২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

উন্নয়নের রোল মডেল ও বাস্তবতা

- ফাইল ছবি

বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে। এমন স্বীকৃতির ব্যাপারটি শুনতে আনন্দ লাগে সন্দেহ নেই। তবে এই স্বীকৃতি নিয়ে পুরোপুরি তৃপ্তিবোধ করা আসলেই কঠিন। সমাজের বাস্তব অবস্থাটা যদি বিবেচনা করা হয়, তবে এই স্বীকৃতি নিয়ে পুরোপুরি তৃপ্তিবোধ করাটা সম্ভব নয়। দেশের একটি ক্ষুদ্র অংশের মানুষের জন্য উন্নয়নের ছোঁয়া পাওয়ার ব্যাপারটি সত্য হতে পারে। সম্প্রতি জাতীয় পত্রিকার এক রিপোর্টে প্রকাশ, ধনিক শ্রেণীর আয় বেড়েছে, পক্ষান্তরে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে।

দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বসবাস করে। তাদের জীবনযাপনে যে দুঃসহ কাহিনী রয়েছে, তার সাথে উন্নয়নের বক্তব্য সামঞ্জ্যপূর্ণ নয়। তাছাড়া উন্নয়নের সংজ্ঞার যে বিস্তৃত ধারণা রয়েছে, তা শুধু মুষ্টিমেয় মানুষের নিছক বৈষয়িক বিষয় তথা আয় রোজগারের উন্নতিকেই বোঝায় না। উন্নয়নের এই বিস্তৃত ধারণার প্রতিফলন সমাজে প্রতিভাত না হওয়া পর্যন্ত উন্নয়নের রোল মডেলের স্বীকৃতি পাওয়া নিয়ে কথা বলার যৌক্তিকতা নেই। তাছাড়া সামান্য কিছু মানুষের অগ্রগতিকে সামগ্রিক উন্নয়ন বলে স্বীকৃতি দিলে অবশিষ্ট বেশির ভাগ মানুষের প্রতি পরিহাস করা হবে। এর পরও যদি উন্নয়ন নিয়ে বাহাস হয় তবে তাদের অর্বাচীন বলা ছাড়া উপায় নেই। আর এমন উন্নয়ন নিয়ে কোরাস গাইলে সেই সুর এতটা বেসুরো হবে যে, তা মানুষের কানে যন্ত্রণা উৎপাদন করবে। উন্নয়নের যে কথা শুনানো হচ্ছে তার সূচকগুলো নিয়ে তো সবাইকে একমত হতে হবে। এমন সূচক নিয়ে একমত হওয়া জরুরি হলেও সেটার কোনো উদ্যোগ আয়োজন নেই। কিছু স্থাপনাকে কেবল উন্নয়নের প্রতীক বলা যায় না।

এ কথা বহুল প্রচলিত যে, উন্নয়নের সাথে গণতন্ত্র পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে অগ্রসর হয়। আর উন্নয়নের স্বার্থেই গণতন্ত্রের প্রয়োজন অপরিহার্য। উন্নয়নের সাথে অর্থকড়ি লেনদেনের গভীর সম্পর্ক। আর অর্থকড়ি যেখানে সেখানে অনিয়ম দুর্নীতি থাকাটা স্বাভাবিক। রাষ্ট্রীয় সম্পদের এমন অপচয় রোধের ব্যবস্থাটা কোথায়। গণতান্ত্রিক সমাজে যে জবাবদিহিতার বিধান রয়েছে, এখন তার অনুপস্থিতির কারণে সেটা নেই। উন্নয়নের সাথে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত থাকাটা অপরিহার্য। কারণ, জনপ্রতিনিধিরাই অবহিত থাকেন, কোথায় কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করে সত্যিকারভাবে সাধারণ জনগণের উন্নতি কল্যাণ সাধন হওয়া। তাই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা বজায় থাকা এত জরুরি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, দেশে এখন প্রশ্নহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছেন না। দশম সংসদের মতো একাদশ সংসদের সদস্যরা সত্যিকারভাবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় তাদের প্রকৃত জনপ্রতিনিধি বলাটা কঠিন। তাই এসব এমপি নির্বাচনী এলাকার ভোটাদের কাছে জবাবদিহি করা এবং তাদের মতামত নিয়ে উন্নয়নের প্রকল্প প্রণয়ন করার প্রয়োজন বোধ করবেন না। তাই তাদের প্রণীত এমন উন্নয়ন কাঠামো কখনোই এলাকার প্রকৃত প্রয়োজনের আলোকে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এমন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে কখনোই উন্নয়নের রোল মডেল হতে পারে না।

আগেই বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে বহু প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের হস্তক্ষেপের ফলে কেবল তাদের দলের সব প্রার্থী সংসদে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে সংসদে সরকারের কোনো প্রতিপক্ষ নেই। অথচ দেশে এখন সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত থাকার কথা বলা হচ্ছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দলের যৌথ প্রয়াসে আইন পরিষদ দেশের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হওয়া। বিরোধী দল সরকারের সব কাজের জবাবদিহি করবে। কিন্তু এখন সেটি নেই।

সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’। এখানে গণতন্ত্র বলতে যা বোঝানো তা নিছক সীমিত কোনো ধারণা নয়। এর ব্যাখ্যা বহু বিস্তৃত এবং তার অনেক ব্যঞ্জনা রয়েছে। তবে গণতন্ত্রের একটি বড় অনুশীলন হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচন মানেই হচ্ছে প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। দেশের মালিক সব নাগরিক, তাদের অভিপ্রায়ই চূড়ান্ত। আর তাদের এই অভিপ্রায় প্রতিফলিত হবে ভোটের মাধ্যমে। আর সেই ভোট হতে হবে প্রশ্নহীন। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রশ্নেই আমরা যত সমস্যায় রয়েছি। গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে জনগণের মতামতের বিজয়। কিন্তু এখন আর জনগণের বিজয় হয় না। পাস করে দল বা ব্যক্তি বিশেষ। ভোটের রীতি-পদ্ধতি এখন পাল্টে গেছে। ভোটে এখন ভোটারদের উপস্থিতির প্রয়োজন পড়ে না। এর পরিবর্তে দরকার হয় ক্ষমতা, কৌশল ও রাতের আঁধার। এভাবে চললে ভোট প্রহসনে পরিণত হবে। সংবিধান যেখানে গণতন্ত্রের সব মানুষের সম্পৃক্তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। আজ আর সেই গুরুত্বের ধার কেউ ধারছে না। অভিধানের ভোটের অর্থ তাই এখন পাল্টে ফেলতে হবে।

উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের সাথে সাথে তার মৌলিক অধিকারগুলো পুরোপুরি নিশ্চিত করা হয়। উন্নত দেশের ধারণায় এই দুইয়ের সম্পৃক্ততা নাগরিক জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলে। আমরা যদি প্রশ্ন করি, বাংলাদেশে এমন অবস্থা বিরাজ করছে কিনা? তবে এর জবার অবশ্যই হবে নেতিবাচক। তবে উন্নয়নের রোল মডেলের দাবি কি যথার্থ বলা যায়? তাছাড়া রাষ্ট্রের যে পাঁচটি অঙ্গীকার মৌলিক চাহিদার ব্যাপারে, যা কিনা সংবিধানে সন্নিবেশিত রয়েছে। যেমন- অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা। জীবন ধারণের এসব উপকরণই তো সব নাগরিকের জন্য এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। দেশের গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে বেশির ভাগ মানুষ। তারাও চরম দরিদ্র বা সাধারণ দরিদ্রতা নিয়ে বসবাস করে। তাদের অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই তবে বলতে হবে আমাদের উন্নয়নের মাত্রা কোথায় রয়েছে। আরো আশা করা হচ্ছে যে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। এমনটি যদি হয় তবে তা সুখের, কিন্তু রাষ্ট্রে কর্ণধার ও পরিকল্পনাবিদদের এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, তাদের নীতি ও কর্মসূচি এমন হতে হবে যেন এই উন্নয়ন শুধু কোনো শ্রেণী বিশেষের না হয়। এই সমৃদ্ধির স্পর্শ যেন নিম্ন আয়ের মানুষের গায়েও স্পর্শ করে। কেবল শ্রেণী বিশেষের শ্রী বাড়লে তা সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করবে এবং ক্ষোভ বিদ্বেষ তৈরি হবে। তাতে দেশের অস্থিরতা সৃষ্টি করে। তাই এমনটি যাতে না ঘটে তার জন্য সজাগ থাকতে হবে। তা না হলে অপশক্তি তৎপর হয়ে মানুষকে বিপথগামী করতে পারে।

প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার গণতন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত। দেশের গণতন্ত্রের যে হাল তাতে মৌলিক অধিকার নিরুদ্দেশ হওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৩ অনুচ্ছেদে এই অধিকারগুলো বর্ণিত রয়েছে। যে দেশে মানবাধিকার বলবৎ করার ক্ষেত্রে ভোগান্তি পোহাতে হয়, সেখানে সংবিধানই শুধু লঙ্ঘিত হয় না। সাথে রাষ্ট্রের সুশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আশা করা যায় না। অথচ সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণকে সেবাদান প্রশাসনের অন্যতম দায়িত্ব। বাংলাদেশে মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে ব্যর্থতা, তা বিশ্ব সমাজের কাছে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও নির্বাহীরা নাগরিকদের এখন সেবাদান করে না বরং শাসন করে। যেখানে দেশের মালিক জনগণ শাসিত হয় সেখানে তো শাসিতের অধিকার অভিপ্রায় নয় শাসকের ইচ্ছাই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এখন বাংলাদেশের বিচারবহির্ভূত ক্যাপিটাল পানিসমেন্ট হচ্ছে। এমন শাস্তি নিয়ে মানুষ শঙ্কিত। হালে এর সাথে যুক্ত হয়েছে গায়েবি মামলা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এমন গায়েবি মামলায় জড়িয়ে শত শত নিরপরাধ মানুষকে অভিযুক্ত করে তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এসব অত্যাচারের কোনো প্রতিকার নেই।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে সাংবিধানিক বিরোধী দলের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু বাংলাদেশে সাংবিধানিক বিরোধী দল নেই। এর কারণ সবাই অবগত। গত জাতীয় নির্বাচনে এমনভাবে ভোট করা হয়েছে যেখানে সরকারের বিরোধী কোনো দলকে বিজয়ী হতে দেয়া হয়নি। ফলে সংসদে সরকারের কোনো প্রতিপক্ষ নেই। দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপিকে সংসদে যেতে দেয়া হয়নি। এখন তাদের সংসদের বাইরে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ রাজনৈতিক সংগঠন করার এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর পূর্ণ সাংবিধানিক অধিকার সবার রয়েছে। সংসদে বিরোধী দল নেই এবং সংসদের বাইরের বিরোধী দলের পক্ষে তৎপরতা চালাতে না দেয়া প্রকৃতপক্ষে এটা গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী। এমন অবস্থায় দেশে ক্ষমতাসীনদের আর কোনো জবাবদিহি করার স্থান রইল না।

এমন পরিস্থিতির কারণে সরকার রাষ্ট্র কিভাবে চালাচ্ছে জনগণের কতটুকু কল্যাণ করছে, কোথায় তাদের ব্যর্থতা মানুষের পক্ষে তা অবহিত হওয়ার সুযোগ থাকল না। অথচ গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রশাসন কিভাবে তাদের কর্তব্য পালন করছে সেটা অবহিত থাকা। কিন্তু এখন সে সুযোগ নেই। বিরোধী দল ছাড়া আরো একভাবে জনগণ দেশের খবরাখবর জানতে পারে। আর সেটা হলো গণমাধ্যম। দেশে এখন যত গণমাধ্যম রয়েছে তাদের বেশির ভাগ ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির সমর্থক বিধায় তাদের পক্ষে সংবাদ পরিবেশনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব হয় না। দেশের সংবিধান গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে বটে কিন্তু অদৃশ্য চাপের মুখে সে সুযোগ ব্যবহার সম্ভব হয় না। একটি সরকারের পক্ষে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা থাকে তবে তথ্যপ্রবাহ অবাধ করতে হবে। তা না হলে মুদ্রার একটি পিঠ দেখে প্রশাসনের পক্ষে জনগণের কল্যাণ করা সম্ভব হবে না। সরকারের চোখ কান হচ্ছে গণমাধ্যম। তাই গণমাধ্যমকে যতটা স্বাধীনতা দেয়া সম্ভব তা দিলে নীতিনির্ধারকেরা উপকৃত হবেন। সরকারের পক্ষে মানুষের হিত করতে হলে তথ্য জানতে হবে। যেখানে গণতন্ত্রের চর্চা হয় সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে থাকে। এখন দেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট চলছে বিধায় মানুষ হতাশ হয়ে ভাবছে, অতীতে অনেক মন্দ উদাহরণ রয়েছে তার যেন না কোনো পুনরাবৃত্তি ঘটে।

দুর্বৃত্তরা সমাজের বেকার দরিদ্র মানুষের অভাব অভিযোগকে পুঁজি করে তাদের নানাভাবে বিপথগামী করে থাকে। তাদের হাতে কাজ থাকে না বলেই তারা বিপথগামী হয়। তাই সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে দেশে কর্মের সংস্থান সৃষ্টি করে বেকার হাতকে কর্মের হাতে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা সরকারকে নিতে হবে। দেশে এক বিরাটসংখ্যক যুবক বেকারের গ্লানিকর জীবনযাপন করছে। বিনিয়োগ করে যাতে বিনিয়োগকারী শিল্প গড়ার সহায়তা পায় এমন বিনিয়োগবান্ধব নীতি ও পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস নেয়া জরুরি। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ও অবকাঠামো না থাকায় বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এর সাথে এমন খবরও রয়েছে, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের দুর্বলতার কারণেই এমন অনিয়ম হচ্ছে।

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement