আওয়ামী লীগ সরকারের মুজিবনগর দিবস পালন
- এবনে গোলাম সামাদ
- ২৬ এপ্রিল ২০১৯, ২০:২০
আমি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগের অনেক কিছুই বুঝি না। তার মধ্যে একটি হলো ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে কেন আবার নতুন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কেননা ইত:পূর্বে আওয়ামী লীগ বলেছিল, ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। দুবার একই কথা ঘোষণা করার অর্থ হয় না। মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখিত ও পঠিত হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়, বাংলা ভাষায় নয়। কেননা ধরে নেয়া হয়েছিল ইংরেজি ভাষায় লিখিত ঘোষণাপত্র পারবে অনেক সহজে আন্তর্জাতিক সাড়া জাগাতে। আমরা এখানে ইংরেজি ভাষায় লিখিত সেই ঘোষণাপত্র থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
Whereas free elections were held in Bangladesh from 7th December, 1970 to 7th January, 1971, to elect representatives for the purpose of framing a Constitution,
And
Whereas at these elections the people of Bangladesh elected 167 out of 169 representative belonging to the Awami League,
And
Whereas General Yahya Khan summoned the elected representative of the people to meet on the 3rd March, 1971, for the purpose of framing a Constitution,
And
Whereas the Assembly so summoned was arbitrarily and illegally postponed for an indefinite period,
And
Whereas instead of fulfilling their promise and while still conferring with the representatives of the people of Bangladesh, Pakistan authorities declared an unjust and treacherous war,
And
Whereas in the facts and circumstances of such treacherous conduct Banga Bandhu Sheikh Mujibur Rahman, the undisputed leader of 75 million of people of Bangladesh, in due fulfilment of the legitimate right of self-determination of the people of Bangladesh, duly made a declaration of independence at Dacca on march 26, 1971, and urged the people of Bangladesh to defend the honour and integrity of Bangladesh.
And
Whereas in the conduct of the ruthless and savage war the Pakistani authorities committed and are still continuously committing numerous acts of genocide and unprecedented tortures, amongst others on the civilian and unarmed people of Bangladesh,
And
Whereas the Pakistan Government by levying an unjust war and committing genocide and by other repressive measures made it impossible for the elected representatives of the people of Bangladesh to meet and frame a Constitution, and give to themselves a Government,
And
Whereas the people of Bangladesh by their heroism, bravery and revolutionary fervour have established effective control over the territories of Bangladesh,
We the elected representative of the people of Bangladesh, as honour bound by the mandate given to us by the people of Bangladesh whose will is supreme duly constituted ourselves into a Constituent Assembly,
and
having held mutual consultations,
and
in order to ensure for the people of Bangladesh equality, human dignity and social justice, declare and constitute Bangladesh to be a sovereign people’s Republic and thereby confirm the declaration of independence already made by Banga Bandhu Sheikh Mujibur Rahman and do hereby affirm and resolve that till such time as a Constitution is framed, Banga Bandhu Sheikh Mujibur Rahman shall be the president of the Republic and that Syed Nazrul Islam shall be the vice President of the Republic and
that the president shall be the Supreme Commander of all the Armed Forces of the Republic,
shall exercise all the Executive and Legislative power of the Republic including the power to grant pardon,
shall have the power to appoint a prime Minister and such other Minister as he considers necessary.
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, মুজিবনগরের ঘোষণাপত্র যখন পাঠ করা হয়, তখন শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী ছিলেন পাক সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে। কিন্তু মুজিবনগরের ঘোষণাপত্রে সেটা স্বীকার করা হয় না। সেটা পরে ধীরে ধীরে স্বীকার করা হয়। অন্য দিকে আরেকটি ঘটনার কথাও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের কয়েকজন এমএনএ কলকাতায় গিয়েছিলেন না। কে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে হয়েছিল ভোট। এই ভোটে দু’জন প্রার্থী ছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদ, আর অপরজন ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। এই ভোটাভুটিতে খন্দকার মোশতাক আহমেদ মাত্র এক ভোটে হেরে যান। ঢাকা থেকে যেসব এমএনএ কলকাতায় এসেছিলেন না, তারা ছিলেন বিশেষভাবে মোশতাক আহমেদের ভক্ত। এই ভোটকে তাই বলা চলে না আওয়ামী লীগের সদস্যদের মতের প্রতিফলন। আসলে আওয়ামী লীগের মধ্যে খন্দকার মোশতাকের ছিল একটা বিরাট প্রভাব। তিনি ছিলেন এই দলের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
যে জায়গাটাকে বলা হয় মুজিবনগর, তার আসল নাম হলো বৈদ্যনাথ তলা। জায়গাটা বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলায়, একেবারে ভারত সীমান্তঘেঁষা। জায়গাটাকে খুব অস্থায়ীভাবে ভারতীয় সৈন্যরা দখল করে এবং সেখানে মুজিবনগরের ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয় ইংরেজিতে। মুজিবনগরের ঘোষণাপত্র পাঠের পর ভারতীয় সৈন্যদেরই দেখা যায় চেয়ারটেবিল সরাতে। মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়েছিল বৈদ্যনাথ তলার সব অনুষ্ঠান। ভারতীয় সৈন্যরা জায়গাটিকে রেখেছিল ঘিরে। সব সময় আশঙ্কা করা হচ্ছিল পাক বাহিনী সেখানে যেকোনো মুহূর্তে এসে বোমা বর্ষণ করতে পারে। তাই খুব স্বল্প সময়েই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে শেষ করা হয় অনুষ্ঠান। শেখ মুজিব মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে কোনো দিন মুজিবনগর দেখতে যাননি। মুজিবনগরকে করেছেন বিশেষভাবেই উপেক্ষা। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন মনে করছে মুজিবনগর দিবস পালন করা আবশ্যিক। কেন তারা এটা মনে করছে তার কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য এখনো এলো না তাদের পক্ষ থেকে।
সমগ্র ভারত রাষ্ট্রের স্থলভাগ চারটি কমান্ডে বিভক্ত। দক্ষিণের কমান্ডের সদর দফতর হলো পুনে বা পুনা। যা মহারাষ্ট্র প্রদেশে অবস্থিত। কেন্দ্রীয় কমান্ডের সদর দফতর হলো লাক্ষ্মৌ, যা উত্তর প্রদেশে অবস্থিত। পশ্চিম কমান্ডের সদর দফতর হলো সিমলা; হিমাচল প্রদেশে অবস্থিত। আর পূর্ব কমান্ডের সদর দফতর হলো কলকাতা। ১৯৭১-এর যুদ্ধ কলকাতা থেকে পরিচালিত হয়েছিল লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরার পরিচালনায়। এ সময় পূর্ব কমান্ডের মেজর জেনারেল ছিলেন জেএফআর জ্যাকোব। যিনি পরে জগজিৎ সিং অরোরার স্থান লাভ করেন। তিনি একটি বই লিখেছেন। যার নাম Surrender at Dacca, Birth of a Nation। ইনি হলেন ইহুদি। কেবল ইহুদি নন, জিওনিস্ট।
অর্থাৎ ইসরাইলের একনিষ্ঠ সমর্থক। ইনি মনেপ্রাণেই চেয়েছিলেন সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাওয়া। জ্যাকোব তার বইটিতে লিখেছেন, মুুজিবনগরের ঘোষণাপত্রের খসড়া করেছিলেন তিনি। পরে তার খসড়াটিকে আইনের ভাষায় লেখেন কলকাতার হাইকোর্টের কয়েকজন খ্যাতনামা উকিল। এ হলো মুজিবনগরের বিখ্যাত ঘোষণাপত্রের রচনা ইতিহাস। বইটি খুব সহজলভ্য। ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস, ঢাকা থেকে ১৯৯৭ সালে। শেখ হাসিনা জ্যাকোবকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ করে এনে বীরউত্তম খেতাব দিয়েছেন। সাবেক পাকিস্তানকে কেবল যে ভারত ভেঙে দিতে চেয়েছিল, তা নয়। ইসরাইলও চেয়েছিল ভেঙে দিতে। ইসরাইলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন জ্যাকোব।
১৯৭১ সালে শেখ মুজিব ঠিক কী চেয়েছিলেন, আমরা তা জানি না। কারণ শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে সরাসরি ভারতে না এসে যান লন্ডনে। সেখানে তিনি পরামর্শ গ্রহণ করেন তদানীন্তন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের কাছ থেকে। এরপর লন্ডন থেকে যাত্রা করেন ঢাকার উদ্দেশে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর একটি বিমানে করে। তিনি ঢাকায় আসার পথে দিল্লিতে মাত্র চার ঘণ্টা যাত্রাবিরতি করেন। দিল্লিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে বলেন, যেহেতু গ্রেট ব্রিটেন এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করেনি, তাই ব্রিটিশ সামরিক বিমানে করে তার উচিত হবে না ঢাকা যাওয়া। কিন্তু শেখ মুজিব ভারতীয় বিমানে করে ঢাকায় আসতে রাজি হন না। ঢাকায় আসেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানে করেই। কেন তিনি ভারতীয় বিমানে করে ঢাকায় আসতে চাননি, তা এখনো জানা যায়নি।
ব্রিটেন বাংলাদেশকে পৃথক রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে একটা পৃথক রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের ৮ তারিখ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেবার ফলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশেষভাবে মর্যাদা লাভ করে। বর্তমান পাকিস্তান বাংলাদেশকে একটা পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত মিসর ও মালয়েশিয়া ছাড়া আর কোনো মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ছিল না। আলজেরিয়ার সামরিক শাসক বুমেদিন ঢাকায় এসে শেখ মুজিবকে রাজি করান পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসির সম্মেলনে যেতে।
শেখ মুজিব সেখানে গেলে বর্তমান পাকিস্তান বাংলাদেশকে একটা পৃথক স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়। শেখ মুজিবুর রহমানের ওআইসির সম্মেলনে যোগদান প্রমাণ করে তিনি তার মুসলিম সত্তাকে অস্বীকার করতে চাচ্ছেন না। যদিও থাকতে চাচ্ছেন না বর্তমান পাকিস্তানের সাথে আগের মতো সংযুক্ত হয়ে। তিনি ১৯৭২ সালে লন্ডনে সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহ্যাসকে বলেন, তিনি বর্তমান পাকিস্তানের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাচ্ছেন না। রাখতে চাচ্ছেন একটা বিশেষ প্রকার সম্পর্ক (Anthony Mascarenhas, Bangladesh A l\Legacy of Blood; Chapter II)|
আমি ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে কলকাতায় চলে যাই। দেশে পাক সেনারা কী রকম অত্যাচার করেছিল আমি তা প্রত্যক্ষ করিনি। ১৯৭১ সালের ২ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩ জন শিক্ষক এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আচরণের প্রশংসা করেছিলেন। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের পর তাজউদ্দীন এসব অধ্যাপককে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন এবং এদের কাউকে কাউকে পাঠান জেলে। কিন্তু শেখ মুজিব দেশে ফিরে এসব অধ্যাপকের সবার চাকরি ফিরিয়ে দেন। কাউকেই রাখেন না জেলে। শেখ মুজিবের এই সিদ্ধান্ত আমার কাছে খুব ভালো লেগেছিল। শেখ মুজিব দেশে ফিরে একবার মুজিবনগর বেড়াতে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা যাননি। মুজিবনগরকে তিনি চাননি স্বীকৃতি দিতে। মুজিবনগর ছিল তার কাছে একটা তাজউদ্দীনের ভারতীয় সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে করা বিশেষ কারসাজি মাত্র। সেটাকে তিনি চাননি মানতে। তাজউদ্দীনের সাথে তার নানা বিষয়েই হতে পেরেছিল গুরুতর মতভেদ। তিনি শেষ পর্যন্ত তার মন্ত্রিসভা থেকে করেন তাজউদ্দীনকে বহিষ্কার। যেটা তিনি খন্দকার মোশতাককে করার প্রয়োজন দেখেননি।
গত লেখার সংশোধনী : গত ২০ এপ্রিল ‘নববর্ষ পূজা বন্ধ করা হোক’ শিরোনামের এক স্থানে ভুলবশত ছাপা হয়েছে ‘মুঘল যুগে সুবে বাংলা শাসিত হয়েছে প্রধানত বাংলাভাষী রাজ কর্মচারীদের দিয়ে।’ এখানে আসলে হবে “মুঘল যুগে সুবে বাংলা শাসিত হয়েছে প্রধানত ‘অবাংলাভাষী’ রাজ কর্মচারীদের দিয়ে।”
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা