বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে বিভ্রান্তি
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ২৪ এপ্রিল ২০১৯, ২০:১৭
বেগম খালেদা জিয়ার কারামুক্তি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যে তার মুক্তি পাওয়ার কথা; কিন্তু নানা ধরনের কারসাজি, ছলচাতুরী এবং ষড়যন্ত্র করে সরকার তার মুক্তি অসম্ভব করে তুলেছে। একটি মামলায় মুক্তি পেলে আরেকটি সাজানো মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। এমনকি মুক্তি ব্যাহত করার জন্য নতুন মামলা ঠুকে দেয়া হচ্ছে। এক বছর ধরে বাংলাদেশের এই মহীয়সী নেত্রীর প্রতি যে অপমান, অসম্মান ও অমর্যাদা দেখানো হচ্ছে তা সমকালীন বিশে^ বিরল। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশের সবচেয়ে সম্মানীয় মানুষ হিসেবে তার যে আইনি সমর্থন, সহযোগিতা ও প্রটোকল পাওয়ার কথা তা সরকার অস্বীকার করছে। নির্জন কারাগারে তাকে রাখা হয়েছিল নিঃশেষ করার লক্ষ্যে। এখন তিনি পিজি হাসপাতালে আছেন। অথচ তিনি চেয়েছিলেন ইউনাইটেড হাসপাতালে যেতে। সরকারি থেকে বেসরকারিতে গেলে নাকি আকাশ ভেঙে পড়বে। সুতরাং সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তিলে তিলে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারলে নিষ্কণ্টক হয় যাদের সিংহাসন, তাদের কাছে যুক্তি, আইন ও মানবিকতা নিরর্থক।
একসময় ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলায় বিদেশে পাঠানোর ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তখন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘এ দেশ ছাড়া আমার কোনো দ্বিতীয় ঠিকানা নেই।’ তার এই অনমনীয় মনোভাবের কারণে দেশে ফিরতে পেরেছিলেন আরেক নেত্রী। এখন ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলায় ‘মাইনাস ওয়ান’ পরিণত হয়েছে। খালেদা জিয়ার স্বাভাবিক মুক্তি নিয়ে যাদের বাধাবিপত্তির শেষ নেই, তারা এখন অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছে। তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য তারা দরদবিগলিত প্রাণ। প্যারোলে মুক্তির কথা তারাই আবিষ্কার করেছে। তারাই নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
তাদের বশংবদ সাংবাদিকেরা স্বজন বিএনপির সংসদ সদস্যদের যোগদানের শর্তে খালেদা জিয়ার জামিন অথবা প্যারোলে জামিনের কথা লেখালেখি করছে। এমনকি তারা খালেদা জিয়ার মনের কথা ‘নমনীয় খালেদা’ শিরোনাম করছে। তারাই গুজব রটাচ্ছে ও এর শাখা-প্রশাখা চার দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের তথ্য মতে, খালেদা জিয়া শক্ত অবস্থান থেকে সরে আসছেন। প্যারোল বা শর্তসাপেক্ষে মুক্তি নিয়ে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হয়েছেন তিনি। তারা বলছেন, কয়েক দিন আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়া প্যারোল নিয়ে একেবারেই রাজি হচ্ছিলেন না। এখন তাকে খানিকটা নমনীয় দেখা যাচ্ছে। তাদের গুজবকে যৌক্তিকতা দেয়ার জন্য এ কথাও তারা বলছেন, ‘খালেদা জিয়া কখন নমনীয় হন আবার কখন শক্ত, সেটা বুঝা মুশকিল।’
তাদের বুঝতে মুশকিল হলেও গোটা জাতি খালেদা জিয়ার মাইন্ডসেট বা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা রাখে। এই সেই নেত্রী, যিনি ৯ বছর ধরে স্বৈরাচারের নিপীড়ন-নির্যাতন ও লোভ-লালসা অগ্রাহ্য করে আপসহীন নেত্রীর গৌরব অর্জন করেছেন। ১৯৮৬ সালের তথাকথিত নির্বাচনে বস্তা বস্তা টাকার অফার অগ্রাহ্য করে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অস্বীকার করেন। অথচ আরেকজন বশীভূত হয়ে পড়েন। এই সেই নেত্রী, যিনি ১/১১-এর ক্ষমতার অফার অগ্রাহ্য করেন। অথচ আরেক নেত্রী তাদের অপকর্মকে বৈধতা দেয়ার কথা প্রকাশ্যেই উচ্চারণ করেন। এক যুগ ধরে তিনি স্বস্তিতে থাকতে পেরেছেন খুব কম সময়। নিজের বাড়ি থেকে উৎখাত হয়েছেন। ভাড়াবাড়ি থেকে কোনো রকম আইনগত বৈধতা ছাড়াই বেরোতে দেয়া হয়নি তাকে। দলীয় অফিসে দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ থেকেছেন তিনি। ‘ট্রাকের চাকায় অবরুদ্ধ হয়েছে গণতন্ত্র’। নিজ সন্তানকে হারিয়েছেন। শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন তিনি। আরেক সন্তানকে দূরে রেখে কার্যত মাতৃত্বের বেদনায় ব্যাকুল হয়েছেন তিনি। অবশেষে মিথ্যা মামলায় কারাবরণ করছেন তিনি; কিন্তু মিথ্যার সাথে কখনো আপস করেননি তিনি। তার ধৈর্য, সাহস ও কষ্ট সইবার অপূর্ব ক্ষমতা এ দেশের রাজনীতিকদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জানা গেছে, নির্জন কারাবাসের প্রথম দিকেই আপসরফার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বারবার। আর তিনি দৃঢ়তার সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
গত ১ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে পুরান ঢাকার কারগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে স্থানান্তরের পর গুজবের পাখনা বড় হয়। ১৪ এপ্রিল বিএনপির মহাসচিবসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়ার সাথে হাসপাতালে দেখা করেন। তখনো প্যারোলের বিষয়টি নেতৃবৃন্দ আলোচিত হয়নি বলে জানান। পরে একপর্যায়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এটি খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের বিষয়।’ বিএনপির শত্রুরা মহাসচিবের কথাটি লুফে নেয়। অথচ সবাই জানে এবং বোঝে যে বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয় বলে কিছু নেই।
তিনি বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মহীয়সী নেত্রী। সমগ্র বাংলাদেশই হচ্ছে তার পরিবার। বাংলাদেশের লাখো কোটি মানুষ তাকে মাতৃজ্ঞানে ভালোবাসে। পরে অবশ্য মির্জা ফখরুল বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিএনপি কখনো দাবি করেনি। দলের নির্বাচিত ছয়জন সংসদ সদস্য সংসদে যোগ দিলে খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হবে, এমন বিষয়টিও সঠিক নয়। এগুলো মিডিয়ার অবান্তর কথাবার্তা। বিএনপির কোনো নেতা খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে কোনো কথা বলেননি। এগুলো মিডিয়াতে বলা হচ্ছে।’ বিএনপির নেতারা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের কর্মসুচি দিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি ত্বরান্বিত করছেন। যেকোনো মূল্যে তাকে মুক্ত করার প্রত্যয় ঘোষণা করছেন নেতাকর্মীরা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘আমরা তার মুক্তির আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব মানুষ রাজপথে নেমে এলে সরকার ঠেকাতে পারবে না।’
কিন্তু অপ্রিয় বাস্তবতা হচ্ছে, এই গত এক বছরে কার্যকর কোনো আন্দোলনের সূচনা করা যায়নি। খালেদা জিয়ার গ্রেফতারের পর পরই কর্মী সাধারণ ও সাধারণ মানুষের যে আবেগ লক্ষ করা গিয়েছিল, তাতে ভালো আন্দোলনের সূচনা হতে পারত; কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া শক্তভাবে আন্দোলন করা থেকে সবাইকে নিবৃত্ত করেন। তার আশঙ্কা ছিল, আন্দোলনের অজুহাতে সরকার আরেকবার বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হওয়ার সুযোগ পাবে। এমনিতেই বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে রয়েছেন। মাতৃসুলভ মন দিয়ে তিনি তার কর্মী সাধারণের জন্য আরো দুর্ভোগ বাড়াতে চাননি।
আরেকটি কারণ, আইনের ওপর খালেদা জিয়ার গভীর আস্থা ও বিশ^াস। মওদুদ আহমদের মতো প্রবীণ আইনজীবী অনুরূপ আশা প্রকাশ করেছিলেন; কিন্তু সরকার যে কতটা নিচে নামতে পারে তা তাদের ধারণা ছিল না। নির্বাচন ছিল আরেকটি সম্ভাবনার খোলা দুয়ার। দেশের তাবৎ মানুষ বিশ^াস করেছিল, নির্বাচন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হবে। আর তাহলে বিএনপির বিজয় অনিবার্য। বিএনপি নির্বাচনকে খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবেই গ্রহণ করেছিল; কিন্তু মানুষের কল্পনাশক্তিকে হার মানিয়ে যা ঘটেছে, তা বিশ্ব রেকর্ড করার মতো। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে নিশীথ নির্বাচনের দেশ। ২৯ ডিসেম্বর রাতে পুলিশবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে এবং প্রশাসন পরোক্ষভাবে নির্বাচনের নিরঙ্কুশ ফলাফল নির্ধারণ করে। এভাবে আশা-আশঙ্কায় ব্যাহত হয় খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন। এখন প্যারোলে মুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে। এই প্যারোলে মুক্তি কোনো সম্মানজনক পন্থা নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আইয়ুব সরকার শেখ সাহেবকে প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব দেয়। অবশেষে গণ-আন্দোলনের তীব্রতায় তিনি নিঃশর্ত মুক্তি পান।
প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য গণ-আন্দোলনই একমাত্র পথ। নীরব অথচ ক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীকে আন্দোলনে উদ্দীপ্ত করার দায়িত্ব নেতা-নেত্রীদের। আর তা করতে হলে প্রথমত, বিএনপির সাংগঠনিক মজবুতি দরকার। দ্বিতীয়ত, বিএনপির এই শক্তিকে কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। ডান-বাম নির্বিশেষে একযোগে গণজোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। তৃতীয়ত, খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুকে সাধারণ মানুষের স্বার্থের সাথে একীভূত করতে হবে। চতুর্থত, তাহরির স্কোয়ারের আদলে আকস্মিক গণজমায়েতের আয়োজন করতে হবে। পঞ্চমত, চীনের মাও সে তুংয়ের পরিকল্পনা অনুসারে কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে। জনগণ রাগ, দুঃখ ও ক্ষোভে তেতিয়ে আছে। ‘এসব ম্লান, মূঢ় মুখে দিতে হবে ভাষা; ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা’।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা