ই ফিরোজ শাহী, তারিখ-ই রিয়াজুস সালাতীন ইত্যাদি। মধ্যযুগের কোনো আরবি পণ্ডিত যদি বর্তমান জমানায় বাংলাদেশে আবির্ভূত হতেন, তবে তিনি তারিখ-ই-ডিজিটাল শাহী শিরোনামে কী লিখতেন, সেই কল্পিত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে মধ্যযুগীয় ইতিহাস রচনা নিয়ে আরো কিছু আলোচনা করা যাক।
মধ্যযুগের মুসলিম ইতিহাসবিদ বা ঐতিহাসিকেরা বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে যেমন ইতিহাস লিখেছেন, তেমনি রাজানুগ্রহ লাভ করে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভ্রমণ করে পর্যটক হিসেবে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের ওপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচনা করেছেন। অনেকে আবার রাজানুগ্রহ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবেও ইতিহাস রচনা করেছেন। তারা রাজা-বাদশাহদের রাজত্বকাল নিয়ে যেমন ইতিহাস লিখতেন, তেমনি রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহ ও সেনাপতিদের অনুরোধে লিখে দিতেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিগত ইতিহাস; যার শিরোনামগুলোও শুরু হতো ‘তারিখ’ দিয়ে। বর্তমান বাংলাদেশের তিনজন আলোচিত রাজনীতিবিদ যথা- ড. কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে যদি সে আমলের ইতিহাসবেত্তারা বই রচনা করতেন, তবে সেগুলোর শিরোনাম হতো তারিখ-ই-আল কামাল, তারিখ-ই-আল ফখরুল এবং তারিখ-ই-আল কাদের। ইতিহাসবিদ ছাড়াও অনেক পণ্ডিত রাজা-বাদশাহ নিজ হাতে আত্মজীবনী লিখতেন, যেগুলোর শিরোনাম হতো তুযুকে বাবুরী, তুযুকে জাহাঙ্গীরী ইত্যাদি। কাজেই অতীতকালের মতো বর্তমান বাংলার রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহ, পাইক-পেয়াদা-আরদালিরা যদি নিজ হাতে নিজেদের ইতিহাস লিখতেন, তবে সেগুলোর বিষয়বস্তু ও শিরোনাম কেমন হতো তা বিবেচনার ভার পাঠকদের ওপর ন্যস্ত করে এবার শিরোনামের ওপর আলোচনায় চলে যাবো।
তারিখ-ই-ডিজিটাল শাহী গ্রন্থের কল্পিত লেখক এবং সে লেখকের বর্ণনায় বাংলাদেশের বর্তমান চালচিত্র কেমন হতে পারে, তা গ্রন্থকারের নিজের জবানিতেই শুনুন-
আমি মরক্কো নামক দেশের মরুভূমি অঞ্চলের বাসিন্দা। দুর্গম মরুভূমির ঊষরতম অঞ্চলে একাকী বসবাস করা আমার প্রধানতম অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ২০১৯ সালের যে সময়টিতে আমি আধুনিক মরক্কোর সুসজ্জিততম রাজধানী রাবাত থেকে বহুদূরে অবস্থিত আগচেবি নামক বালির পাহাড়ে বসবাস করছি, তখন সারা দুনিয়ার মানুষ জ্যামিতিক হারে শহরমুখী হচ্ছে। আমার দেশ মরক্কো পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম নামকরা দেশ। এ দেশের পাহাড়, সমতল ভূমি, সমুদ্রতট, আটলান্টিক মহাসমুদ্রের বেলাভূমি, মরুভূমি এবং সুন্দরতম নর-নারী সেই অনাদিকাল থেকে পৃথিবীর নামকরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে পঙ্গপালের মতো মরক্কোর পানে টেনে এনেছে। অন্য দিকে; মরক্কোর উদার আকাশ-বাতাস-প্রকৃতি ও পরিবেশ বহু জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, রাজা-বাদশাহ এবং পর্যটক সৃষ্টির পাশাপাশি আমার মতো অদ্ভুত চরিত্রের ঐতিহাসিকের জন্ম দিয়েছে; যে কিনা আধুনিক সভ্যতাকে দূরে সরিয়ে বালুর পাহাড়ে বাস করে এবং সেই পাহাড়ের চূড়ায় বসে মরুভূমির উত্তপ্ত বৈকালিক বাতাসে দোল খেতে খেতে দেশ-বিদেশের ইতিহাস লেখে।
আমি মরুভূমির বাসিন্দা হলেও আধুনিক জগতের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, আচার-ব্যবহার এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে খোঁজখবর রাখি আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে। পৃথিবীর সাম্প্রতিকতম শিল্পবিপ্লব, কম্পিউটার প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা কিংবা পারমাণবিক আবিষ্কারের সর্বশেষ অথবা হালনাগাদ অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য পৃথিবীর নামকরা শহর-বন্দরে ঘুরে বেড়াই এবং কাজ শেষে বালুর পাহাড়ে ফিরে এসে ইতিহাস রচনা করি। আমার রচিত ইতিহাস গ্রন্থগুলো সারা দুনিয়ায় বহুলভাবে পঠিত এবং পৃথিবীর নামকরা পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে সবিশেষ আলোচিত এবং প্রশংসিত। এ কারণে আমার যেমন বহু বন্ধুবান্ধব রয়েছে, তেমনি রয়েছে অসংখ্য সমালোচনাকারী এবং ঈর্ষাপরায়ণ শত্রু, যাদের সবার হালনাগাদ অবস্থা বুঝতে পারি সামাজিক মাধ্যমগুলোতে আমার লেখালেখির ওপর তাদের নানামুখী মন্তব্য ও গালিগালাজ দেখে। আমি প্রতিটি সমালোচনা ও গালিগালাজের মধ্যে আমার অস্তিত্ব, সংশোধন ও কর্মপ্রেরণা খুঁজে পাওয়ার এক অভিনব পন্থা আবিষ্কার করে ফেলেছি; যা দিয়ে নিত্যনতুন ইতিহাস রচনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়।
সামাজিক মাধ্যমে আমাকে যারা গালাগালি করেন, তারাই একদিন আমাকে বাংলাদেশের ডিজিটাল সরকারের কথা জানালেন। ডিজিটাল শব্দটি আধুনিক প্রযুক্তির জগতে সগৌরবে ব্যবহৃত হতো বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। উন্নত দেশগুলো ডিজিটাল প্রযুক্তিকে ‘সেকেলে’ আখ্যা দিয়ে নবতর প্রযুক্তির পথে অগ্রযাত্রা শুরু করেছে নব্বইয়ের দশক, অর্থাৎ আজ থেকে ৩০ বছর আগেই। আমি আমাজনের জঙ্গলে, সাহারার মরুভূমি, আলপস পর্বতমালার দুর্গম অঞ্চল ও আফ্রিকার দুর্ভেদ্য অঞ্চলে একবিংশ শতাব্দীর গত দশকে, অর্থাৎ ২০১০-১১ সালের দিকে যে প্রযুক্তি দেখেছি, তা আমাকে যারপরনাই বিস্মিত ও অভিভূত করেছে। আলট্রা সাউন্ড, ইথার ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সমন্বয়ে সর্বাধুনিক নিউট্রন প্রযুক্তি যখন বিশ্ববাসীর নিকট সহজলভ্য, তখন বাংলাদেশে ডিজিটাল সরকার কী কী ডিজিটাল বিপ্লব ঘটাচ্ছে, তা দেখার জন্য বালুর পাহাড় থেকে নেমে দৌড় মেরে চলে এলাম আমার ভুবনবিখ্যাত পূর্বসূরি ইবনে বতুতা বর্ণিত দোজখপুর জান্নাতের রাজধানী, ঢাকা নগরীতে।
আধুনিক ঢাকার কথিত ডিজিটাল বিপ্লব ও ডিজিটাল সরকারের অভিনব কর্মকাণ্ড সরেজমিনে দেখার জন্য আমি বাংলাদেশের রাজধানীর অলিগলি চষে বেড়িয়েছি। তারপর ইবনে বতুতার মতো ছুটে গিয়েছি পথে বা প্রান্তরে, ফসলের মাঠে, হাট-বাজারে এবং ধর্মালয়গুলোতে। আমি কথা বলেছি রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মেহনতি মানুষজনের সাথে। সমাজের ব্যথা-বেদনা বোঝার জন্য ভিক্ষুক, পঙ্গু, অসুস্থ রোগী এবং অভাবী মানুষের সাথে মতবিনিময় করেছি। সমাজের পুঁজরক্ত, দুর্গন্ধ ও অন্ধকারময় বিষাক্ত আবহাওয়ার পূর্বাভাস লাভের জন্য চোর-ডাকাত, গুণ্ডা-বদমাশ, চাঁদাবাজ, ধর্ষণকারী, জেনাকার, পতিতা, পতিতার দালাল ও পতিতালয়ের রক্ষক-ভক্ষকদের পাশাপাশি জুয়াড়ি, জুয়ার আড্ডা এবং মদ-মেয়েমানুষের জমজমাট মঞ্চগুলোতে ঢুঁ মেরে ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা-অসুবিধা মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি বহুমাত্রিক অ্যালগরিদমের সূত্র প্রয়োগ করে। আমার ঢাকা ভ্রমণের প্রথম রাতের চমক ছিল, শেফালী নামের এক যুবতীর অভিনব সাক্ষাৎকার। শেফালীকে প্রথম রাতে যেভাবে এবং যে অবস্থায় দেখেছি, তা দুনিয়ার কোনো দেশের রাজধানীতে কস্মিকালেও সম্ভব হতো না। অন্য দিকে প্রথম সাক্ষাতে শেফালী আমাকে যা বলল, তাও কিয়ামত পর্যন্ত ভুলতে পারব না। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বললেই পাঠকেরা ডিজিটাল বাংলাদেশের টালমাটাল উন্নয়নের একটি বাস্তবচিত্র পেয়ে যাবেন।
ঘটনার রাতে আমি ঢাকার প্রাণকেন্দ্র হাইকোর্ট চত্বর পার হয়ে মৎস্য ভবনের সামনে এলাম। রাত তখন আনুমানিক ৯টা। আমার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ এবং প্রায় সমবয়স্ক একজন নারী। তাদেরকে জোগাড় করেছি ইন্টারনেটের মাধ্যমে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে। তারা আমাকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে নিয়ে যাবেন এবং পথপ্রদর্শক, অনুবাদক ও স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে আমাকে সাহায্য করবেন। আমার সঙ্গী-সাথীরা পরামর্শ দিলেন, যদি মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত হেঁটে যাই, তবে অনেক চমকপ্রদ জিনিস দেখতে পাবো। তারা জানালেন, রাস্তাটি ‘ভিআইপি সড়ক’ বলে সরকারি নথিপত্রে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং একই সাথে নগরীর ব্যস্ততম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বলেও বেশ পরিচিত। আমি শাহবাগ যাওয়ার পথে প্রাণভরে যা দেখতে পেলাম, তার সাথে ডিজিটালের কোনো সম্পর্কসূত্র না পেয়ে যখন হতাশ হয়ে পড়লাম, ঠিক তখনই শেফালীর দেখা পেলাম, ঠিক যেন বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের মতো করে।
আমি যখন শেফালীকে দেখলাম, তখন সে প্রাকৃতিক কর্মসম্পাদনে ব্যস্ত ছিল। রাস্তা ও ফুটপাথের মাঝে যে সামান্য ঢালু জায়গা রয়েছে সেখানে বসে শেফালী এমনভাবে জল বিয়োগ করছিল, যা চলাচলকারী পথচারী গণপরিবহনের যাত্রী এবং অন্য মানুষের দৃষ্টি এড়ানো সম্ভব ছিল না। শেফালী নামক মেয়েটির বয়স হয়তো একুশ বা বাইশ বছরের বেশি হবে না। সে অনেকটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সে কাজ করে উঠে দাঁড়াল এবং এক হাতে পাজামা সামাল দিয়ে অন্য হাত দিয়ে মোবাইলে কার সাথে যেন উচ্চস্বরে খিস্তিখেউড় চালাতে আরম্ভ করল। শেফালীর কর্মকাণ্ড দেখে থমকে দাঁড়ালাম এবং তার সাথে কথা বলার জন্য আগ্রহ দেখালাম। আমার সঙ্গী-সাথীরা আমাকে বারণ করলেন এবং জানালেন, শেফালীর মতো মেয়েরা রাত ১০টার পরে এসব গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ‘সংসার’ পেতে বসে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শ্রমজীবী, কেউ বা মাদক ব্যবসায়ী, আবার অনেকে ভ্রাম্যমাণ পতিতা। তারা সবাই মিলে রাতের ফুটপাথে আপন আপন কর্ম চালিয়ে যায় কারো সাথে কোনো বিরোধ না করে। এই ছিন্নমূল মানুষেরা জনপ্রতি ১০ টাকা চাঁদা দিয়ে এক রাতের জন্য ফুটপাথকে নিজেদের ঘরবাড়ি বানিয়ে নির্ভয়ে আপনকর্ম চালিয়ে যায়। পতিতারা খদ্দেরদের সাথে যখন রঙ্গলীলা করে, ঠিক তখনই পাশের মানুষ হয়তো নির্লিপ্তভাবে অঘোরে ঘুমাতে থাকে।
সঙ্গী-সাথীদের পরামর্শে আমি শেফালীর সাথে কথা বলার ব্যাপারে মত পরিবর্তন করলাম, কিন্তু তারপরও নিয়তি আমাকে ছাড়ল না। স্বয়ং শেফালী আমার দিকে এগিয়ে এলো। সে বেশরমভাবে আমার নিকট নিজেকে তুলে ধরল এবং জনবহুল ফুটপাথে নিজের পারিশ্রমিক নিয়ে দরদাম করতে থাকে। সে জানাল, তার কর্মের ধরনের ওপর তার পারিশ্রমিক নির্ভর করে। সে তার কমদামি চাইনিজ মোবাইলে একটি পর্নো ভিডিওর লিংক দেখিয়ে বলতে থাকে, ফুটপাথে বসে নির্বিঘ্নে এভাবে কার্য সম্পাদন করলে এক ঘণ্টার জন্য ৫০০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। আমি বারবার শেফালী, তার মোবাইল এবং কিছুক্ষণ আগে তার কাজগুলোর দৃশ্যের মধ্যে অন্ত্যমিল খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। শেফালীর রাতের কর্মস্থলের দৃশ্যও আমাকে যারপরনাই অস্থির ও উৎকণ্ঠিত করে তুলল। ফুটপাথের পাশে দেয়ালের সাথে একটি রঙিন পলিথিন টানিয়ে যে স্থানটি তৈরি করা হয়েছে, ওটার মধ্যে দু’জন নরনারী রাস্তার কোলাহলের মধ্যে বলতে গেলে প্রকাশ্যে কিভাবে নিজেদের কর্ম করবে, তা ভাবতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে পড়ি। আধুনিক সমাজের নগরজীবনের ডিজিটাল দৃশ্যের অন্তরালে আমি সে রাতে শেফালীর জবানিতে, তার অঙ্গভঙ্গি ও কর্মকাণ্ডে যে বাস্তবতা দেখলাম, তা আমাকে বারবার কেবল প্রযুক্তির পরিবর্তে প্রাগৈতিহাসিক বন্য জীবনের কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল। তখন আনমনে ঢাকার ফুটপাথ বাদ দিয়ে আমার জন্মভূমির বালুর পাহাড়ের লু হাওয়ার কথা চিন্তা করতে থাকলাম।
বাংলাদেশ ভ্রমণের পর আমি মরক্কো ফিরে যাবো এবং বালুর পাহাড়ে বসে অভিনব উপায়ে তারিখ-ই-ডিজিটাল শাহীর ইতিহাস রচনার পাণ্ডুলিপি তৈরি করব। বাংলাদেশের সব কিছুতে আমি যে অস্থিরতা, উত্তেজনা, নিলর্জ্জতা ও নির্লিপ্ততা দেখেছি; তাতে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে খই ফোটানো গরম বালুর ওপর পশ্চাৎদেশ রেখে নিজেকে উত্তপ্ত না বানিয়ে তারিখ-ই-ডিজিটাল শাহী রচনা সম্ভব হবে না। বই লিখতে গিয়ে আমি যখন বাংলাদেশের কথা ভাবব, তখন সবার আগে আমার মনে পড়বে শেফালীর কথা। কারণ বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় যা দেখেছি তার সব কিছুর মধ্যেই শেফালীর দোষ-গুণের অন্ত্যমিল খুঁজে পেয়েছি।
শেফালী যেভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজের কর্মকে লাভজনক ও আরামদায়ক করার বিজ্ঞাপন প্রচার করে, একইভাবে বাংলাদেশের ভদ্রবেশী চোর, ডাকাত, গুণ্ডা-বদমাশ প্রমুখ নিজেদের কুকর্মে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে। শেফালীর যেমন লজ্জা-শরমের কোনো বালাই নেই, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের বিভিন্ন কুকর্মের হোতা-হোতী, নাগর-নাগরী অথবা হংসমিথুন এবং হরিহর আত্মাদেরও কোনো লজ্জা-শরম নেই। শেফালীর মতো মেয়েরা যে কাজ রাত ১০টার সময় করে, তার চেয়েও নিকৃষ্ট কাজ দিনের আলোতে করে বেড়ানো লোকের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। শেফালীর কুকর্মের একটা হেতু আছে এবং রয়েছে নির্দিষ্ট গণ্ডি; কিন্তু এ দেশের দুর্বৃত্তদের কোনো গণ্ডি নেই, নেই কোনো নির্দিষ্ট গতিবেগ বা সীমা-পরিসীমা।
তারিখ-ই-ডিজিটাল শাহী রচনায় যখন হাত দেবো, তখন আমার প্রধানতম সমস্যা হবে পাণ্ডুলিপির পাত্র-পাত্রী, নায়ক-নায়িকা ও বিষয়বস্তু ঠিক করা। আমার অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থের মতো আকর্ষণীয় কাহিনী, দৃষ্টান্তমূলক উপাখ্যান, শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব সৃজন করা আলোচ্য বইতে সম্ভব হবে না। কারণ, বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় সর্বজনশ্রদ্ধেয় অবিতর্কিত এবং সার্থকতায় পরিপূর্ণ কোনো পরহেজগার মানুষকে উঁচু পদে আসীন দেখতে পাইনি। আমি বাংলাদেশের দরিদ্র খেটেখাওয়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দেখেছি একটি অতিশয় অধৈর্য সম্প্রদায় হিসেবে। তারা নিরন্তর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-ফাসাদ, কলহ-বিবাদ ও গিবত করে বেড়ায়। তারা নিজেদের জ্ঞানী আর ধনীদের বোকা মনে করে। তাদের কথাবার্তা কর্কশ এবং রাগ হলে তারা খুবই নোংরা ও অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। তারা যাদের সাথে দ্বন্দ্ব-ফাসাদে পেরে ওঠে না, তাদের বিরুদ্ধে নির্জনে বিষোদগার করে, ঘৃণা ছড়ায় এবং তাদের অভিশাপ দিতে থাকে।
বাংলাদেশের ধনীদের অবস্থা গরিবদের চেয়েও করুণ, অশ্লীল ও অগোছালো। তাদের বিরাট অংশ কৃপণ ও অসৎ হয়ে পড়েছে। নিজেদের অর্থবিত্ত তারা বিকৃত কর্মে খরচ করা শুরু করেছে এবং বিকৃত কর্মে ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নেই। প্রচণ্ড জিঘাংসা ও অন্তরের অন্যান্য কুপ্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত হয়ে বেশির ভাগ বড় বড় নেতা তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খিস্তিখেউড় করে এবং প্রতিপক্ষের বিনাশ সাধনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। শিক্ষিত লোকদের বিরাট অংশ ধামাধরা, দালাল, দলবাজ ও স্বার্থান্বেষীতে পরিণত হয়েছে। সাধু-সজ্জনদের মধ্যে বেশধারী, নকল, ধোঁকাবাজ ও ভণ্ডদের প্রাধান্য প্রবলভাবে লক্ষ করা গেছে। এ অবস্থায়, সাধারণ মানুষ সত্যের পরিবর্তে মিথ্যা, ন্যায়ের পরিবর্তে অন্যায়, দিনের পরিবর্তে রাতের আঁধার হতে বিপরীতমুখী বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটগুলো নিয়ে তারিখ-ই-ডিজিটাল শাহী নিয়ে কী লিখব, তা চিন্তা করলেই শরীর থেকে ঘাম বের হয়ে যাচ্ছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা