নিশীথ নির্বাচনের দেশ
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ১৩ মার্চ ২০১৯, ১৮:৫২
একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। আদালতে খুনের মামলার সাক্ষ্য দিচ্ছে এক লোক। পক্ষে-বিপক্ষে জেরা, অবশেষে বিচারক সাক্ষীকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনার আরো কিছু বলার আছে?’ সাক্ষী বলছেন, ‘স্যার, দারোগা সাহেব তো আর কিছু শিখিয়ে দেয়নি।’ গল্পটি মনে পড়ল আমাদের সিইসি কে এম নুরুল হুদার সর্বশেষ বয়ান শুনে। এত দিন ধরে নির্বাচন কমিশনার ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন যে কতটা সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ হয়েছে তা প্রমাণ করার জন্য শক্ত শক্ত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় কমিটির এক সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচন এমন সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে হয়েছে যে এর চিত্র রেকর্ডে রাখার মতো।’ উপজেলা নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের জয়গান গেয়ে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ওই রকম সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন করতে। এ সময়ে নিশ্চয়ই তিনি জানতেন, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার কথা। সারা দেশে প্রায় সর্বত্র ছিল একই দৃশ্য। প্রশাসন সরকারি নির্দেশনার ‘পবিত্রতায়!’ সে দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ^স্ততার সাথে পালন করেছে। সুতরাং সিইসি তথা নির্বাচন কমিশনের প্রচ্ছন্ন নির্দেশনায়ই বিষয়টি ঘটে থাকবে। কিন্তু প্রকাশ্যত সিইসি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের আইনের ভাষায় কথা বলতে হবে। তাই এত দিন ধরে তোতাপাখির বুলি আউরে যাচ্ছিলেন। মনস্তত্ত্ববিদেরা বলেন, মানুষের সত্তা দুই রকমের- চেতন ও অবচেতন। একজন ব্যক্তি যখন সরকারি ভাষায় আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলেন তখন তিনি হিসাব-নিকাশ করে ভেবেচিন্তে কথা বলেন। কিন্তু ওই ব্যক্তি যখন বাড়িতে থাকেন বা ঘরোয়া পরিবেশে কথা বলেন তখন মেপে মেপে বলেন না। আবার কখনো কখনো অবচেতন সত্তা চেতনকে অতিক্রম করে। তখন অবলীলাক্রমে সে আসল কথা বলে ফেলে। শুনেছি পুলিশ বা গোয়েন্দারা নাকি আসল কথা বের করার জন্য লোকজনকে মদ-মাদক ধরিয়ে দেয়। তখন সে গড়গড় করে যা ঘটেছে তাই বলতে থাকে।
দারোগা বাবুর শেখানো বুলি সে ভুলে যায়। আমাদের গল্পের সাক্ষী খুনের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যে বিশদ ও বিশ্বস্ত! বর্ণনা দিয়েছে অবশেষে বিচারককে সে যা বলেছে তা তার সাক্ষ্যকে মিথ্যা, বানোয়াট ও অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। আমাদের সিইসি অবশেষে এই সেদিন অবচেতন মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুখ ফসকে যা বলে ফেলেছেন, আসলে তাই হচ্ছে নির্ভেজাল সত্য। এরপর তিনি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা এখনো করেননি। তবে তার পারিষদরা ইনিয়ে-বিনিয়ে ‘যদি’, ‘তবে’ ও ‘কিন্তু’ খাটিয়ে সত্যকে মিথ্যা বানানোর চেষ্টা করছেন। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন শাসক দলের বড় মাতবররা। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, ‘সিইসি কী বলেছেন বা কী বুঝাতে চেয়েছেন, তা আগে জানা উচিত। তবে বিরোধীরা নির্বাচনে পরাজয়ের পর যেসব অভিযোগ সচরাচর করে থাকে, ইভিএমে ভোট হলে সেটার সুযোগ নেই, এটাই হয়তো বুঝাতে চেয়েছেন।’ অন্য কর্তাব্যক্তিরা একই সাফাই গাইছেন।
এখন দেখা যাক, সিইসি আসলে কী বলেছেন! গত ৮ মার্চ সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে নির্বাচন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দানকালে তিনি বলেন, ‘জেলা-উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরে দূরে ভোটকেন্দ্র হয়। এ কারণে আগের দিন এসব কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স পাঠাতে হয়। এখানে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স নিয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু যদি ইভিএমের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আর ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না।
তিনি আরো বলেন, সমাজের মধ্যে অনিয়ম ঢোকে, তা প্রতিহত করতে পদক্ষেপ নিতে হয়। এ কারণে কমিশন ভাবছে ইভিএমে ভোট নেয়া শুরু করবে।’ গণমাধ্যমে সরকারি বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, সিইসির বক্তব্য আংশিকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। তাই সিইসির বক্তব্যটি পূর্বাপর সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হলো- যাতে ভুল বোঝাবুঝির কোনো অবকাশ না থাকে। সিইসি ইভিএম পদ্ধতির মাধ্যমে ভোট জালিয়াতি ঠেকাতে চেয়েছেন। অথচ এই ইভিএম পদ্ধতির মাধ্যমেই ভোট জালিয়াতি করা খুবই সহজ বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিচ্ছেন। তাই গোটা পৃথিবী থেকে ইভিএম পদ্ধতির ভোট গ্রহণ এক রকম উঠে গেছে। সিইসি হয়তো আগামী নির্বাচনগুলোতেও সরকারি দলকে সাহায্য করার চিন্তা করছেন, যাতে আগের রাতে ভোটের বাক্স ভরে দেয়ার কষ্টকর কারসাজি তাদের করতে না হয়। উল্লেখ্য, সরকারি দল আওয়ামী লীগ বরাবরই ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের পক্ষে।
সরকারি দল এবং সিইসি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে অসত্য বক্তব্য দিয়ে মিথ্যাকে সত্য আর ষোলআনা সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে। হিটলারের তথ্যমন্ত্রী গোয়েবলস নাকি বলতেন, একটি মিথ্যা ১০০ বার বললে সত্য হয়ে যায়। মানুষ প্রচারণা ও প্রতারণার কারণে মিথ্যাকে সত্য বলে গ্রহণ করে। কিন্তু বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে কোটি মানুষের সামনে যা ঘটেছে তা ভুলিয়ে দিতে শাসক দলের কোনো কারসাজি কাজে আসবে না। প্রধান ব্যক্তি থেকে আওয়ামী লীগের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯ নম্বর নেতা যা বলছেন তা হুবহু এক। এর মধ্যে কোনো লাজলজ্জা ও শরম-ভরমের বালাই নেই। নির্বাচন সর্বত্রই সর্বাঙ্গ সুন্দর, যথার্থ গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ হয়েছে।
এরা ভাবছে না, যেসব মানুষের সামনে তারা এসব বলছে, কোটি কোটি সেই মানুষ সব অপকর্মের চাক্ষুষ সাক্ষী। বিদেশী প্রবাদবাক্যটি এ রকম- ‘তুমি সকল মানুষকে কিছু সময়ের জন্য, কিছু মানুষকে সকল সময়ের জন্য বোকা বানাতে পারো, কিন্তু সকল মানুষকে সকল সময়ের জন্য বোকা বানাতে পারো না।’ এ প্রবাদবাক্যটি হয়তো বিদেশীদের বেলায় প্রযোজ্য হতে পারে, বাংলাদেশের মানুষের ক্ষেত্রে এটির প্রয়োগ অসম্ভব। বিদেশীদের এই ধারণাও দেয়া হয়েছে যে, এটি তার সর্বশেষ ক্ষমতায় আরোহণ। সুতরাং ভুলত্রুটি মার্জনীয়। বিদেশীরা এসব কথা বিশ^াসও করতে পারে। বাংলাদেশের মানুষদের কাছে তারা এতটাই বিশ^াস, আস্থা ও ভালোবাসা হারিয়েছেন যে কিরা-কসম দিয়েও তারা আর বিশ^াসযোগ্যতা ফিরে পাবেন না।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সম্পর্কে শাসককুলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- নির্বাচন সম্পর্কে কোনো প্রমাণযোগ্য অভিযোগ নেই। কেউ যদি মহাসমুদ্রের অথৈ পানিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্র না দেখে তা যেমন আজগুবি, তাদের চ্যালেঞ্জও তেমনি অবাস্তব ও অযৌক্তিক। আরো একটি উদাহরণ দেয়া যায়, আপনি আপনার গ্রামের প্রতিবেশী আবদুল করিমকে চেনেন। এখন আপনিই যদি বলেন, তুমি প্রমাণ করো যে তুমিই আবদুল করিম, তা যেমন হাস্যকর ও অদ্ভুত, আওয়ামী লীগের দাবিও সে রকম হাস্যকর ও অদ্ভুত। আপনি যদি আবদুল করিমকে প্রমাণ দিতে বলেন, সে আইডি কার্ড আনবে, চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট দেবে এবং প্রয়োজনে কোর্টে গিয়ে এফিডেভিট দিয়ে প্রমাণ করবে যে, সেই আবদুল করিম। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সম্পর্কে সে রকম প্রমাণ জোগাড় করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। নির্বাচনের পরপরই আটটি বাম দলের সমন্বয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোট গত ১১ জানুয়ারি অনিয়ম নিয়ে গণশুনানি করে। এতে জোটের ১৩১ জন প্রার্থী নির্বাচনে কারচুপির কথা তুলে ধরেন। এরপর ঐক্যফ্রন্ট ড. কামালের নেতৃত্বে শুনানি করে ২২ ফেব্রুয়ারি। এতে ফ্রন্ট তথা বিএনপির সব প্রার্থী তথ্যপ্রমাণ দিয়ে তাদের অভিযোগ প্রমাণ করে। উভয় শুনানিতে বলা হয়, ভোটের দিন সরকারি দলের লোকজন ভোটকেন্দ্র জবরদখল করে রেখেছিল। সাধারণ ভোটারদের আগমন পথে বাধা দেয়া হয়। এরপরও যারা এসেছিল, কাউকে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়নি।
বিরোধী দলের কোনো পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। ভোট গ্রহণের আগের রাতে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যালট পেপারে সিল মেরে রাখা হয়েছিল। বিরোধী নেতৃবৃন্দ আন্দোলন ব্যতীত আর সব পথেই কাজ করেছেন। এ দেশের বিচার বিভাগের অবস্থা জানা সত্ত্বেও তারা ভোট কারচুপি এবং নির্বাচন বাতিলের দাবি করে হাইকোর্টে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে ৭৪টি মামলা করেছেন। মামলার ফলাফল কী হবে তা সবারই জানা কথা। তারপরও মনের খেদ মেটানোর চেষ্টা। এ দিকে গবেষণা সংস্থাগুলোও বসে নেই। টিআইবি গত ১৫ জানুয়ারি ‘একাদশ সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা’ শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ৩০০ আসনের মধ্যে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০ আসন বেছে নিয়ে এই গবেষণা কর্মটি পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ৪৭ আসনে নির্বাচনের দিন কোনো-না-কোনো অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে। ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে বলে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়। আওয়ামী লীগ এবং নির্বাচন কমিশন যথারীতি এই গবেষণাকে সর্বৈব মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্যেশ্যমূলক বলে বর্ণনা করে।
কী করে তারা আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে রেখেছিল তা প্রত্যেক প্রিজাইডিং অফিসার জানেন। সর্বত্র একই কায়দায় প্রায় একই সময়ে এই জালিয়াতি পর্ব সম্পন্ন করা হয়। একজন প্রিজাইডিং অফিসারের জবানিতে শুনুন সে গল্প- ‘আমার নাম ক। আমি অমুক জেলার অমুক উপজেলার খ ভোটকেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার ছিলাম। খুব কষ্ট করে ব্যালট বাক্স মালমাত্তা ইত্যাদি নিয়ে সন্ধ্যায় ভোটকেন্দ্রে পৌঁছি। আমাদেরকে ভোটকেন্দ্রের কাছাকাছি একটি স্কুলঘরে থাকতে দেয়া হয়। রাত ১১টার দিকে একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর আমার কাছে আসেন। তিনি আমাকে একটি ছবি দেখান এবং বলেন, রাত ২-৩টার দিকে কিছু লোক আসবে। তারা ওই ছবি দেখালে তাদেরকে ভোট দিতে দেবেন। এটা সরকারি আদেশ। আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাই। আমি তাকে প্রশ্ন করি, ভোট তো দিনে হবে, রাতে ভোট কী করে হয়? প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালনের প্রশিক্ষণে আমাদেরকে ইউএনও এবং ডিসির ফোন নাম্বার দেয়া হয়েছিল, যাতে কোনো সমস্যায় পড়লে তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়। আমি ইউএনওকে ফোন করলাম।
তিনি বললেন, পুলিশ কর্মকর্তা যা বলেছে তাই করুন। এটাই সরকারি সিদ্ধান্ত। আমি আশ^স্ত হতে না পেরে ডিসিকে ফোন করলাম। ডিসি বললেন, আপনি তো একটু আগে ইউএনওকে ফোন করেছিলেন। আমাকে কেন আবার? আমি বললাম, আমি আশ^স্ত হতে পারছি না। তিনি বললেন, যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেটি বিশ^স্ততার সাথে পালন করুন। নইলে আপনার অসুবিধা হতে পারে। এটাই সরকারি সিদ্ধান্ত। আমি উপায়-আপায় না দেখে তাদের কথামতো কাজ করি। ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের কথা থাকলেও তারা ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পেটায়। এরপর আমি ওই কাজে উপস্থিত একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করিÑ আগামীকাল তাহলে ভোট কিভাবে চলবে? তিনি আমাকে আশ^স্ত করেন, সে চিন্তা আপনার নয়, আমাদের। আমরা যা বলব আগামীকাল তাই করবেন। আমাদের লোকেরাই ঘুরেফিরে ভোট দেবে। অন্য কাউকে ধারে-কাছে আসতে দেয়া হবে না। যদি হঠাৎ করে লম্বা লাইন হয়ে যায়, তাহলে নাশতা, খানাপিনা বা অন্য অজুহাতে ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখবেন। এতেও যদি না কুলানো যায় তাহলে ছুতোনাতা অভিযোগে পুলিশ ও আনসাররা লাঠিচার্জ করবে। ভোটাররা ভেগে যাবে। বিরোধী লোকেরা গণ্ডগোল করতে চাইলে আমাদের ক্যাডাররা তাদের সমুচিত জবাব দেবে।
তারপর দিন আমি সে রকম দৃশ্যই অবলোকন করি। বিরোধী এজেন্ট আমার ভোটকেন্দ্রে কেউই আসেনি। তারা আমাদের এ কাজের জন্য ভালো টাকা দিয়েছে। আমি নির্বাচনের পাশর্^বর্তী এলাকার খোঁজখবর নেই। সর্বত্রই একই খবর শুনি। একটি ঘটনা আমাকে পীড়া দিয়েছে। তা হলো আমার এক সহজ সরল বন্ধুও পাশর্^বর্তী এলাকায় প্রিজাইডিং অফিসার ছিল। সে পুলিশকে বলেছিল, সত্যতার জন্য আপনাদের কথা আমি রেকর্ড করে রাখলাম। নির্বাচন শেষে একদল ক্যাডার এই বন্ধুকে বেদম প্রহার করে। তারা তার টাকা-পয়সা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। পুলিশ এটাকে দুষ্কৃতকারীদের কাজ বলে উল্লেখ করে। পরে তাদের সহযোগিতায় তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়।’ একজন প্রিজাইডিং অফিসারের অপ্রিয় সত্য ভাষণ শুনলেন। এভাবে দিনের নির্বাচন রাতে করার ‘ঐতিহ্য!’ ক্ষমতাসীন সরকার সৃষ্টি করেছে। নির্বাচন কমিশন এ ধরনের ঘটনা উপজেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রে হবে না বলে আশ^স্ত করলেও পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা যায়, সে ঐতিহ্য বহমান রয়েছে। ভবিষ্যতেও এই ঐতিহ্য চলমান থাকবে, অবশ্য যদি তারা ক্ষমতায় থাকে।
আবার ফিরে যাই সিইসির সেই মহান মন্তব্যে। এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সিইসি ও আর একজন কমিশনার যদি এমন কথা বলে থাকেন, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, জাতীয় নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার অভিযোগ সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। প্রকারান্তরে তারা এটা স্বীকার করে নিয়েছেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সিইসি তার বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলেন, আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির অন্যতম শীর্ষ নেতা খন্দকার মোশারফ হোসেন মন্তব্য করেন, ওই বক্তব্যের মাধ্যমে সিইসি ২৯ ডিসেম্বর রাতে ভোট ডাকাতি করে যে বাক্স ভরে রাখা হয়েছিল তা স্বীকার করে নিলেন। তবে ইভিএম চালু করলেও তা হবে ডাকাতির উদ্দেশ্যে।
দেরিতে হলেও বোধোদয় ঘটেছে সরকারি পোষ্য মহাজোটে। সাবেক মন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে নির্বাচনী ব্যবস্থায় অশুভ শক্তির প্রভাবের কথা বলেছেন। তার মন্তব্য, যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ দেশের ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে তাহলে রাজনৈতিক দল কেবল নির্বাচন নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায়ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। এটা যেমন আমাদের জন্য প্রযোজ্য, সরকারি দলের জন্যও তা প্রযোজ্য। নির্বাচনকে তাই যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এর আগে সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুও অতি উৎসাহীদের দায়ী করে মন্তব্য করেছিলেন। এসব মন্তব্যের মাধ্যমে যখন ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের কালো অধ্যায় দিনে দিনে আলো দেখছে, তখন সে বিষয়ে তদন্ত করতে দোষ কী? উল্লেখ্য, নির্বাচনের পর থেকে দেশে এবং বিদেশে জোরেশোরে তদন্তের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
পুনশ্চ : এ লেখাটি সমাপ্ত করার আগেই খবর পাওয়া গেছে যে ডাকসু নির্বাচনেও জাতীয় নির্বাচনের ‘সরকারি ঐতিহ্য!’ বজায় থেকেছে। সেখানেও রাতের আঁধারে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার অভিযোগ এসেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সুধীজনেরা বিষয়টি তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
যেখানে সারা বিশ্বে নির্বাচন হয় দিবালোকে, স্বচ্ছতায় এবং সর্বজন গ্রহণযোগ্যতায় সেখানে আমাদের নির্বাচন হয় ‘নিশীথ রাতে’। আমরা সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে নিশীথ সূর্যের দেশের কথা শুনেছি। নতুন প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন করছে- নিশীথ নির্বাচনের দেশ কোনটি? তারাই উত্তর দিচ্ছে, বাংলাদেশ। দেশমাতৃকার এই কলঙ্ক তিলক ঘুচবে কবে?
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা