২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জনমত, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র

ফাঁকা ভোটকক্ষে অলস সময় পার করছেন নির্বাচনী দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তারা - ফাইল ছবি

গ্রিক দার্শনিক প্লেটো সাধারণ জনগণের মতামতের কোনো মূল্য আছে বলে মনে করেননি। তার মতে, এসব মতামত পরিবর্তনশীল। রোমান লেখকেরাও জনমতের খুব একটা দাম দিতেন না। প্রাচীনকালে জনমতের কিছু ভূমিকা হয়তো ছিল, কিন্তু মতামত দেয়ার অধিকারী মানুষ ছিল খুবই নগণ্য। মতামত প্রকাশের সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক কোনো পদ্ধতিও ছিল না। রোমানদের ব্যাপক রাজ্য জয়ের কারণে সংবাদ ও তথ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। ফলে রোমানরা vox populi বা ‘জনগণের কথা’ বলতে শুরু করেন।

আঠারো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত রাজনৈতিক বোদ্ধারা vox populi, vox dei তথা ‘জনগণের কথাই ঈশ্বরের কথা’ বলতে শুরু করেননি। এর পরই দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। ফ্রান্সে রুশো এবং পরে নেকার জনমতের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। ইংল্যান্ডে জেরেমি বেনথাম বেশ জোর দিয়েই বলেন, দেশে কুশাসন সামাজিকভাবে রোধ করার জন্য জনমত একটি বিশেষ শক্তি এবং গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। আর তা থেকেই জনমতের গুরুত্ব ও গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত পৌঁছেছে।

‘দ্য স্পিরিট অব লজ’ গ্রন্থে মন্টেস্কু বলেছেন, ‘.... দেশে কোন প্রকৃতির সরকার থাকবে বা কারা শাসনকার্য পরিচালনা করবে তা বাছাই করার ‘মাস্টার’ হিসেবে কাজ করে ভোটাররাই।’ বাংলাদেশের সংবিধানেও এ কথার স্বীকৃতি মিলেছে। সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’।

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হচ্ছে, জনগণ। ভোটাররা তাদের সুবিবেচনাপ্রসূত মতামত দেয়ার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকেন। এই প্রক্রিয়া যাতে নির্বিঘœ ও স্বচ্ছ হয় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সপ্তদশ শতক থেকেই গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা। নির্বাচনের মাধ্যমে আইন সভা, আঞ্চলিক এবং স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধি বাছাই করা হয়। আধুনিক গণতন্ত্রে প্রতিনিধি বাছাইয়ের পন্থা হচ্ছে নির্বাচন।

গ্রিসের এথেন্সে গণতন্ত্রের আদি চেহারায় নির্বাচনকে যেভাবে ব্যবহার করা হতো তার পরিবর্তন হয়েছে। অতীতে নির্বাচনকে শাসকগোষ্ঠীর একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হতো এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার বেশির ভাগই পূরণ করা হতো জনমতভিত্তিক বাছাইয়ের মাধ্যমে। সঙ্কীর্ণতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা সে অবস্থায় বিচ্যুতি ঘটিয়েছে। ফলে স্থান, কাল ও পাত্রভেদে জনমতের গুরুত্ব ও গণতন্ত্রের স্বরূপও ভিন্ন।

গণরায়ের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ঐতিহ্য প্রাচীনই বলা যায়। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে নির্বাচনপদ্ধতির প্রয়োগ ছিল সীমিত আকারে। পুরো মধ্যযুগেও রোমান সম্রাট ও পোপের মতো শাসক বাছাই করতে নির্বাচনপদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। বাংলায় মধ্যযুগের গোড়ার দিকে পাল রাজাদের মধ্যে ‘গোপাল’ বাছাই করা হতো মতামতের মাধ্যমে।

তবে আধুনিক ‘নির্বাচন’ হলো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সরকার নির্ধারণ। সপ্তদশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে যখন প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের ধারণা এলো তার আগে জনসাধারণকে দিয়ে সরকারি পদাধিকারী বাছাইয়ের এই আধুনিক ‘নির্বাচন’ বিষয়টির আবির্ভাব হয়নি।
ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়।

ঔপনিবেশিক শাসনের আগে উপমহাদেশে রাজতন্ত্রই চালু ছিল; কিন্তু ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও ভারত বিভাজনের পর এ উপমহাদেশে আধুনিক গণতন্ত্রের সূচনা হয়। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারত একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হলো এবং নতুন সংবিধান অনুযায়ী ভারতে একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার কারণেই স্বাধীনতার পর ভারতের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে এবং অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়। কৃষি ও শিল্পব্যবস্থায়ও প্রভূত উন্নতি হয়। ফলে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। একই সময়ে স্বাধীনতা লাভ করলেও গণতন্ত্র চর্চায় পাকিস্তান তেমন সাফল্য দেখাতে পারেনি। ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে ওঠেনি।

তাই পাকিস্তান ভারতের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়; কিন্তু সেটি সরাসরি ভোট ছিল না। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে প্রত্যক্ষ ভোটের প্রথা রহিত করে ‘ইলেকট্রোরাল কলেজ’ সৃষ্টি করা হয়। এর ৮০ হাজার সদস্যের মধ্যেই ভোটদানের অধিকার সীমিত ছিল। তারা প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

কিন্তু সে নির্বাচনের গণরায়ের প্রতি শাসকচক্র শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখাতে পারেননি। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুপস্থিতি এবং এক অনিবার্য বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান রাষ্ট্র আর অখণ্ড থাকতে পারেনি। ফলে ১৯৭১ সালে বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামের নতুন এক জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটে। এ জন্য দায়ী পাকিস্তানি শাসকচক্রের অগণতান্ত্রিক মানসিকতা ও জনমতের প্রতি সীমাহীন অশ্রদ্ধা।

গণতন্ত্রভিত্তিক একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই আমরা ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলাম। আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান চেতনাও ছিল উদার গণতন্ত্র; কিন্তু সে লক্ষ্য আমাদের কাছে আজো অনেকটাই অধরা। আমাদের দেশে গণতন্ত্র চলেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এটাকে ত্রুটিমুক্ত ও অবারিত করার জন্য আমাদের অনেকবারই রাজপথে নামতে হয়েছে। এ জন্য আমরা বেশ মূল্যও দিয়েছি।

এ ক্ষেত্রে সাফল্যও এসেছে; কিন্তু সাফল্যের ধারাবাহিকতা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। ফলে গণতন্ত্রের সঙ্কট কেটে যায়নি। সংবিধানে গণতন্ত্রকে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হলেও এর প্রয়োগ এখনো বিতর্কমুক্ত নয়। সংবিধানে গণতন্ত্র আছে, মেয়াদান্তে নির্বাচনও হচ্ছে; কিন্তু এতে জনমতের প্রতিফলন নেই এমন অভিযোগ দীর্ঘ দিনের।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব অভিযোগের মাত্রা বেড়েছে। বিশেষ করে গত ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচন সে আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলে দিয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে এবার ডিএনসিসির মেয়র উপনির্বাচন। এসব নির্বাচনে গণতন্ত্রের দৈন্য খুবই স্পষ্ট। এটা রাষ্ট্র, সরকার ও নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান সৃষ্টি করেছে।

অধ্যাপক গেটেলের মতে, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কোনপর্যায়ে আছে তা বোঝা যায় নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের ওপর কতটুকু প্রভাব বিস্তার করছে এবং সরকারের অন্যান্য বিভাগের সাথে তার সম্পর্ক কিরূপ তা থেকে।’ আর এ ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ‘ফ্রিডম হাউজ’-এর একটি প্রতিবেদনে। নাগরিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকারের বিচারে, মুক্ত গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশকে ‘আংশিক মুক্ত’ গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে এই গবেষণা সংস্থা।

সংস্থাটির ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১০০ পয়েন্টের মধ্যে মাত্র ৪১ পয়েন্ট লাভ করেছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সাত স্তরবিশিষ্ট নিম্নমুখী সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম স্তরে। নাগরিক স্বাধীনতার সূচকেও বাংলাদেশ পঞ্চম অবস্থানে। আর সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সাত স্তরবিশিষ্ট নিম্নমুখী সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম স্তরে।

দেশে গণতন্ত্রের যে কক্ষচ্যুতি হয়েছে তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের সাম্প্রতিক নির্বাচন-পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট। এ দেশের নির্বাচনের মান নিয়ে নির্বাচন কমিশন আত্মতুষ্টিতে ভুগলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্বীকার করেছেন যে, অনেক ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত মানের নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। এর আত্মস্বীকৃতি মিলেছে সরকারি দলের পক্ষ থেকেও।

সদ্য সমাপ্ত ডিএনসিসির উপনির্বাচন প্রসঙ্গে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সাম ফর্ম অব ডেমোক্র্যাসি ইজ বেটার দেন নো ডেমোক্র্যাসি। সাম ফর্ম অব ইলেকশন ইজ বেটার দেন নো ইলেকশন’। এতে প্রমাণ হয় যে, দেশে গণতন্ত্র আছে; কিন্তু তা খুবই ভঙ্গুর ও চলৎশক্তিহীন। তাই তিনি ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা’কেই শ্রেয় মনে করছেন। এ ধরনের গণতন্ত্র দেশ ও জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সাংবিধানিক শাসনের জন্য অন্তরায়।

বেহাল গণতন্ত্র চর্চার কারণেই সাধারণ মানুষ নির্বাচনবিমুখ। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে জনমতের প্রতিফলন নিয়ে যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে, রাষ্ট্র বা সরকার এর কোনো জবাব দিতে পারছে না। সদ্য সমাপ্ত ডিএনসিসি উপনির্বাচনের ব্যাপারে ভোটারদের অনাগ্রহ সে দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি যে খুবই নগণ্য ছিল তা মন্ত্রী ও খোদ নির্বাচন কমিশনও স্বীকার করেছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসী ঢাকা সিটির ভোটের দৃশ্য দেখেছে বেশ ভালোভাবেই। আসল বিষয়টি কারো কাছেই অপ্রকাশ্য থাকেনি।

মানুষের মূল্যায়ন হলো, এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতাকর্মী ছাড়া কোনো মানুষ ভোট দিতে যাননি। অনেকেই বলছেন, জন্মের পর ভোটের এই বেহাল অবস্থা আর কখনো দেখিনি। ভোটাররা এই নির্বাচনকে জনমতের প্রতিফলনের অনুকূল মনে করেননি।

সব জাতিরাষ্ট্রই যখন গণতন্ত্রকে অবলম্বন করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের পশ্চাৎপদতা অত্যন্ত লজ্জাকর। ‘আগে উন্নয়ন, তারপর গণতন্ত্র’ কথাটা শ্রুতিমধুর হলেও মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন কল্পনাবিলাস মাত্র। কোনো রাজনৈতিক শক্তির একক কর্তৃত্বকে গণতন্ত্র বলার সুযোগ নেই। গণতন্ত্রের মর্মবাণীই হচ্ছে সমতা।

smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
ইউক্রেনের ডনেটস্ক অঞ্চলের গ্রামগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে রাশিয়া পর্ণো তারকাকে অর্থ দেয়ার মামলা খারিজের আবেদনের অনুমতি পেলেন ট্রাম্প দোহারে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর নামে ছাত্রলীগ নেতার মামলা ‘কোরআন-সুন্নাহর আদর্শ ছাড়া আলেমদের জন্য রাজনীতি জায়েজ নেই’ চীনা দূতাবাসের আউটস্ট্যান্ডিং পার্টনার অ্যাওয়ার্ড অর্জন অ্যাবকার ঢাবির রাজনীতিবিষয়ক বিশেষ কমিটির কার্যক্রম শুরু রোববার রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিকদের বিক্ষোভ রেহানার সুরের মূর্ছনায় হেমন্তের এক মুগ্ধ সন্ধ্যা একুশে বইমেলায় স্টলভাড়া কমানোর দাবি ২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সপ্তাহ পার করল স্বর্ণের বাজার নির্বাচনের কোনো বিকল্প দেখছেন না তারেক রহমান

সকল