জাকার্তার দশা ও ঢাকার দুশ্চিন্তা
- মীযানুল করীম
- ০৫ মে ২০১৯, ১৮:৪৮, আপডেট: ০৫ মে ২০১৯, ২২:০৮
বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং সাত হাজার দ্বীপের বিশাল দেশ, ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। এই খবর পড়ে চমকে ওঠার সাথে সাথে আঁতকে ওঠার মতো বিষয় হলো, যে তিন প্রধান কারণ এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। এগুলো হলো, অতিরিক্ত জনসংখ্যার বিষম চাপ, নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা এবং যানজটের দুর্বিষহ যন্ত্রণা।
ঢাকায় সীমিত নাগরিক সুবিধার মাঝে কোটির বেশি মানুষের বসবাস ‘ইটের পরে ইট,/মানুষ মাঝে কীট’ কথাটাই মনে করিয়ে দেয়। অন্য দিকে, এই জনজটের যন্ত্রণা যানজট অনেক বাড়িয়ে দেয় নিত্যদিন। তার তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের সবার রয়েছে। সেশনজট, মামলাজট, জলজটসহ বিভিন্ন জটের এই দুর্ভাগা দেশে বিশেষত রাজধানী ঢাকায় দীর্ঘ দিন ধরে সমস্যার পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠছে। ইন্দোনেশিয়া সরকার নাকি দূরবর্তী বোর্নিও দ্বীপের একটি শহরে রাজধানী স্থানান্তর করবে। কিন্তু জনবহুল ক্ষুদ্র বাংলাদেশে রাজধানী সরানো প্রায় অসম্ভব। এ মুহূর্তে করণীয় হচ্ছে, ঢাকার ওপর মানুষের চাপ যথাসাধ্য কমিয়ে, তথা সার্বিক বিকেন্দ্রীকরণ করে এই ঐতিহাসিক নগরীর মান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা এবং জনজীবনে স্বস্তির সুবাতাস ফিরিয়ে আনা।
এবার ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচনে আবার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ‘ইসলামপন্থী’ হিসেবে অভিহিত জোকো উইদোদো। তিনি নতুন করে এ পদে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই ‘কোনো পরিকল্পিত শহরে’ দেশের রাজধানী সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ২৯ এপ্রিল পরিকল্পনামন্ত্রী বাম্বাং ব্রোদজনেগোরো এ কথা প্রকাশ করেছেন। এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের বড় কারণ হলো, জাভা দ্বীপে অবস্থিত, জনবহুল জাকার্তার নানারকম সমস্যা। মন্ত্রী জানান, নতুন রাজধানীর অবস্থান এখনো নির্ধারিত হয়নি। এ কাজে এমনকি এক দশক লেগে যেতে পারে। তত দিনে জাকার্তার লোক স্যংখ্যা এবং তজ্জনিত যানজটসহ নানাবিধ অসুবিধা অনেক বেড়ে যাওয়াই অনিবার্য। পরিকল্পনামন্ত্রী দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এই দেশের রাজধানী পরিবর্তনের ঘোষণা দেয়ার সময় এ প্রসঙ্গে ব্রাজিল ও কাজাখস্তানের নজির তুলে ধরেছেন। দেশ দু’টির রাজধানী যথাক্রমে রিওডি জেনিরো থেকে ব্রাসিলিয়া এবং আলমাতি (সাবেক আলমা আতা) থেকে আস্তানায় স্থানান্তরিত হয়েছে অনেক আগে।
অবশ্য, মধ্য এশিয়ার মরুভূমি অধ্যুষিত ও স্থলবন্দী বিরাট দেশ কাজাখস্তানের রাজধানীর পরিবর্তন আর দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসক নূর সুলতান নজরবায়েভের একচ্ছত্র দাপট পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। তিন দশক শাসনের পর তিনি সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন। তার ঘনিষ্ঠ যে নেতা উত্তরাধিকারী হলেন, তিনি রাজধানীর নাম বদলিয়ে ‘নূর সুলতান’ রাখার ঘোষণাকে গণবিরোধী স্তাবকতা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। যা হোক, ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী বোর্নিও দ্বীপে কালিমান্তান প্রদেশের রাজধানীতে সরিয়ে নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্বের অনেক দেশেরই রাজধানী বদলে গেছে। কখনো শাসকের খোশখেয়ালে; কখনো স্বৈরাচারীর যথেচ্ছ কর্ম হিসেবে, আবার কখনো বা জাতির সুবিধার্থে রাজধানীর ঘটেছে পরিবর্তন। এক শহর থেকে আরেক শহরে রাজধানী সরানো হয়েছে কিংবা রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে নতুন জায়গায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কে কোথায় কত ব্যয়ে রাজধানী স্থানান্তরিত করেছেন, এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো- কোন উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে? জাতি এতে আসলেই উপকৃত হবে কি না এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলের টাকায় নতুন রাজধানী গড়া আসলেই জরুরি কি না।
রাজধানী বদলানোর বাতিকে অনেক স্বৈরাশাসকই আক্রান্ত। বর্তমান মিসরে গণতন্ত্রের ঘাতক এবং ক্ষমতালোভী সেনাশাসক, জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি সম্প্রতি ঐতিহাসিক কায়রো নগরী থেকে দেশের রাজধানী সরানোর ঘোষণা দিয়েছেন। কয়েক বছর আগে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতায় থাকাকালে তারা সুপরিচিত রেঙ্গুন (এখন ইয়াঙ্গুন) শহর থেকে দেশের রাজধানী নিয়ে গেছেন ২০০ কিলোমিটার উত্তরে নেইপিডো নামক স্থানে। জনগণের কোটি কোটি টাকা ঢেলে তৈরি করা এই নতুন শহর জমে ওঠেনি আজো। এ সম্পর্কে পত্রিকায় খবর উঠেছে সম্প্রতি।
মনে পড়ে, অতীতের ‘পাগলা রাজা’ মুহম্মদ বিন তুঘলকের দিল্লি থেকে সুদূর দাক্ষিণাত্যের দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের নিষ্ফলা পদক্ষেপের কথা। তার বিরাট ভারত সাম্রাজ্যের রাজধানী সরাতে গিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় এবং জনগণের দুর্ভোগ ছাড়া আর কোনো ফল হয়নি। চতুর্দশ শতাব্দীতে তিনি নতুন রাজধানীর নাম ‘দৌলতাবাদ’ রেখেছিলেন। রাজধানী স্থানান্তরের এ ঘটনা তুঘলকি কাণ্ডের জ্বলন্ত নজির হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়।
বাংলাদেশ এক সময় ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’। তখনকার পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান। ১৯৫৮ সালে এই অভ্যুত্থানের পর তিনি যে ক’টি বড় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল- নিজেই নিজেকে প্রমোশন দিয়ে ‘ফিল্ড মার্শাল’ বানানো, দেশের রাজধানী করাচি থেকে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের অপরপ্রান্তে স্থানান্তর এবং ‘মৌলিক’ গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন। আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালে কেন্দ্রীয় রাজধানী দেশের দক্ষিণ উপকূলের সুপরিচিত করাচি নগরী থেকে প্রায় হাজার মাইল দূরে এবং সেনা সদর রাওয়ালপিন্ডির পাশে, নতুন জায়গায় সরিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ নেন। এরপর এক দশক ধরে পাকিস্তানের রাজধানী ছিল ‘পিন্ডিতে’ এবং নতুন রাজধানী ‘ইসলামাবাদ’-এর নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয় ১৯৭০ সালে। মারগালা পাহাড়ের কোলে এবং পাটোয়ার মালভূমির বুকে এ রাজধানী গড়ে তোলার কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, ‘শত্রুর হাত থেকে নিরাপদ- এমন স্থানেই রাজধানী হওয়া উচিত।’ রাজধানী ইসলামাবাদ বাস্তবে শত্রু দেশের হামলা থেকে এখন কতটা নিরাপদ, আমরা জানি না।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান গণ-অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় সরকার ঢাকার বর্তমান শেরেবাংলা নগর এলাকায় দেশের ‘দ্বিতীয় রাজধানী’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। ষাটের দশকে সে মোতাবেক, কয়েকটি ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হলেও উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ কাজ স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। এসব ভবনের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় সংসদ ভবনের কথা। এরপর উল্লেখ করা যায় এখনকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ভবনের।
বাংলাদেশের যেমন বড় বড় সমস্যা রয়েছে, তেমনি আছে বিপুল সম্ভাবনা। আমাদের দেশকে এক সময় দারিদ্র্য, দুর্যোগ ও দুর্নীতির দেশ হিসেবে প্রচার করা হতো। এখন সে অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন ঘটেছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সামাজিক অনাচার এবং নৈতিক অবক্ষয়ের অবসান হলে এ দেশ বহুদূর এগিয়ে যেতে পারত। তখন উন্নয়ন আর সুশাসন চলত হাত ধরাধরি করে। অপর দিকে, এ দেশ অমিত সম্ভাবনা সমৃদ্ধ এবং জাতি হিসেবে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই সৌভাগ্যবান। জনসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি বলতে হয় নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় দিক দিয়ে আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সংহতির শক্তি অর্জনের অতুলনীয় সুযোগের কথা। কারণ, প্রধানত বাঙালি অধ্যুষিত দেশটির প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ একই ধর্মের অনুসারী। তদুপরি, আমাদের দেশের রাজধানী একটা চমৎকার অবস্থানের অধিকারী, যা বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্রের নেই। বাংলাদেশের মানচিত্রের প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত, রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের বিভিন্ন অংশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ সুবিধাজনক। অথচ নানা কারণে ও অকারণে আজ ঢাকা মানুষের চাপে পিষ্ট এবং এখানকার জীবনযাত্রা বিভিন্নভাবে ক্রমেই অসহনীয়। তবে বাংলাদেশের রাজধানী স্থানান্তরের কথা কেউ ভাবেন না। অর্থাৎ, সেটা কার্যত অসম্ভব বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে। তাই নগর ঢাকাকে বাসযোগ্য করাই হবে সর্বাধিক অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ। দেশের মানুষ যাতে কেবল ঢাকামুখী হতে বাধ্য না হয় এবং ঢাকার দিকে যেন গ্রামের জনগণকে দলে দলে ছুটে আসতে না হয়, সেজন্য সরকার এখনই স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নিয়ে তা জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করাই সময়ের দাবি। অন্যথায়, ঢাকা বিশ্বের সর্বাধিক অবাসযোগ্য নগরীতে পর্যবসিত হবে আগামী দিনে।
ঢাকার জনসংখ্যা আর বাড়তে দেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, বরং কিভাবে ক্রমেই এটা কমিয়ে আনা যায়, এ জন্য কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক চিন্তাভাবনা দরকার। ঢাকার পরিসর বাড়ছে, উপশহর গড়া হচ্ছে, বুড়িগঙ্গার দক্ষিণে, বালু নদীর পূর্বে কিংবা তুরাগের পশ্চিমে শহর সম্প্রসারিত হচ্ছে- এসব আংশিক ও সাময়িক সমাধান যেন আমাদের বিভ্রান্তি ও আত্মতৃপ্তির হেতু না হয়। বরং যা আবশ্যক, তা হচ্ছে- প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিকসহ সামগ্রিক বিকেন্দ্রীকরণ, তথা দেশে একাধিক বড় নগরী গড়ে তোলা। এতে ঢাকার ওপর চাপ কমবে। তখন দেশের ‘মুখের রক্ত’ ভারসাম্যপূর্ণভাবে সারা শরীরে সঞ্চারিত হতে পারবে। এটাই সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ এবং জাতির একান্ত প্রত্যাশিত। তবে সর্বাগ্রে আমাদের যারা নীতিনির্ধারক, অর্থাৎ যারা জাতির ভাগ্যবিধাতা হয়ে গেছেন, রাষ্ট্রতরণীর সেই কাণ্ডারি আর দেশ চালনার দায়িত্বশীলদের মানসিকতা বদলাতে হবে অবশ্যই। দেশের প্রকৃত উন্নয়ন বলতে কেবল কিছু অট্টালিকা আর মহাপ্রকল্পের চমক নয় এবং সরকার মানে শুধু ধমক দেয়ার কিছু লোক নয়, এটা অবিলম্বে অনুধাবন করা চাই। অন্যথায় একদিন ঢাকার ক্রমাবনতি জাকার্তার মতো দুর্ভাগ্য ডেকে আনতে পারে।
জাকার্তা থেকে রাজধানী স্থানান্তরের কারণ তুলে ধরে বলা হয়েছে, এখানে এক কোটি লোকের বাস। ঢাকারও জনসংখ্যা প্রায় সমান। ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত তোলায় জাকার্তা দেবে গেছে। এতে বন্যার শঙ্কা বাড়ছে। ঢাকাতেও মাটির নিচ থেকে পানি তোলা হচ্ছে অনেক বেশি। দুই শহরেই যানজটে অবর্ণনীয় ক্ষতি হচ্ছে। অতএব, ‘বুঝহ সুজন, যেজন জানহ সন্ধান।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা